ভাবনাটা বদলানো দরকার
মানুষের জীবন যেন মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। সময় মানুষকে আনন্দিত করে আবার সময় মানুষকে বেদনার্ত করে। সব দোষ যেন সময়ের। সময়ের ঘাড়ে দোষ চাপানো মানুষের স্বভাব। এই দোষ চাপানোটা এখন আমাদের এক ধরণের কালচার হয়ে গেছে। ভাবটা সবার এরকম আমি একমাত্র পৃথিবীতে মহাপুরুষ, নীতিবান আর সাধু। আর দুনিয়ার সবাই বিপথগামী। আমরা যখন একটা ভুল করে ফেলি তখন একটাই চিন্তা, কিভাবে এই দোষটা অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে নিজেকে বিপদমুক্ত রাখা যায়। কোনো ভালো কিছুর ক্রেডিট নিতে আমাদের মতো ওস্তাদ আর দুনিয়াতে নেই। কিন্তু কাজটা যখন খারাপ হয় তখন একে অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে বেমালুম বিষয়টা থেকে সটকে পড়া আমাদের চিরায়ত স্বভাব। ভালো কাজের ক্রেডিট নিবো আর মন্দ হলে নিজেকে সাধু বানিয়ে অন্যকে চোর বানাবো সেটা তো হয়না। ভালো কাজ করলে বিনীত হতে হয় আর মন্দ কাজ করলে সেটার দায়িত্ব নেবার সাহস থাকতে হয়। কিন্তু সেখানেই আমাদের সাহসের কোনো চিহ্ন নেই বরং এ জাগাটাতে আমরা সবাই একেক জন কাপুরুষ। ভারতের একজন রেলমন্ত্রী ছিলেন। নামটা হয়তো সবাই জানেন। উনার নাম লাল বাহাদুর শাস্ত্রী। কি মনে পড়েছে তো? আপনি তো বলছেন উনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ভুল ভাবেননি একদম ঠিক ভেবেছেন। কিন্তু তিনি কি এতো সহজেই প্রধানমন্ত্রী হতে পেরেছেন? না, এতো সহজ না। উনি যখন রেলমন্ত্রী ছিলেন তখন রেল দুর্ঘটনার দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে নিয়ে পদত্যাগ করেছিলেন। উনি রেলমন্ত্রী, উনি রেল নিয়ে পরিকল্পনা আর উন্নয়ন করবেন। উনি তো রেলগাড়ি চালাবেন না। একদম ঠিক উনি রেল চালাননি। কিন্তু দুর্ঘটনার দায়ভার নেবার সাহস দেখিয়েছেন। যেটা সবাই ভীরুরা পারেনা, বীররাই পারে। মানে নিজে বিনীত হয়েছেন। এতে উনার সুনাম বেড়েছে। সব মানুষের আস্থা আর গ্রহণযোগ্যতার জায়গায় পরিণত হয়েছেন। তার প্রতিদানে তিনি প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর সেই মহতী কথাটা মনে পড়ে গেলো “মহাঅর্জনের জন্য মহত্যাগ দরকার” তার প্রমান লাল বাহাদুর শাস্ত্রী। কেউ ভালো করলে আমরা নাক সিঁটকাই। কিভাবে সেখান থেকে খুঁত বের করে সমালোচনা করা যায় সেটাই যেন মূল বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। ফলে অর্জনটা বিসর্জন হয় আর সমালোচনাটা মানুষের সময় নষ্টের একটা উপাদান হয়ে যায়। ফলে সেখান থেকে শোরগোল আর শোরগোল থেকে গন্ডগোল শুরু হয়। ভালোও করা যাবেনা খারাপও করা যাবেনা। তাহলে মানুষ কি করবে। মোদ্দা কথা কোনোকিছু না করে কিভাবে একজনের অনুপস্থিতিতে তার দুর্নামের বেলুন ফুলিয়ে সেটাকে সবাই মিলে ফাটানো যায় সেটাই যেন মহানন্দের বিষয় হয়ে থমকে যায়। আরেকটা জিনিস মানুষ খুব পারে সেটা হলো নিজেকে বিদ্বান বানিয়ে অন্যকে কিভাবে হেয় করা যায়। যেন দুনিয়ার সব একাই সে বুঝে আর বাকি সবাই অপদার্থ আর মহামূর্খের দল। তার জাদুকরী চতুর কথায় রথী মহারথীরা পর্যন্ত বিভ্রান্ত হয়। মহারথীরা ভাবে একটা হীরকখন্ড তার হাতে এসেছে। এই পরশ পাথর দিয়ে তারা দুনিয়া পাল্টে ফেলবে। না মশাই, এমনটা না ভাবাই ভালো। বরং উল্টোটা হবার সম্ভাবনায় বেশি। কারণ যত গর্জে ততো বর্ষেণা। মানুষকে সম্মান করতে শিখুন। যাকে যতটুকু মর্যাদা দেবার দরকার সেটা দিন। এটাতে কোনো পরাজয় বা গ্লানি নেই বরং আনন্দ আছে। ডক্টর ভীমরাও রামজি আম্বেডকরকে চিনেন। উনি ভারতের সংবিধান প্রণেতা ছিলেন। আরও অনেক কিছু ছিলেন তিনি। যেমন-রাজনৈতিক নেতা, দার্শনিক, চিন্তাবিদ, নৃতত্ত্ববিদ, ঐতিহাসিক, বাগ্মী, বিশিষ্ট লেখক, অর্থনীতিবিদ, পণ্ডিত, সম্পাদক। এ মানুষটাকে একদিন অভিজাত বংশের মানুষেরা অবজ্ঞা করেছিল। মানুষটা যে খুব নিচু বংশের ছিল এজন্য। কিন্তু লেখাপড়ার প্রবল আগ্রহ ছিল। অনেক বাধাবিঘ্ন পেরিয়ে একটা ইস্কুলে পড়ার সুযোগ পেলেন। কিন্তু বড় বংশের মানুষেরা এই নিচু বংশের মানুষটার সাথে বসবেনা। ফলে ইস্কুলের দরজার বাইরে মাটিতে বসে তাকে ক্লাস করতে হতো। পানি পিপাসা যখন লাগতো, কে দেবে তাকে পানি। তাকে পানি দিতে গিয়ে গায়ে যদি ছোয়া লাগে তাহলে তো জাত চলে যাবে। দেখুন, এর সাথে ভাবুনও যে মানুষটাকে সবাই অবহেলা করেছে, সেই মানুষটাই আসল মানুষে পরিণত হয়েছে। ২০১২ সালে হিস্ট্রি টি.ভি. ১৮ আয়োাজিত একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে ভারতীয়দের ভোটের দ্বারা এই লোকটাই শ্রেষ্ঠ ভারতীয় নির্বাচিত হন। আর যারা অবহেলা করেছিল মানুষটাকে তাদের কিন্তু পৃথিবী মনে রাখেনি। এটাই হয়তো প্রকৃতির বিচার। তাহলে মশাই, মানুষকে কখনো অহংকার ধরে রাখার জন্য অবহেলা করবেন না। বরং বিনীত হন মানুষ হিসেবে মানুষকে স্বীকৃতি আর মর্যাদা দিন। কারণ বড় যদি হতে চান ছোট হন তবে। এতেই মঙ্গল। এটাই ইতিবাচক মানসিকতা। এজন্য আমি সব সময় বলি আমাদের নিজেদের পাল্টানো দরকার। যদি নিজেরা না পাল্টায় তবে সমাজ পাল্টাবে না। আর আমরা নিজেদের মানুষ বলার দাবীটুকুও হারাবো।
২.
সম্পর্কিত খবর
লেখক: শিক্ষাবিদ, কলামিষ্ট ও লেখক ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর।
/পিবিডি/একে