• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

মাছ-ভাত জীবনও আমাদের সুখী করেনি!

প্রকাশ:  ২২ মার্চ ২০১৯, ২০:৫০ | আপডেট : ২২ মার্চ ২০১৯, ২০:৫৪
পীর হাবিবুর রহমান

মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী আজন্ম মানুষের মোটা ভাত কাপড়ের জীবন নিশ্চিত করতে লড়াই করেছেন। রাজনৈতিক ইতিহাসে তার নাম অমর হয়ে থাকলেও তার দল ও রাজনীতির করুণ মৃত্যু ঘটেছে। স্বপ্ন পূরণ হতে দেখেননি।

আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার নেতারা যা পারেননি সেটি তিনি সাফ্যল্যের সঙ্গে করে ইতিহাসে মহানায়কের আসনে অমরত্ব পেয়েছেন। তিনি তার দীর্ঘ সংগ্রাম লড়াই ও অমিত সাহসের মধ্যে দিয়ে সূর্যের মতো প্রচন্ড তেজ ছড়িয়ে গোটা জাতিকে এক মোহনায় মিলিত করে স্বাধীকার-স্বাধীনতার পথে প্রবল ঢেউ তুলেছিলেন গণজোয়ারের। গোটা জাতি যে গভীর বিশ্বাস ও আস্থা নিয়ে ব্যালট বিপ্লবে ইস্পাত কঠিন ঐক্য গড়ে তাকে অবিসংবাদিত নেতাই পরিণত করেছিল তিনি তার মর্যাদা রেখেছিলেন ফাঁসি মঞ্চে স্বাধীন বাংলার গান গেয়ে। আমাদের স্বাধীনতা দিয়েছিলেন রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে। তিনিও সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখে মানুষের অন্ন বস্ত্র শিক্ষা চিকিৎসা ও বাসস্থানের নিরাপদ জীবনের দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন। মানুষের মুখে দু’বেলা অন্ন দিয়ে হাসি ফোটাতে চেয়েছিলেন। ‘৭৫ এর ১৫ আগষ্ট বিশ্ব মোড়লদের নীল নকশায় এদেশের বিশ্বাস ঘাতক একদল খুনি পরিবার-পরিজনসহ তাকে হত্যা করার মধ্যদিয়ে সেই স্বপ্নকেই হত্যা করেছিল।

সম্পর্কিত খবর

    আমাদের গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আজীবন গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার লড়াই করেছেন। কৃষকের বন্ধু বাংলার বাঘ শের-ই-বাংলা ফজলুল হকও গরীবের ভাগ্যের উন্নতি চেয়েছেন। মুজিব নগর সরকারের অন্যতম উপদেষ্টা কুঁড়েঘড়ের অধ্যাপক মোজাফফর আহমদও আজীবন মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য সমাজতন্ত্রের সংগ্রাম করে গেছেন। সংগ্রাম করেছেন কমিউনিস্ট পার্টির কমরেড মনি সিং থেকে অসংখ্য বাপন্থি রাজনীতিবিদ। অনেকের মৃত্যু হয়েছে। হয়েছে তাদের স্বপ্নের। অনেকের দলেরও মৃত্যু হয়েছে। সমাজতন্ত্র আর প্রতিষ্ঠা হয়নি।

    আজীবন এদেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দীর্ঘ সংগ্রামের পথে গণতন্ত্রের সংগ্রামে স্বাধীনতা অর্জন করলেও সেই গণতন্ত্র আজও সোনার হরিন! সামরিক শাসন কবলিত বাংলাদেশে মুজিব কন্যা শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের মতো ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব দিয়ে দীর্ঘ পোড়খাওয়া সংগ্রামে গনতন্ত্রের লড়াই করেছেন। ভোট ও ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করেছেন। কন্টকাকীর্ণ পথের সংগ্রামে পায়ে পায়ে তার মৃত্যু হেটেছে। তিনি দমেননি। একই সময়ে সামরিক শাসক জেনারেল জিয়ার বন্দুকের উৎস মুখ থেকে জন্ম নেওয়া বিএনপি ক্ষমতাচ্যুত হলে দলের হাল ধরেন বেগম খালেদা জিয়া। গণতন্ত্রের সেই সংগ্রামে তিনিও নেতৃত্ব দিয়েছেন সাহসীকতার সঙ্গে। গণতন্ত্রের নবযাত্রায় দুই নেত্রীর নেতৃত্বে মানুষের ভোটাধিকারের মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদল ঘটেছে। দেশ সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় ফিরে এলেও গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রুপ পায়নি। মাঝপথে বিএনপি-জামাত শাসনামলে একুশের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা রাজনৈতিক সমঝোতার সংস্কৃতিকে কবর দিয়েছে। বিএনপি নেত্রী বেমগ খালেদা জিয়া দুর্নীতি মামলায় রায়ে এখন কারাগারে। বিএনপি এখন কঠিন দুঃসময়ের মুখে।

    অন্যদিকে মুজিব কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা এখন টানা তৃতীয়বারের মতো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়। বঙ্গবন্ধু কন্য্ াশেখ হাসিনা এখন চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থেকে তিনি বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে গতিময়তার সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছেন। তার নেতৃত্বে অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাংলাদেশ এখন পৃথিবীর কাছে বিস্ময়কর অবস্থানে। সন্ত্রাসবাদ জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাফল্যের মুকুট মাথায় পরেছেন। উন্নয়নের মহাসড়কে দেশকে তুলে দিয়ে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মযজ্ঞের বিপ্লব ঘটিয়েছেন। তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লব দেশকে এগিয়েছে। মানুষের মাথাপিছূ আয় রেকর্ড গড়েছে।

    বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ডাল-ভাতের নিশ্চয়তা দিতে চেয়েছিলেন। তার শেষ শাসনামল ব্যাপক দুর্নীতি রাজনৈতিক হত্যাকান্ড ও বোমা সন্ত্রাসে কলংকিত হয়েছে। মুজিব কন্যা শেখ হাসিনা মাছ-ভাত জীবন দিতে চেয়েছিলেন। সেই জীবন মানুষও পেয়েছে। মওলানা ভাসানী মোটা ভাত কাপড় দিতে না পারলেও শেখ হাসিনা দেশের পোশাক শিল্পের বিপ্লবে এবং কৃষির উন্নয়ন ও মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়িয়ে ভাল ভাত কাপড়ের জীবন দিয়েছেন। কিন্তু গণতন্ত্র এখনো সোনার হরিন। নির্বাচনের প্রতি মানুষের আকর্ষনহীনতা ও ভোটাধিকার নিয়ে চারদিকে চলছে হাহাকার রব। সেই গৌরবের রাজনীতির ঐতিহ্য মূল্যবোধ হারিয়ে দেশে রাজদুর্নীতির প্রসার ঘটেছে। সমাজে শোষন বৈষম্য বাড়ছে। মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় ঘটেছে। একদিকে ব্যাপক জনসংখ্যা অন্যদিকে সীমিত সম্পদ নিয়ে সমস্যা সমাধানের লড়াই চলছে।

    জঙ্গিবাদ সন্ত্রাসবাদের লড়াইয়ে বিজয়ের পর শেখ হাসিনা মাদকের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়েছেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে এবার নতুন সংগ্রামের ডাক দিয়েছেন। জনগন এসবে তার সঙ্গে রয়েছে। কিন্তু দিনের পর দিন যুগের পর যুগ দুর্নীতি স্বজনপ্রীতি সমাজে যেখানে সকল স্তরে ক্যান্সারের মতো ছড়িয়েছে সেখানে এ লড়াই কঠিন লড়াই। সুশাসন ও গণতান্ত্রিক শাসন ব্যাবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক রুপ এবং গ্রহনযোগ্য নির্বাচন ও শক্তিশালী স্বাধীন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান গুলো দেখা মানুষের অন্তহীন আকুতি।

    এই পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের জরিপে বাংলাদেশ আজ অসুখী দেশের তালিকায় শীর্ষে। আগের ১৫৬টি দেশের মধ্যে ১১৫তম আর এবার হয়েছে ১২৫তম। দেশে এতো উন্নয়ন তবু কেন দেশ আজ এতো অসুখী? সমাজে সেই সাদাকালো যুগের আদর্শিক রাজনীতি নির্বাসিত। নির্বাসিত সামাজিক মূল্যবোধ।

    একটা অস্থির অশান্ত সময় সবাই যে যেভাবেই পারুক রাতারাতি ক্ষমতাবান না হয় বিত্তবান হবার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। আত্মমর্যাদাবোধ হারিয়ে ব্যক্তিত্ব ও চারিত্রিক নৈতিক শক্তি হারিয়ে অর্থ ও ক্ষমতার কাছে দাসত্ব বরণের অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে। মানুষে মানুষে পারষ্পরিক শ্রদ্ধা মায়ামমতা আস্থা ও বিশ্বাস হারিয়ে লোভ-লালসা সেখানে আগ্রাসী হয়ে উঠেছে। দুর্বলের ওপর সবলের জুলুম অত্যাচার বেড়েই চলেছে।

    সংবিধান ও আইন লঙ্ঘন ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। রাজনীতি সমাজ খাবার শিক্ষা চিকিৎসা সবখানে ভেজাল আর ফরমালিনের আগ্রাসন। সড়ক শৃংখলা ভেঙ্গে যাওয়া, মৃত্যুকে সাথে নিয়ে পথ হাটা রাজধানীর নগরী বিষের বাতাসে ভারি। বসবাসের অনুপযোগী। যানজটে স্থবির হয়ে যাচ্ছে নগর জনপথ। অস্থির অশান্ত মূল্যবোধহীন লোভের সমাজ এতটাই মানুষকে তাড়িত করছে যে, ব্যক্তি জীবনেও তার প্রভাব পড়ছে। প্রেম ভালবাসা স্বার্থের কাছে নিয়ত বলি হচ্ছে। মূল্যবোধহীনতার কাছে ভেঙ্গে পড়ছে। ঘুষ-দুর্নীতির সঙ্গে মাদক বিষাক্ত করে দিচ্ছে একেকটি সংসার।

    সেই সাদাকালো সময়ের রাজনীতি ও সমাজই নির্বাসিত হয়নি ধর্মীয় সম্প্রীতিও বিনষ্ট হয়েছে। বিশ্ব রাজনীতিতে বর্ণবাদের ভয়াবহতার পথ ধরে উঠে এসেছে ধমান্ধতার বিষাক্ততা। এখানেও তার ঢেউ লেগেছে। সবমিলিয়ে মানুষের মন থেকে আনন্দ সুখ কেড়ে নিয়েছে অস্থিরতা। গোটা সমাজ আবেগ অনুভূতি এককথায় বোধহীন হয়ে গেছে। অসহনীয় অনেক কিছুই সইতে সইতে মানুষ ও সমাজ প্রানহীন হয়ে যাচ্ছে। প্রকৃতিতে পরিবর্তন আসে। বসন্তের কোকিলের ডাক কারো হৃদয়কে স্পর্শ করে না। ভরা পূর্ণিমার প্লাবিত জোছনা বুকের গহীন থেকে বেদনা জাগিয়ে আনে। আনন্দ দেয় না।

    বর্ষা আসে বর্ষা যায় প্রকৃতি যৌবন লাভ করলেও মানুষের চিত্ত প্রফুল্ল হয় না। এই জীবনে আজ তাই মাছ-ভাত জীবনও মানুষকে সুখী করেনি।


    লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close