মঙ্গল শোভাযাত্রায় মাথা উঁচু করে চলার প্রত্যয়
পুরনো বছরের জীর্ণতা-শীর্ণতাকে ঝেড়ে ফেলে নতুনের আবাহনে বছর ঘুরে আবার এলো সেই রাঙাপ্রভাত, পহেলা বৈশাখ, বাংলা নববর্ষ।
সম্পর্কিত খবর
বর্ষবরণের অন্যতম অনুষঙ্গ মঙ্গল শোভাযাত্রা। ‘মস্তক তুলিতে দাও অনন্ত আকাশে’ প্রতিপাদ্যে ১৪২৬ সনের নতুন বছরের সম্ভাবনা আর সমৃদ্ধিতে স্বাগত জানাতে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বিভিন্ন বয়সী মানুষের ঢল নামে এই মঙ্গল শোভাযাত্রায়।
পহেলা বৈশাখ (১৪ এপ্রিল, রোববার) সকাল ৯টায় চারুকলার সামনে থেকে শুরু হয়ে শাহবাগ মোড় ঘুরে শিশুপার্কের সামনে দিয়ে আবার চারুকলায় এসে শেষ হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা।
শোভাযাত্রায় আবহমান বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের প্রতীকী উপস্থাপনের নানা বিষয় স্থান পেয়েছে। অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রাণের উৎসব বর্ষবরণ। বাংলা নববর্ষ বরণে বাঙালির নানা আয়োজনের মধ্যে মঙ্গল শোভাযাত্রা অন্যতম।
বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রার ৩০ বছর পূর্তি হলো এ বছর। এবারের শোভাযাত্রার স্লোগানটি কবিগুরুর ‘নৈবেদ্য’ কাব্যগ্রন্থ থেকে নেয়া।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান শোভাযাত্রার উদ্বোধন করেন।
এসময় তিনি বলেন, মঙ্গল শোভাযাত্রা এখন শুধু আমাদের জাতীয় উৎসব নয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। এর একটি সম্মোহনি শক্তি আছে। মানবিক মূল্যবোধ বিকাশের এটি একটি পথ। সেকারণে শোভাযাত্রা সব সময় চলমান থাকবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন স্তরের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেন শোভাযাত্রায়। শোভাযাত্রা উপলক্ষে কঠোর নিরাপত্তার চাদরে মোড়ানো ছিল পুরো এলাকা।
শোভাযাত্রায় নিরাপত্তার কড়াকড়ি থাকলেও তারুণ্যের উচ্ছ্বাসের কাছে হার মানে সবকিছুই। ঢাক-ঢোলের বাদ্যের তালে তালে তরুণ-তরুণীদের নৃত্য, হৈ-হুল্লোড় আর আনন্দ উল্লাস মাতিয়ে রেখেছিল পুরো শোভাযাত্রা।
২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে জাতিসংঘের সংস্থা ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে চালু হওয়া এ মঙ্গল শোভাযাত্রা।
শোভাযাত্রা উপলক্ষে সকাল থেকেই টিএসসি, দোয়েল চত্বর, শাহবাগ ও এর আশপাশের এলাকায় মানুষ জড়ো হতে থাকে। নয়টার মধ্যেই পুরো এলাকা লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। লাল-সাদা পোশাকে উচ্ছল নারীদের মাথায় শোভা পায় নানান রঙ্গের ফুলের টায়রা। তরুণদের পরনে ছিল লাল-সাদা পাঞ্জাবি।
শোভাযাত্রা ঘিরে ছিল কয়েক স্তরের নিরাপত্তা। পুলিশ, র্যাবের সঙ্গে ছিল সোয়াত সদস্যরা। সাদা পোশাকে গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরাও তৎপর ছিলেন।
এবারের শোভাযাত্রার শিল্প-কাঠামোগুলোর একটিতে বাঘের মুখ থেকে কাঁটা তোলার চিরায়ত গল্পটি উপস্থাপিত হয়েছে বাঘ ও বকের অনুষঙ্গে। ছিল মঙ্গলের বারতা পেঁচা। সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে ছিল ছাগলের কাঠামো। এ ছাড়া ছিল দুই মাথা ঘোড়া, দুই পাখি ও কাঠঠোকরা। শোভাযাত্রায় আরও ছিল মা ও শিশু এবং বাঘের মুখোশ, টেপাপুতুল, রাজা-রানির মুখোশ, সূর্য ইত্যাদি।
পথিমধ্যে কেউ মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নিতে পারেননি। কারণ চতুর্দিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয়ে মানবপ্রাচীর গঠন করা হয়। গতবারের মতো এবারও মুখোশ ব্যবহার ও ভুভুজেলা বাজানো নিষিদ্ধ ছিল শোভাযাত্রায়। নিরাপত্তার জন্য বন্ধ রাখা হয় রমনা পার্ক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ আশপাশের এলাকা ও কেন্দ্রীয় রাস্তা।
বাঙালির প্রাণের উৎসব পয়লা বৈশাখের অপরিহার্য অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে মঙ্গল শোভাযাত্রা। মিলেছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে ১৯৮৯ সাল থেকে শুরু হয়েছিল মঙ্গল শোভাযাত্রা।
শুরু থেকেই চারুকলার শোভাযাত্রাটির নাম ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ ছিল না। তখন এর নাম ছিল ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’। ১৯৯৬ সালে এর নাম হয় ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’।
বর্ষবরণ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রা চারুকলায় ১৯৮৯ সালে শুরু হলেও এর ইতিহাস আরও কয়েক বছরের পুরনো। ১৯৮৫ বা ১৯৮৬ সালে চারুপীঠ নামের একটি প্রতিষ্ঠান যশোরে প্রথমবারের মতো নববর্ষ উপলক্ষে আনন্দ শোভযাত্রার আয়োজন করে।
যশোরের সেই শোভাযাত্রায় ছিল পাপেট, বাঘের প্রতিকৃতি, পুরনো বাদ্যসহ আরও অনেক শিল্পকর্ম। শুরুর বছরেই যশোরে সেই শোভাযাত্রা আলোড়ন সৃষ্টি করে।
পিবিডি/জিএম