‘এই লোক এত ভালো কেন?’
সৈয়দ আশরাফ আমার এলাকার সংসদ সদস্য ছিলেন। অথচ হওয়ার কথা ছিল ব্রিটেনের লেবার পার্টির এম পি।
'৯৬ সালে উনাকে দেশে ফিরিয়ে আনেন শেখ হাসিনা।
সম্পর্কিত খবর
তারপর একাধারে ২২ বছর পার্লামেন্টারিয়ান।
এক মেয়াদে প্রতিমন্ত্রী, দুই মেয়াদে মন্ত্রী।
আপাদমস্তক বই পড়ুয়া, প্রযুক্তিপ্রেমী আর কর্মী বান্ধব লোক ছিলেন উনি। যে ওয়েস্ট মিনিস্টার ডেমোক্রেসির তিনি ভক্ত ছিলেন। সম্পূর্ণ পারেন নি।
তার ন্যুনতম চর্চা হলেও তিনি করে গেছেন।
দলের সাধারণ সম্পাদক থাকার সময়ে। কাজ ভাগ করে দিয়েছিলেন, ৩ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের হাতে।
স্পষ্ট করে বলে দিয়েছিলেন- ক্যামেরবাজির বাইরেও সেক্রেটারির কাজ থাকে। বাকী ৩ জন কেন আছে?
---
সৈয়দ আশরাফ কেমন সৎ। তিন মেয়াদে মন্ত্রী থাকার পরেও তার কেন সম্পদ কমেছে। এসব তার হলফ-নামাই বলে!তার সবচে' বড় পরিচয় উনি একজন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা। রাষ্ট্রপতির ছেলে হয়েও রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছেন। ইন্ডিয়ার জেনারেল উবান একাত্তর নিয়ে তার বইয়ে- যে সাদামাটা, শান্ত আর বুদ্ধিদীপ্ত তরুণ যোদ্ধা আশরাফের কথা বলেছিলেন।
তিনি ছিলেন আমাদের এই সৈয়দ আশরাফ।
যুদ্ধকালীন রাষ্ট্রপতির ছেলে হয়েও, যিনি শুকনো রুটি খেয়ে; যুদ্ধ করেছেন, স্টেনগান হাতে মাটিতে বুকে ভর দিয়ে।
সেই সৈয়দ আশরাফ '৭৫ এর ৩ নভেম্বর পিতার মৃত্যুর পর বিলাতে চলে গিয়েছিলেন। সেখানে লেবার পার্টির সাথে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন।
শেখ হাসিনার নির্দেশে এমন এক এলাকায় নৌকার জয় ফিরিয়ে এনেছিলেন। যার রানিং এম পি ছিল আল বদর তাত্ত্বিক আতাউর রহমান খান। যে খালেদা জিয়াকেও পরোয়া করতো না।
তারপর, সৈয়দ আশরাফ ৯৬- এ বিমান প্রতিমন্ত্রী হয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের হাল ধরেছিলেন ওয়ান ইলেভেনের পর।
শেখ রেহানার স্বামী ডক্টর শফিক সিদ্দিকী তার এক লেখায় বলেছিলেন- কিভাবে বিপর্যস্ত জিল্লুর রহমান শেখ রেহানাকে দিয়ে অনুরোধ করিয়ে সৈয়দ আশরাফকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হতে অনুরোধ করেছিলেন।
সেই দিন, এই দুইজনের জন্য বেঁচে গিয়েছিল আওয়ামী লীগ।
তারপর, সেই সৈয়দ আশরাফ, কেমন করে ৫ মে দেশে জেহাদী বিপ্লব থেকে ঢাকা শহরকে বাঁচিয়েছিলেন।
উনি কেমন সৎ, উনার পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি; কেমন সজ্জন- এগুলো নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। জানাশোনা হচ্ছে। এই ফাঁকে আমি আরও দুইটা তথ্য দিই।
ক)
‘আমি হিন্দুও নই, মুসলিমও নই’- সৈয়দ আশরাফের খন্ডিত একটা বক্তব্য।
যেটা ২০১১ সালে ছাগুদের সোনার বাংলা ব্লগে বিকৃত আকারে এসেছিল। দুই বছর পর, ২০১৩ সালে ৫ মে উনার সাহসিকতায় গুটিয়ে যাওয়ারপর হেফাজত; ওই বক্তব্যটা লুফে নেয় উনাকে ব্লেইম দিতে।পুরো ঘটনাটা হচ্ছে- ২০১১ সালে সরকারি বাসভবন পদ্মায়। ওইদিন ১১টি ইসলামী দলের নেতৃত্বে হরতাল পালিত হয়েছিল। সংবিধানে ‘রাষ্ট্র্বধর্ম’ থাকার বিষয়ে।
ওইদিন দেশের সব পত্রিকার সম্পাদকদের সাথে বৈঠকে সৈয়দ আশরাফ বলেছিলেন-
"কমিটি যদিও রাখতে চাইছে; কিন্তু উনি ছাড়াও সংবিধান সংশোধন কমিটির কয়েকজন সদস্য এই রাষ্ট্রধর্ম রাখার বিরুদ্ধে।
‘সংবিধান তো দেশের সব নাগরিকদের জন্য। সংবিধান যখন পড়বো। তখন আমি হিন্দুও না, আমি মুসলিমও না। আমি দেশের নাগরিক হিসেবে এটা পড়বো, এইটা মান্য করবো’।
এটাই ছিল তার বক্তব্য। এটাকেই মাঝামাঝিতে বিকৃত করা হচ্ছে। ছাগুরা যে একটা মৃত মানুষের নামে বিকৃত করে কুৎসা রটাচ্ছে। এদের কি মরণের ভয় নাই? মিথ্যাচারের জন্য?
আর সৈয়দ আশরাফ ছিলেন আপাদমস্তকঃ অসাম্প্রাদায়িক একজন লোক। ধর্মের কাসুন্দী পেঁচিয়ে যদি কাউকে বিতর্কিত করতে হয়, তাহলে ইয়াবা বদির ওয়াজ শুনে গলে যায় না কেন ছাগুরা?
খ) সৈয়দ আশরাফের সর্বশেষ কর্মস্থল জনপ্রশাসন মন্ত্রনালয়ে থাকার সময়ে একটা কাহিনী শেয়ার করি। ২০১৬ সালে, প্রায় অনেক পত্রিকায় এসেছিল।
সরকার রাজনৈতিক বিবেচনায় ৭৩ জন যুগ্ম সচিবকে পদোন্নতি দেয়। ২১ জনকে গোয়েন্দা ক্লিয়ারেন্স নেই, এই অভিযোগে দলীয় বিবেচনায় প্রমোশন বঞ্চিত রাখে। সোজা কথা, সরকার যাদের মনে করেছে আনুগত্য নাই, ‘ হার্ডকোর লীগার, 'সহমত ভাই’ না। তাদের প্রমোশন আটকে দেয়া হয়!
দেশে ফিরে এই অনিয়মের কথা শুনেন। সবার প্রমোশনে সাইন করা থেকে বিরত থাকেন সৈয়দ আশরাফ।
প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রশাসন উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের নির্দেশে, এস এস বি নামের একটা রেগুলার সুপিয়র কমিটি এটা করেছে। তা জানার পরেও, সৈয়দ আশরাফ নিজের আপত্তি দেন।
এবং বলেন- প্রমোশনের ক্ষেত্রে একটা পরিচ্ছন্ন সার্ভিস রুল উনি উনার মন্ত্রনালয়ে চালু করবেন। কোন অনিয়ম, পক্ষপাতিত্ব বরদাশত করবেন না।
তারপর বাদ পড়া এবং অনিয়মের শিকার সবাই প্রমোশন পান, সৈয়দ আশরাফের সততার কল্যাণেই।
আমার এক ক্লোজ সিনিয়রের বাপ-ই, এটার ভুক্তভোগী ছিলেন। উনার নিউজটাও এসেছিল বিভিন্ন পত্রিকায়।
অই সিনিয়র বলছিল- এই লোক এত ভালো কেন রে?
--
সৈয়দ আশরাফের মৃত্যুর পর এই একটা কথা-ই সম্ভবতঃ মনে হচ্ছে। 'এই লোক এত ভালো কেন?'
এমনকি, কিশোরগঞ্জে উনার বিরোধী দলের লোকজনও অশ্রসজল হচ্ছেন।
সবার ভালোবাসা পেয়ে। ডান, বাম, লীগ- সুস্থ বিবেকবোধ সম্পন্ন সবার শ্রদ্ধা নিয়ে মরে যাওয়া সহজ অর্জন নয়।সৈয়দ আশরাফ এটা করতে পেরেছিলেন। শত বছরেও এমন একজন রাজনীতিবিদ এই ভূখন্ডে আসেন না।
(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)
/পিবিডি/আরাফাত