‘টাকা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া যায়, জানা ছিল না’
কুষ্টিয়া'র ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে'র কয়েকজন শিক্ষক'কে শাস্তি দেয়া হয়েছে।
এর মাঝে কয়েকজন'কে শাস্তি দেয়া হয়েছে-অর্থের বিনিময়ে শিক্ষক নিয়োগ বাণিজ্যে সরাসরি জড়িত থাকার জন্য।
সম্পর্কিত খবর
এই বিশ্ববিদ্যালয়'টি নিয়ে আমার নিজস্ব কিছু অভিজ্ঞতা আছে।
আমার খুব কাছের একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়ে ঢাকার একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছে, আমি নিজেও সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতাম তখন।
আমাদের মাঝে চমৎকার বন্ধুত্ব।
তার বাড়ি কুষ্টিয়া। তিনি চাচ্ছিলেন কুষ্টিয়া'য় বাবা-মা'র কাছাকাছি থেকে কোথাও চাকরী করতে।
তিনি কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করলেন লেকচারার পদে।
তখন বিশ্ববিদ্যালয় গুলো সম্পর্কে আমার যা ধারণা ছিল সেটা হচ্ছে- শিক্ষক হতে হলে নেটওয়ার্ক থাকা লাগে, শিক্ষকদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকতে হয়, তাদের তেল দিয়ে বেড়াতে হয় কিংবা বাজার! সেই সঙ্গে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা থাকার দরকার আছে।
কুষ্টিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে'র সেই সময়কার প্রো-ভিসি'কে আমি চিনতাম।
আমি এর আগে কখনো কুষ্টিয়া যাইনি। সিদ্ধান্ত নিলাম আমার সহকর্মী যখন ইন্টার্ভিউ দিতে যাবে, আমি তার সঙ্গে যাবো, তাহলে কুষ্টিয়া জেলা'টা ঘুরে আসা হবে।
যাবার আগে ওই প্রো-ভিসি'কে ফোন দিয়ে বললাম,
-আমি কুষ্টিয়া যাচ্ছি ঘুরতে। আপনার সঙ্গে দেখা হলে মন্দ হয় না।
তো গেলাম কুষ্টিয়াতে।
আমার সহকর্মী লেকচারার পদে আবেদন করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গোল্ড মেডেল পাওয়া, ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হওয়া কেউ একজন সেখানে আবেদন করেছে; আমি ভেবে রেখেছিলাম- এতে বরং বিশ্ববিদ্যালয়টির'ই আনন্দিত হওয়া উচিত। কারন এমন রেজাল্টধারী কেউ সাধারণ অর্থে সেখানে যাবার কথা না। স্রেফ কুষ্টিয়া বাড়ি বলে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সেখানে যাবেন।
ইন্টার্ভিউ'র জন্য বাইরে অন্যান্য প্রার্থী'রা অপেক্ষা করছেন, আমি আমার সহকর্মী বন্ধু'র সঙ্গে গিয়েছি। আমরাও অপেক্ষা করছি।
তো, যারা শিক্ষক হবার জন্য আবেদন করেছেন সেখানে; এরা একজন আরেকজনের সঙ্গে কথা বলছেন। কথা গুলো'র ধরণ অনেকটা এমনঃ
-আপনি কতো টাকা দিয়েছেন?
-কাকে দিয়েছেন টাকা?
-আপনার নিশ্চয়তা কতো ভাগ?
-না হলে কি টাকা ফিরত দিবে? কোন শর্তে টাকা দিয়েছেন?আমি বুঝতে পারছিলাম না- আমি কি বাজারে আছি নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ে!
এরা এমন ভাবে কথা বলছিল, আমি মোটামুটি বুঝতে পারছিলাম এটা খুব স্বাভাবিক প্র্যাকটিস সেখানে! এই ধরনের কথা কেউ এতো প্রকাশ্যে বলে বেড়ানো'র কথা না। অথচ তারা বলে বেড়াচ্ছে!
আমার চোখ রীতিমত কপালে উঠার যোগার। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক যে টাকা দিয়ে হওয়া যায় এটা আমার এর আগ পর্যন্ত জানা ছিল না। আমি জানতাম- শিক্ষকদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক, রাজনীতি ইত্যাদি'র মাধ্যমে হয়ত সম্ভব।
তো, ইন্টার্ভিউ শেষে গেলাম আমার ওই সহকর্মী বন্ধু'র এলাকায়। সেখানে তার পাড়ার পরিচিত একজন তাকে জিজ্ঞেস করছে
-কেন এসেছ কুষ্টিয়ায়?
মানে, অনেকদিন পর পরিচিত কারো সঙ্গে দেখা হলে লোকজন যেমন জিজ্ঞেস করে। তো আমার বন্ধু বললেন
-ইন্টার্ভিউ দিয়ে এসছি কুষ্টিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে।
সঙ্গে সঙ্গে ওপাশের ভদ্রলোক বললেন
-কাকে ধরেছ? কতো টাকা দিয়েছ?
আমার চোখ আবার কপালে উঠার যোগার! বুঝতে পারলাম ওই পুরো এলাকাতে'ই এটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার।
আমি পরের দিন গেলাম প্রো-ভিসি'র সঙ্গে দেখা করতে। যেহেতু তার সঙ্গে আমার আগে থেকে'ই চেনা-জানা আছে, তাই আমি তাকে নিঃসঙ্কোচে জিজ্ঞেস করলাম
-এই যে সবাই টাকা টাকা করছে শিক্ষক হবার জন্য, আপনারা এর কিছু করছেন না কেন?
তিনি আমার কথা শুনে এমন একটা হাসি দিলেন-যেন ব্যাপারটা খুব স্বাভাবিক! আমি আর এই নিয়ে কিছু বলিনি।
তো এই বিশ্ববিদ্যালয়'টি গত পরশু তাদের কয়েকজন শিক্ষক'কে শাস্তি দিয়েছে। কাউকে দিয়েছে অনুপস্থিত থাকার কারণে, কাউকে দিয়েছে টাকা নিয়ে নিয়োগ বাণিজ্যে'র কারণে।
অবাক কাণ্ড হচ্ছে, যারা টাকা দিয়ে শিক্ষক হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই; নেই কোন শাস্তি'র ব্যবস্থা!
তাহলে যারা টাকা দিয়ে নিয়োগ পেয়েছেন, তারা কী এভাবে পড়াতে'ই থাকবে?
এমন নীতি-নৈতিকতা নিয়ে এরা কি করে ছাত্রদের পড়াবে?
আর ছাত্র'রাই বা এদের কাছ থেকে কি শিখবে? ছাত্ররা কি এমন শিক্ষকদের আদৌ কখনো সম্মান করতে পারবে?
আপনারা এদের শাস্তি দিলেন না, শাস্তি দিলেন শুধু অল্প কয়েকজন শিক্ষক'কে; যেখানে কিনা পুরো বিশ্ববিদ্যালয়টি'র অনেকে'ই হয়ত জড়িত।
মানে আর কিছু'ই না। ভাগ-বাটোয়ারা। আপনাদের ভাগে কম পড়েছে, আর যারা শাস্তি পেয়েছে, তারা হয়ত ভাগে বেশি পেয়ে গিয়েছিল, এই জন্য আপনারা সবাই মিলে শাস্তি দিয়েছেন কেবল তাদের!
এই হচ্ছে আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলো'র শিক্ষক এবং শিক্ষা ব্যবস্থা!
আর শিক্ষকদের অনুপস্থিতি? শুনলাম দুই- একজন শিক্ষক'কে শাস্তি দিয়েছে এই জন্য।
অথচ এই কাল'ই না পত্রিকায় পড়লাম দেশের অন্তত ৮টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি'রা নিয়মিত তাদের অফিস করেন না। এর মাঝে রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি তো মনে হয় বিশ্ব-রেকর্ড করে ফেলেছেন। বছরের ৩৬৫ দিনের মাঝে তিনি প্রায় ২৫০ দিন'ই নাকি অনুপস্থিত ছিলেন!
অথচ এই ভিসি'কে দিনে-রাতে দেশের নানান টেলিভিশনে'র টক'শোতে দেখা যায়।
এই সব টক'শোতে তিনি আমাদের নীতি-নৈতিকতা শেখান!
একটা সমাজ কতোটা নিচে নেমে গেলে এইসব অনৈতিক মানুষ গুলো আমাদের নীতি-নৈতিকতা শেখায়, সেটাও বোধকরি ভাবার সময় এসছে।
(লেখকের ফেসবুক স্ট্যাটাস)
/পিবিডি/একে