• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

জীবন্ত ডায়েরি হেলাল উদ্দিন!

প্রকাশ:  ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১০:১৩
শাহজাহান আলী বিপাশ, ঝিনাইদহ

কোন অফিস বা প্রতিষ্ঠান অথবা কারো বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছেন তিনি। সামনে যদি কোন পত্রিকা থাকে তাহলে তার অভ্যাস কাউকে না বলেই তিনি সেটি ভাজ করে পকেটে ঢুকাবেন। রাস্তায় যদি পেপারের কোন ছেড়া পাতা পড়ে থাকে তাহলে সেটিও তিনি সংগ্রহ করে বাড়ি নিয়ে যাবে। আর রাত হলে বসবেন ডায়েরি নিয়ে। আজকের পেপারে উল্লেখযোগ্য কি কি বিষয় আছে তা তিনি লিপিবদ্ধ করবেন। কোন মনীষী কি বাণী দিয়েছেন সেটি লিখবেন। শুধু তাই নয় তার উপজেলায় আজকে কোন ব্যক্তি মারা গেলে সেটিও তিনি তার ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করবেন।

এই আলোচিত ব্যক্তিটি হলো ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার মহেশ্বচাদা গ্রামের মৃত ফকির আলী মন্ডলের ছেলে কৃষক হেলাল উদ্দিন। ৬৯ বছর বয়সী হেলাল উদ্দিন গত ২৫ বছর ধরে তিনি নতুন পুরাতন পেপার সংগ্রহ আর ৫০টি ডায়েরি লেখার কাজটি করে যাচ্ছেন। জমা হয়েছে তার বাড়িতে কয়েক মন পুরানো পেপার। দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করা হেলাল উদ্দিন বেচে থাকা পর্যন্ত এই কাজটি চালিয়ে যেতে চান।

পেশাই একজন জৈব কৃষক হেলাল উদ্দিন। নানা কারণে তিনি এলাকায় আদর্শক কৃষক হিসেবে পরিচিত। সাদামনের হেলাল উদ্দিন প্রতিনিয়ত বাড়ির পাশের বাজারটি স্বউদ্যোগেই পরিস্কার করা, রাস্তায় পড়ে থাকা পুরানো ছেড়া পেপার সংগ্রহ, রাস্তার পাশে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ লাগিয়ে, আত্মীয় বাড়িতে মিষ্টির পরিবর্তে কিছু কেঁচো উপহার নিয়ে গিয়ে আলোচনায় এসেছেন। পরিবেশ রক্ষায় তিনি পেয়েছেন বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদকও।

মহেশপুর চাদা গ্রামে গিয়ে কথা হয় হেলাল উদ্দিনের সাথে। তার শোবার ঘরে দেখা যায় একটি কাঠের আলমারি। মানুষ আলমারিতে সাধারণত সৌখিন জিনিসপত্র রাখে। কিন্তু হেলাল উদ্দিন রেখেছেন ২৫ বছর ধরে লেখা ডায়েরি আর সংগ্রহকরা পেপারগুলো হেলাল উদ্দিন জানান, কৃষি কাজ করে তিনি সংসার চালান। স্ত্রী মাহিরন নেছা, মেয়ে ও ৩ ছেলে নিয়ে তার সংসার। ছেলে মেয়ে সকলেই বিবাহ হয়েছে। বাবার ছিল মাত্র ৭০ শতাংশ জমি। বড় ভাই দেলবার আলী ১৯৭১ সালে বিনা চিকিৎসায় মারা যান। আরেক ভাই খেলাফত আলীও মারা যান ক্যানসারে। সংসারে অভাব অনাটনের কারণে লেখাপাড়া করতে পরিনি। মাত্র দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার সুযোগ হয়েছে তার।

হেলাল উদ্দিন অকপটে বলেন, আমাকে হেলাল চাচা বলেই কালীগঞ্জ উপজেলাসহ দেশবাসী চেনেন। আমি কাজ পাগল মানুষ। পরিচিতির সুবাদে আমি বিভিন্ন অফিস আদালতে যাই, মানুষের দোকানে বা বাড়িতেও যায়। কিন্তু আমার একটি অভ্যাস আছে পুরানো পেপার দেখলেই আমার মাথায় কাজ করে না। কাউকে না বলেই পেপারটি পকেটে নিয়ে আসি। মাঝে মাঝে নিজেও পেপার কিনি। উদ্দেশ্য একটিই, পেপারে গুরুত্বপুর্ণ কিছু থাকলে সেগুলো নিজের ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করার। রাস্তায় অনেক সময় ছেড়া পেপার পাওয়া যায়। ছেড়া পেপারের কারণে পরিবেশ নষ্ট হয়। আমি সেগুলো দেখলেই কুড়িয়ে বাড়িতে নিয়ে আসি। সেখান থেকে বিভিন্ন তথ্য আমি ডায়েরিতে লিখি।

হেলাল উদ্দিন আরো বলেন, গত ২৫ বছর ধরে আমি ডায়েরি লিখছি। আমার ডায়েরিতে দেশের উল্লেখযোগ্য ঘটনার পাশাপাশি উপজেলার কেউ যদি মারা যান তার মৃত্যুর তারিখটি আমি লিখে রাখি। লোকটি কেমন ছিলো সেটাও আমি ডায়েরিতে লিখি। একজন ভাল ব্যক্তির মৃৃত্যু দিবস তার পরিবারের লোক মনে না রাখলেও আমার ডায়েরিতে লেখা আছে। তিনি বলেন, আমি কখনো ডায়েরি কিনি না। বিভিন্ন অফিস কিংবা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতি বছরই আমাকে ডায়েরি দেয়। সারাদিন কাজ শেষ করে সন্ধ্যায় বাড়িতে বসে কাজ ডায়েরি লেখা। হাতের লেখা বেশি ভাল না হলেও আমি আমার মতো করে লিখি। লিখতে চাই মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। তার সংগ্রহে কয়েক মণ পুরানো পত্রিকা রয়েছে।

কালীগঞ্জের সাংবাদিক তারেক মাহমুদ ও সাবজাল হোসেন জানান, হেলাল উদ্দিন একজন সাদামনের মানুষ। মানুষের সাথে কথা বলেন সব সময় হেসে হেসে। সকলের পরিচিত যেন তিনি। প্রায় বিকালেই তিনি তাদের অফিসে আসেন। যাবার সময় কাউকে না বলেই একদিনের পুরানো পেপার পকেটে ভরে নিয়ে চলে যাবেন। পরবর্তীতে দরকার হলে হেলাল উদ্দিনের কাছে ফোন দিয়ে জানলেই বলবে আমি তো নিয়ে চলে এসেছি। সাংবাদিক সাবজাল হোসেন বলেন, হেলাল উদ্দিনের বক্তব্য পেপার পুরানো হলে তো মানুষ ফেলে দেয় কিংবা বিক্রি করে দেয়। কিন্তু আমার কাছে থাকলে এগুলো যত্নে থাকবে। এখান থেকে তথ্য নিয়ে আমি ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করবো।

শুধু ডায়েরি লিপিবব্ধ করা আর পেপার সংগ্রহ করেই থেমে থাকেনি হেলাল উদ্দিন। রাস্তার পাশে কোন ওষুধি গাছ দেখলে সেটি তুলে এনে নিজের বাগানে রোপন করবেন। এলাকার নারী পুরুষকে জৈব পদ্ধতিতে নিরাপদ খাবার উৎপাদনের জন্য পরামর্শ দিচ্ছেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে কেচো সার উৎপাদন বিষয়ে প্রশিক্ষণও প্রদান করছেন তিনি। আর এই কেচো সার বিক্রি করে তিনি তৈরি করেছেন পাকা বাড়ি । কিনেছেন পাওয়ার ট্রিলার, কয়েক বিঘা জমি। দিন রাত পরিশ্রম করা হেলাল উদ্দিন এখনো যুবকের মতোই কাজ করেন।

হেলাল উদ্দিনের ছেলে শাহিন জানান, তিনি জন্মের পর থেকেই দেখছেন বাবা ডায়েরি লেখেন রাত জেগে। পরিবারের সকলেই রাগারাগি করেন এত রাত পর্যন্ত এই বয়সে জেগে না থাকার জন্য। তার পরেও কারো কথা তিনি শোনেন না। মৃত্যুর সংবাদ, সুসংবাদ সবই তিনি তার ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করেন।

নিয়ামতপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রাজু আহমেদ রনি লস্কর জানান, হেলাল উদ্দিন একজন আদর্শ কৃষক। তিনি জৈব পদ্ধতিতে চাষাবাদ করেন। উপজেলার কয়েকশ নারী ও পুরুষকে তিনি জৈব পদ্ধতিতে চাষাবাদ করার জন্য প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছেন। ইতিমধ্যে তিনি জাতীয় কৃষিপদকসহ বিভিন্ন সম্মাননা পেয়েছেন।

হেলাল উদ্দিন যেন একজন জীবনন্ত তথ্য ভান্ডার। নিজের মতো করে তিনি এই ডায়েরিগুলো লিখে যাচ্ছেন। হেলাল উদ্দিন এখনো অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকেন। আবার সবার আগে ঘুম থেকে উঠে কাজে লেগে পড়েন।

/পিবিডি/পি.এস

ঝিনাইদহ,ডায়েরি,হেলাল উদ্দিন
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close