বিরোধী দল নির্ধারণ করার মালিক আ'লীগ নয়
ক্ষমতাসীন দলের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটভুক্ত শরিক দল জাসদের একাংশের সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেছেন, বিরোধী দলের আসনে কে বসবে আর কে বসবে না, এটা নির্ধারণ করার এখতিয়ার বা মালিক আওয়ামী লীগ এবং অন্য কেউ নয়। এই সিদ্ধান্ত স্ব স্ব দল গ্রহণ করবে।
একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর নতুন গঠিত মন্ত্রিসভায় জায়গা না পাওয়া কুষ্টিয়া-২ আসন থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ও সাবেক এই মন্ত্রী বলেন, কেউ যদি সরকারের নির্দেশে বিরোধী দল হয়, তাকে আমি এককথায় বলবো, ফরমায়েশি বিরোধী দল। ১৪ দলীয় জোটের শরিক হিসেবে ছিলাম, এখনও আছি। আমি রাজনৈতিক কারণে ১৪ দলীয় জোট থাকার প্রয়োজনীয়তা মনে করছি। সাম্প্রদায়িক, জঙ্গিবাদ ও রাজাকাররা এখনও আত্মসমর্থন করেনি, তওবা করেনি। তারা রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা হলেও তারা চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের পথ পরিহার করেনি। সুতারাং জোটের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। আমরা জোটগতভাবে ভোট করেছি এবং সংসদে জোটবদ্ধ থাকবো। এর বাইরে আওয়ামী লীগ যদি অন্য কোনও সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে আমরা জোটের শরিকরা বসে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবো।
সম্পর্কিত খবর
সমসাময়িক রাজনীতি, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ১৪ দলীয় জোট এবং বঙ্গবন্ধুর হত্যায় জাসদের ভূমিকা, মন্ত্রিত্ব পাওয়া, না-পাওয়া নিয়ে রবিবার (৩ ফেব্রুয়ারি) গণমাধ্যম বাংলা ট্রিবিউনকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে হাসানুল হক ইনু এসব কথা বলেন।
বঙ্গবন্ধুর হত্যার পথ জাসদ তৈরি করেছিল আওয়ামী লীগের অনেক নেতার এমন অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের কতিপয় নেতা-নেত্রী বঙ্গবন্ধুর হত্যা নিয়ে অবান্তর কথা বলেন, তথ্য ছাড়া কথা বলেন। জাসদ ও আওয়ামী লীগের ঐক্যটা চুলচেরা বিশ্লেষণের পরেই শেখ হাসিনা একসঙ্গে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে। এই দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়ায় বাদী এবং বিবাদী কেউ জাসদ সম্পর্কে একটি শব্দও উচ্চারণ করেনি। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী ও নেপথ্যের নায়ক কারা, সেটা সবাই জানেন। সুতারাং দৃশ্যমান হত্যাকারীদের আমরা দেখেছি। নেপথ্যের নায়ক খন্দকার মোশতাকের বিচার হয়নি। এছাড়া আরও যারা হত্যার নেপথ্যের নায়ক, তাদের ব্যাপারে দেশবাসীর জানা উচিত। তবে হত্যার পরে সুফলভোগী কারা, তাদের তালিকা করা হলে এই নিয়ে গবেষণাও করা যেতে পারে। সেই সুফলভোগীদের তালিকায় জাসদ নেই। বরং ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের হত্যার পরে ১৭ আগস্ট খুনী মোশতাকের বিরুদ্ধে জাসদ মিছিল করে। মোশতাকের ৮৩ দিনের শাসনামলে জাসদের শতাধিক নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়। এর কারণ জাসদ বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের বিরোধিতা করেছিল। পরবর্তীতে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের বিরোধিতা করার কারণে কর্নেল তাহেরসহ জাসদের অনেকে প্রাণ হারান।
বঙ্গবন্ধুর হত্যার পরে ট্যাংকের ওপরে উঠে হাসানুল হক ইনুর উল্লাস করার গুঞ্জন নিয়ে জানতে চাইলে জাসদের এই নেতা বলেন, ফেসবুকে একটা গুজব ছড়ানোর চেষ্টা করে জামায়াত শিবিরের বাঁশের কেল্লা। এখানে প্রথম কথা হচ্ছে ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর হত্যার পরে প্রথম দিন ঢাকা শহরে কেউ উল্লাস করেনি। এই নিয়ে গণমাধ্যমে কোনও রিপোর্ট নেই। ঢাকা শহরেও কোনও সেনাবাহিনীর মুভমেন্ট ছিল না, কেবলমাত্র বঙ্গভবন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, শাহবাগ বেতার কেন্দ্র, রামপুরা টেলিভিশন আর ক্যান্টনমেন্ট কেন্দ্রের বাইরে ট্যাংক মুভমেন্ট ছিল। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পরে ১৫ থেকে ১৮ আগস্ট পর্যন্ত কোনও উল্লাস বা আনন্দ মিছিল হয়নি এবং ট্যাংকের ওপর নাচানাচির ঘটনা তো ঘটেইনি। আর আমি তখন আত্মগোপনে ছিলাম। এছাড়া ’৭২ সালে জাসদের রাজনীতি শুরু থেকে আমি কখনও প্যান্ট-শার্ট পরিনি। ওখানে প্যান্ট-শার্ট পরা একটি লোকের ট্যাংকের ওপরের ছবি আছে। আর এটাকে নিয়ে জামায়াত মিথ্যাচার করছে আওয়ামী লীগ ও জাসদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে।
সাবেক এই তথ্যমন্ত্রী বলেন, এছাড়া ট্যাংক বা সামরিক বাহিনীর ট্রাকের ওপর মানুষের উল্লাস হয়েছিল ৭ নভেম্বর সিপাহী বিপ্লবের পরে। এই ৭ নভেম্বরেও আমার যে বয়স ছিল, তাতে ট্যাংকের ওপর উঠে নাচার মতো বয়স ছিল না। তখন আমি জিয়াউর রহমানের সঙ্গে দেন-দরবারে ব্যস্ত ছিলাম। সুতারাং এই যে ট্যাংকের ওপরে যে ছবিটা দিচ্ছে ৭ নভেম্বরের, এই রকম বহু ছবি আছে। সেগুলো মানুষের ছবি। সাধারণ মানুষেরা ট্যাংকের ওপর উঠে নাচানাচি করেছে। আমরা রাজনৈতিক কারণে বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতা করেছি এবং রাজনৈতিক কারণে ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের বিরোধিতা করেছি। আর যদি বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জাসদ থাকে, শেখ হাসিনা তো বুঝে-শুনে ঐক্য করেছেন আমাদের সঙ্গে। শেখ হাসিনা তো সবকিছুর তথ্য নিয়ে জোট করেছেন।
একাদশ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টসহ সরকারবিরোধী দলগুলো থেকে ওঠা প্রশ্ন নিয়ে মন্তব্যে হাসানুল হক ইনু বলেন, নির্বাচন নির্বাচনি আইনে হয়। নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত-ঐক্যফ্রন্ট অংশগ্রহণ করেছে। নির্বাচনি ব্যবস্থার সন্তুষ্টির পরেই তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নির্বাচনের দিন বিকাল ৪টা পর্যন্ত তারা নির্বাচনে ছিল। ৪০ হাজারের বেশি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে নির্বাচন সংক্রান্ত সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে ২২টি কেন্দ্রে, এটা গণমাধ্যমের রিপোর্ট। বাকি কেন্দ্রেগুলোতে নির্বাচন চলাকালীন বিএনপি ওইসব কেন্দ্রের প্রিজাইডিং বা রিটার্নিং অফিসারের কাছে কোনও লিখিত অভিযোগ দেয়নি। এখন নির্বাচন শেষে যেসব অভিযোগ উত্থাপন করছে, এসব অভিযোগ নিষ্পত্তি করার যে পদ্ধতি আছে, তাতে তারা এখনও কোনও প্রস্তাব দাঁড় করায়নি। বিএনপি একটি নির্বাচন অভিজ্ঞ দল। নির্বাচন চলাকালীন তারা কাগজে-কলমে কোনও অভিযোগ না করে মুখে মুখে ঢালাওভাবে অভিযোগ দিয়েছে। মুখে এই ঢালাও অভিযোগের কোনও অর্থ নেই। আসলে বিএনপি নির্বাচনের ভরাডুবির ব্যর্থতা আড়াল করতে একটা পর একটা অভিযোগের ফিরিস্তি তুলছে।
ইনু দাবি করেন, প্রথম দিন থেকে বিএনপি নির্বাচনের ওপর কোনও মনযোগ দেয়নি। তারা একটি গায়েবি নির্দেশ বা পদক্ষেপের আশায় দিন গুনেছে। তারা প্রার্থী চূড়ান্ত করতে বিলম্ব করেছে এবং মনোনয়ন-বাণিজ্যের আশ্রয় নিয়েছে। এছাড়া বিএনপির অনেক প্রার্থী নির্বাচনি মাঠেই যাননি। ফলে তাদের নির্বাচনের চেয়ে মনোযোগ ছিল চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র ও গায়েবি নির্দেশের দিকে। এ জন্য তারা ঢাকায় বসে টেলিভিশনে পর্দায় গলাবাজি করেছে, কিন্তু নির্বাচনি মাঠে কোনও তৎপরতা চালায়নি। আমরা যদি তদন্ত করে দেখি, ৪০ হাজার কেন্দ্রের মধ্যে বেশির ভাগ কেন্দ্রে তারা এজেন্ট দেয়নি এবং প্রার্থীর উপস্থিতিও ছিল না। বিএনপির শপথ না দেওয়া এবং পুনর্নির্বাচনের দাবি, একটা নতুন চক্রান্তের বীজবপন। বিএনপির বিরাট পরাজয়ের বড় আরেকটি কারণ তারা ২ কোটি ২৫ লাখ ভোটারের ওপর কোনও নজর দেয়নি। নতুন ভোটাররা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। এছাড়া মাঠপর্যায়ের কর্মীদের ওপর তাদের কোনও নিয়ন্ত্রণ ছিল না। ফলে মাঠপর্যায়ের কর্মীরা এলোমেলো হয়ে আমাদের মহাজোটের প্রার্থী-কর্মীদের সঙ্গে মিলেমেশে নৌকার পক্ষে কাজ করেছে। ’৭০ সালের নির্বাচন যেমন মুসলিম লীগের রাজনীতির অবসানের সূত্রপাত হয়, তেমনি এই নির্বাচনটাও, মনে হয়, বিএনপির রাজনীতির যুগের অবসানের সূত্রপাত হলো।
সাবেক এই মন্ত্রী আরও বলেন, এখন কথা হচ্ছে যেই যুক্তিতে আন্দোলনের অংশ হিসেবে বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল, একই যুক্তিতে ঐক্যফ্রন্টের এমপিরা সংসদে যোগ দিতে পারেন। সংসদে থাকুক আর না-থাকুক তাতে তো মাঠের আন্দোলনের হেরফের হচ্ছে না। নিয়মবহির্ভূতভাবে সরকার উৎখাত-উৎখাত খেলার দিন ক্রমাগত শেষ হয়ে যাচ্ছে। সরকারি দল বা বিরোধী— সব দলের এমপিদের তথ্য দিয়ে কথা বলার সংস্কৃতি রপ্ত করতে হবে। সংসদে বসে গলাবাজির দিন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বিএনপি গত ১০ বছরে শক্ত কোনও আন্দোলন বা সমালোচনাও করতে পারেনি, যেহেতু তাদের মন পড়েছিল অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে সরকারের উৎখাত করায়। ফলে তারা তথ্যভিত্তিক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কোনও কথা বলতে পারেনি। ২০০৮ সালের ভোটে তো বিএনপি বিপুলভাবে হেরেছিল। তখন ৩০টি সিট পেয়েছিল। সেই নির্বাচন তো শেখ হাসিনার অধীনে হয়নি।
১৪ দলীয় জোটের শরিকদের মন্ত্রিত্ব না দেওয়ার কারণ ও আবার মন্ত্রিত্ব নেবেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে হাসানুল হক ইনু বলেন, মন্ত্রিসভা যেভাবে গঠিত হয়েছে, তার ব্যাখ্যা একমাত্র খোদ প্রধানমন্ত্রী দিতে পারেন। কেন বাদ দেওয়া হয়েছে! তবে আমি তার প্রাথমিক এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। আমরা জোটে আছি। ফলে পরস্পর পরস্পরকে সহযোগিতা করবো। আর ভবিষ্যত নিয়ে আমি কোনও কথা বলতে চাই না।
জাসদের বারবার ভাঙ্গনের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে দলটির একাংশের এই নেতা বলেন, রাজনৈতিক ও ব্যক্তিস্বার্থের কারণে দলে ভাঙন হয়েছে। দুটি কারণই বিদ্যমান। রাজনৈতিক কারণে বাসদ হয়েছে। মূল কারণ হচ্ছে রাজনীতিকে যখন সামরিক শাসনের হস্তক্ষেপ হতে থাকে তখন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। আওয়ামী লীগের মতো দলকে ২১ বছর লেগেছে ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করতে। আওয়ামী লীগেও ভাঙন হয়েছে। সুতরাং কোনও দলই সামরিক শাসনের হস্তক্ষেপ থেকে রেহাই পায়নি। জাসদেও ভাঙন হয়েছে। তবে যারা জাসদ থেকে গেছে তারা সবাই ব্যক্তিস্বার্থে গেছে।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি কী হবে ও কেমন কেমন হওয়া উচিত জানতে চাইলে হাসানুল হক ইনু বলেন, জঙ্গি, সাম্প্রদায়িকতা থেকে বাংলাদেশকে স্থায়ীভাবে মুক্ত করতে হবে। এই কাজটা এখনও একটু বাকি আছে। ’৭৫-এর পর থেকে একবার রাজাকারের সরকার, আরেকবার মুক্তিযুদ্ধের সরকার, রাজনীতির এই মিউজিক্যাল খেলাটা বন্ধ করার চেষ্টা চলছে। সরকার ও বিরোধী— উভয় দলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি থাকবে। বিএনপি রাজাকার সমর্থিত দল। এই ৫ বছরে যদি বিএনপির রাজনীতির যুগের অবসানটা ঘটানো যায়, তাহলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ সেই রাজনীতির খেলা থেকে বেরিয়ে যাবে। এছাড়া শোষণ ও বৈষম্যমুক্তি তথা সমাজতন্ত্র ছাড়া গণতন্ত্র হচ্ছে পোড়া রুটি।
পিবিডি/আরিফ