• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||

আমরাও বিশ্বের সেরা মেধাশক্তি হতে পারি

প্রকাশ:  ১৭ মার্চ ২০১৯, ১৩:০২
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

মেধা একটি সম্পদ, আর সেই দৃষ্টিকোণ থেকে মেধাবী প্রজন্ম গড়ে তোলা সংস্কৃতির একটি অংশ হতে পারে। বিশেষ করে যখন কোনো সমাজে বা রাষ্ট্রে মেধাবী মানুষদের সংখ্যা বেশি থাকে, তখন তাদের মেধাশক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে সেই সমাজ বা রাষ্ট্র উন্নয়নের পথে এগিয়ে যায়। এই মেধাশক্তির প্রয়োগ এককভাবে বা সমন্বিতভাবে হতে পারে। অনেকে ভৌগলিক অবস্থানের ভিন্নতার কারণে মেধার ভিন্নতার বিষয়টি বলে থাকলেও সেটি যৌক্তিক নয়। বরং মেধা বিকাশের জন্য একটি পরিকল্পিত পরিবেশ ও ভাবনার প্রয়োজন হয়। মেধার প্রকাশ ঘটে বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে। আবার এই বুদ্ধিমত্তা কেবল জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নতিকেই বুঝায় না, এর সাথে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণ সৃষ্টির লক্ষ্যে কৌশলগত পরিকল্পনাকেও বুঝায়।

জাতিগত ভাবে বাঙালীরা মেধাবী হলেও এখানে মেধা চর্চা ও বিকাশের বিষয়টিকে অনেক ক্ষেত্রে অবহেলা করা হয়। এর ফলে যে পরিমান মেধাশক্তি সৃষ্টি হওয়ার কথা ছিল তা বজায় থাকে না। আবার মেধাকে ধরে রাখার ও এর উৎকর্ষ সাধনের যে কৌশলগুলো রয়েছে, সেগুলোও মেনে চলা সম্ভব হয় না। অনেকেই একটি বিষয় বলে থাকেন, আমাদের দেশে মেধা বিকাশের সুযোগ নেই। কথাটি কোনভাবেই সত্য নয়। বরং একজন মানুষ ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই মেধা বিকাশের ক্ষেত্রগুলো তৈরী করা যায়। এছাড়া মেধাকে প্রয়োগ করার যে পরিবেশ তা সৃষ্টি করার ইতিবাচক মনোভাবও মানুষের মধ্যে থাকতে হয়। কোন একটি সৃষ্টির ক্ষেত্রে মেধা প্রয়োগ করে থেমে থাকলে এর বিকাশ ঘটে না। একটি সৃষ্টির ভাবনা থেকে বহুমাত্রিক সৃষ্টির ভাবনা মেধাশক্তির বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করে। অনেক সময় আমরা ইহুদিদের জাতি হিসাবে অনেক মেধাসম্পন্ন ও বুদ্ধিমান বলে বিবেচনা করে থাকি। কিন্তু তারা কেন এতো মেধাবী এ বিষয়টি কখনও আমরা বিশ্লেষণ করে দেখি না। বরং এটি মনে করা হয় জন্মগতভাবেই একজন ইহুদি অন্য জাতিগোষ্ঠির তুলনায় বেশি বুদ্ধিমান ও মেধাসম্পন্ন হবে। বিষয়টি কোনভাবেই বিজ্ঞান সম্মত ও যৌক্তিক নয়। তাদের বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে বিজ্ঞান ও পরিকল্পনা যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সেটি কখনও আমরা ভেবে দেখি না।

সম্পর্কিত খবর

    ইহুদি জনগোষ্ঠির বুদ্ধিমত্তার এই বিষয়টিকে গবেষণা করতে দিয়ে ড. ষ্টিফেন কার লিওন কতগুলো বিষয়কে চিহ্নিত করেন। তাঁর ৮ বছরের এই গবেষণায় যে বিষয়গুলি গুরুত্বপূর্ণভাবে উঠে আসে সেগুলো হলো- তাদের খাদ্যাভাস, সংস্কৃতি, ধর্ম, গর্ভাবস্থায় প্রস্তুতিসহ অন্যান্য বিষয়। এই প্রতিটি বিষয় কোন না কোন ভাবে বিজ্ঞান, মনস্তত্ত ও দর্শনগত ধারণার সাথে যুক্ত। একটি শিশু যখন গর্ভাবস্থায় থাকে তখন মায়েরা গান বাজনা, পিয়ানো বাজানো ও তাদের স্বামীদের সাথে গণিতের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করে থাকেন। গর্ভবর্তী মহিলাদের এই সময়ের সঙ্গী হয় বিভিন্ন ধরনের গণিতের বই। এর মাধ্যমে তারা শিশু গর্ভে থাকা অবস্থায় তাকে প্রশিক্ষিত করে তোলে। বিজ্ঞান বলছে একজন শিশুর মস্তিস্কের বিকাশ তার মায়ের গর্ভে থাকাকালীন অবস্থা থেকেই শুরু হতে থাকে। আবার মায়ের বিভিন্ন ইতিবাচক আচরণ গর্ভে থাকা সন্তানকে প্রভাবিত করে। যখন একজন মা গণিতের সমস্যাগুলোর সমাধান করে তখন তার মধ্যে চিন্তাশক্তি ও উদ্ভাবনী শক্তি কাজ করে। যা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে গর্ভের সন্তানের ভিতরেও সঞ্চারিত হয়। ফলে গর্ভাবস্থায় একজন শিশুর মেধার বিকাশ যেভাবে ঘটে অন্য জাতি গোষ্ঠির মধ্যে এই ধরনের ধারণার প্রচলন না থাকায় তাদের ক্ষেত্রে সেই ভাবে মেধাশক্তির বিকাশ ঘটে না। কেবলমাত্র বিজ্ঞানের ধারণাকে এখানেই প্রয়োগ করা হয় না, খাদ্যাভাসের মাধ্যমে যে মেধাশক্তি বাড়ানো যায় এই বিষয়টিও মায়েদের মধ্যে কাজ করে। এই সময় মায়েরা আলমন্ড খেজুর, দুধ, রুটি, কর্ডলিভার, মাথা ছাড়া মাছ এবং অন্যান্য বাদামযুক্ত সালাদ খেয়ে থাকে। প্রতিটি খাদ্যই কোন না কোন ভাবে শিশুর মস্তিস্ক বিকাশের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানসম্মতভাবে ভূমিকা রাখে।

    আরেকটি বিষয় এখানে লক্ষ্যনীয়, তা হলো- মাছের মাথা বাদ দিয়ে অন্যান্য যে অংশগুলো রয়েছে সেগুলো মায়েরা খেয়ে থাকেন। এর কারণ হচ্ছে মাছের মাথা মস্তিস্ক গঠনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে। কিন্তু মাথা বাদে অন্যান্য অংশগুলো মস্তিস্কে পুষ্টি সরবরাহের মাধ্যমে গর্ভাবস্থায় শিশুর মেধা বিকাশে সাহায্য করে। যেকোন খাবার গ্রহণ করার আগে তারা বিভিন্ন ধরনের ফলমূল খেয়ে থাকে। যেটিও বিজ্ঞানসম্মতভাবে প্রমাণিত একটি খাদ্যাভাস। এখানে মায়েদের সঙ্গীত চর্চা ও তা শোনার কথা বলা হয়েছে। বিজ্ঞানের আধুনিক ধারণা বলছে, মানুষ যখন সঙ্গীত চর্চা করে তখন তার মধ্যে কোন ধরণের মানসিক অস্থিরতা কাজ করে না। বরং এর পরিবর্তে মানসিক ও শারীরিক প্রশান্তি তৈরী হয়। এছাড়া পিয়ানো বাজানোর মাধ্যমে সংস্কৃতির যে চর্চা মায়েরা করে থাকে তা শিশুর সৃজনশীল দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে সাহায্য করে।

    ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর একজন শিশুর মেধার বিকাশকে কিভাবে আরও বাড়ানো যায় এই বিষয়টিও তারা বিবেচনায় রাখে। যেমন- খাদ্যাভাসের ক্ষেত্রে যেগুলো মেধা বিকাশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সেগুলো রাখা হয়। তাদের কোন বিষয়কে ধারণ করার কথা বিবেচনা করে বিভিন্ন ধরনের ভাষায় শিক্ষা দেওয়া হয়। প্রতিটি শিশুকে ভায়োলিন ও পিয়ানো বাজানো শেখানো হয়। এর কারণ হলো সঙ্গীতের কম্পোন মস্তিস্কের কোষগুলোকে উদ্দীপ্ত করে মেধার বিকাশে সাহায্য করে। এছাড়া বিজ্ঞান, গণিত ও ব্যবসায় শিক্ষাকে জীবনমূখী করে শেখানো হয়, যাতে এগুলোর ফলাফল বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করা যায়। খেলাধুলার সাথেও শিশুদের সম্পৃক্ত করা হয়। বিশেষ করে দৌড়, ধুনুবিদ্যা ও শুটিং এ শিশুদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। যেহেতু শুটিং ও ধুনুবিদ্যার মাধ্যমে কোন একটি লক্ষ্যকে অর্জন করতে হয়, সে কারণে এই ধরনের খেলাগুলো শিশুর মস্তিস্ককে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে যোগ্য করে তুলে। এর সাথে গবেষণাকে প্রাধান্য দিয়ে শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে মেধা গঠনের প্রক্রিয়া চলতে থাকে।

    সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, এই জনগোষ্ঠির সংখ্যা মাত্র ২ কোটি ৫০ লক্ষ হলেও বিশ্বের নোবেল পুরুস্কার প্রাপ্তদের মধ্যে এই জনগোষ্ঠির সংখ্যা ২০ শতাংশ। এছাড়াও মেধার বিকাশ কিভাবে সম্ভব এটি নিয়ে গোটা বিশ্বে আলোচনা হলেও আমাদের দেশে এখনও পর্যন্ত এই ধরনের সংস্কৃতি বা গবেষণা গড়ে উঠেনি। ফলে আমাদের তরুণদের মধ্যে যে পরিমাণ মেধা বিকাশ ও ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে, তা সেভাবে হচ্ছে না। এজন্য সরকার জাতীয় মেধা নীতি ঘোষণা করতে পারে। এছাড়া বিভিন্ন প্রচারণার মাধ্যমে কিভাবে মেধার বিকাশ সম্ভব তা আলোচনার সুযোগ সৃষ্টি করা যেতে পারে। যদিও বিজ্ঞানীরা মেধা বিকাশের ক্ষেত্রে ভালো ঘুম, পুষ্টিকর খাবার, নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম ও ব্যায়াম করার কথা বলছেন কিন্তু উন্নত বিশ্বে এর বাইরেও বিভিন্ন প্রক্রিয়া নিয়ে গবেষণা চলছে। যেমন-বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে চুম্বক থেরাপির মাধ্যমে মেধা বিকাশের গবেষণার কথা বলা হয়েছে। যেটিকে রান্সক্র্যানিয়াল ম্যাগনেটিক সিমুলেশন বা টিএমএস নামে অবহিত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে নিউরোলজিস্টদের ধারণা হচ্ছে, মস্তিস্কের উপরের অংশকে চুম্বকক্ষেত্রের প্রভাব বলয়ের মধ্যে এনে এর কোষগুলো উদ্দীপ্ত করে মস্তিস্কের ক্ষমতা ও বোধশক্তি বাড়ানো সম্ভব। কিন্তু তত্ত্বীয়ভাবে এটি সত্য হলেও বাস্তবিক পক্ষে এটি কতটুকু উপযোগী হবে তা নিয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।

    অন্য একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, মায়ের জিন থেকেই শিশুর মস্তিস্কে মেধাশক্তির বিকাশ ঘটে। জিন বিশেষজ্ঞদের ধারণা শুধুমাত্র মায়ের এক্স ক্রোমোজোমই বুদ্ধিদীপ্ত জিন বহন করে, যেখানে বাবার কোন ভূমিকা নেই। বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত মার্কিন বিজ্ঞানী জেফরি সি হল, মাইকেল রসবাশ ও মাইকেল ডব্লিউ ইয়ং বায়োলজিক্যা ঘড়ির কর্মপদ্ধতি নিয়ে গবেষণা করে দেখেছেন, আমাদের ব্রেইনে একটি মাস্টার ক্লক থাকে। যেটি নিয়ন্ত্রণে থাকে বায়োলজিক্যাল ঘড়ি। এই বায়োলজিক্যাল ঘড়িকে নিয়ন্ত্রণ করে কিভাবে মেধাশক্তি বাড়ানো যায়, সে বিষয়ে আমাদের বিজ্ঞানীদের কাজ করতে হবে। মেধা বা বুদ্ধির কয়েকটি স্তর রয়েছে। অনেক বছরের গবেষণা থেকে জানা গেছে বিশ্বের প্রায় অর্ধেক লোকের আইকিউ ১০০ থেকে ১১০ এর মধ্যে, যেটি একটি স্বাভাবিক অবস্থা। এই আইকিউ ১৩০ এর চেয়ে বেশি হলে মানুষ খুব বুদ্ধিমান হয়। এই ধরনের মানুষের সংখ্যা বিশ্বে ২.৫ শতাংশ। যখন এটি ১৪০ ছাড়িয়ে যায় তখন মানুষ অসীম প্রতিবাধর ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়। বিশ্বে এই ধরনের মেধাবীর সংখ্যা মাত্র ০.৫ শতাংশ। মাইক্রোসফ্টের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস ফিনান্সিয়াল টাইমস-এ উল্লেখ করেন, মেধাবীদের হয়তো প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে অবদান বেশি থাকতে পারে, কিন্তু কোন একটি প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ক্ষেত্রে অতি মেধাবীদের প্রয়োজন হয় না। যেটাই হোক না কেন মেধাশক্তি উন্নয়নের বিকল্প কোন কিছুই হতে পারে না। এখন দরকার আমাদের আগামী প্রজন্মকে কিভাবে বিজ্ঞানসম্মতভাবে মেধাবী করে গড়ে তোলা যায়। কেবলমাত্র বিজ্ঞান নয়, শিক্ষার বহুমাত্রিকতা, দর্শন ও সংস্কৃতির প্রকৃত চর্চার মাধ্যমেও মেধাশক্তি সম্পন্ন শক্তিশালী জাতি গঠনে সকলকে উদ্যোগ নিতে হবে। এজন্য প্রয়োজন সমন্বিত পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন।


    লেখক: শিক্ষক, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর


    /পিবিডি/একে

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close