আগস্ট আবছায়া, হাসান আজিজুল হকের বিবৃতি ও মাসরুর আরেফিনের প্রতিবাদ
মাসরুর আরেফিন, যারা সাহিত্যের খোঁজখবর রাখেন তাদের কাছে বেশ পরিচিত । তার অনূদিত বেশ কয়েকটি গ্রন্থ প্রশংসিত হয়েছে। তিনি কবিতাও লিখেন, প্রকাশিত হয়েছে একাধিক কবিতার বই। এবার প্রথম লিখেছেন উপন্যাস। ‘আগস্ট আবছায়া’ নামের উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছে এবারের একুশে বইমেলায় প্রথম আলোর সহযোগী প্রতিষ্ঠান প্রথমা থেকে।
সম্পর্কিত খবর
উপন্যাসটির ব্যাক কভারে কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের প্রশংসাবচন রয়েছে। এমনকি উপন্যাসটির প্রচারে ব্যবহৃত পোস্টার-ব্যানারেও এই কথাসাহিত্যিকের মন্তব্য রয়েছে। এই মন্তব্য সম্পূর্ণ বানোয়াট, মনগড়া বলে জানিয়েছেন হাসান আজিজুল হক। শুধু তাই নয়, তিনি একটি প্রতিবাদলিপি পাঠিয়েছেন। সেটি তুলে ধরা হলো:
আমার নামে প্রকাশ পাওয়া বানোয়াট মন্তব্য সম্পর্কে প্রতিবাদ ও পূর্বাপর বক্তব্য:
"সম্প্রতি প্রকাশিত (ফেব্রুয়ারি ২০১৯) মাসরুর আরেফিনের ‘আগস্ট আবছায়া’ শিরোনামের একটি উপন্যাসের পেছন মলাটে আমার নামে মুদ্রিত একটি মন্তব্য নিয়ে বাংলাদেশের সাহিত্যাঙ্গন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক বিতর্ক ও বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে বলে আমার কানে এসেছে। পুরো বিষয়টি সম্যকভাবে অবগত হওয়ার পর আমি অত্যন্ত বিরক্ত ও বিব্রত হয়েছি, তাই বক্ষমাণ বিবৃতি দেয়ার প্রয়োজন পড়ল।
... বর্তমানে সিটি ব্যাংকের এমডি মাসরুর আরেফিনকে আমি একজন অনুবাদক হিসেবেই চিনি। সপ্তাহখানেক আগে সে আমাকে ফোন করে বলে, তার একটি উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি দেখাবার জন্য আমার ঠিকানায় পাঠাতে চায়। আমি বিষয়টি নেহাতই সরল ভেবে তৎক্ষণাৎ আর না করিনি। তাকে পাণ্ডুলিপি পাঠিয়ে দিতে বলি। কিন্তু স্পাইরাল বাইন্ডিং করা সাড়ে তিনশ পাতার সেই পাণ্ডুলিপি আমার কাছে আসার পর শুরু হলো নতুন বিপত্তি। মাসরুর বারংবার আমাকে টেলিফোন করে তার সেই উপন্যাসের জন্য দ্রুততম সময়ে একটি ‘ফ্ল্যাপ’ বা শংসাবচন লিখে দিতে বলে। শুধু সে নিজে ফোন করেই ক্ষান্ত হয়নি, তার প্রতিনিধি সাংবাদিক মারুফ রায়হানকে দিয়েও বারবার টেলিফোন করাতে থাকে। এমনকি এক সময় সে এই ফ্ল্যাপটুকু লেখাবাবদ আমার ব্যাংক একাউন্টে ত্রিশ হাজার টাকা পাঠিয়ে দেবার প্রস্তাবও দেয়, কিন্তু আমি সে প্রস্তাব তখনই প্রত্যাখ্যান করি। বয়সজনিত কারণ ও অসুস্থতার জন্য এত বড় পাণ্ডুলিপি অল্পদিনে পড়ে ফেলাটা আমার পক্ষে অসম্ভব। উপরন্তু তার ওই পাণ্ডুলিপি নাড়াচাড়া করে তা আদৌ উপন্যাস নাকি নানাবিধ বিদেশি গ্রন্থের সারের বমনমাত্র- তা আমার কাছে স্পষ্ট হয়নি। এটা কবুল করতে দ্বিধা নেই যে, ওই উপন্যাসটি আমি আদতে পুরো পড়তে পারিনি। কিন্তু মারুফ রায়হান আমাকে অনবরত টেলিফোন করতে থাকে। অগত্যা উপায়ান্তর না দেখে আমি পরে একদিন টেলিফোনে ভদ্রতার খাতিরে তাকে উপন্যাস সম্পর্কে দু’চার কথা বলি নেহাতই অনানুষ্ঠানিকভাবে। কিন্তু এখন দেখছি সে, আমার নামে মনগড়া কথা বানিয়ে তা ওই বইয়ের পেছন মলাটে বসিয়ে দিয়েছে।
আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে ও স্পষ্ট করেই আমার পাঠক, শুভানুধ্যায়ী-স্বজন-সুহৃদদের বলতে চাই, ‘আগস্ট আবছায়া’ বইয়ের পেছন মলাটে আমার নামাঙ্কিত যে কথাগুলো মুদ্রিত হয়েছে, তা আমার লেখা নয়। আমার কথাও নয়। মাসরুর আরেফিন বা মারুফ রায়হানকে আমি কোনো লিখিত ভাষ্য দেইনি। আমার সই করা কোনো কাগজও তাদের পাঠানো হয়নি। আমার তাৎক্ষণিক টেলিফোন আলাপকে বিকৃত করে মাসরুর নিজের উপন্যাসের প্রচারণায় অসৎভাবে ব্যবহার করেছে। কার্যত আমার সারল্য ও স্নেহের সুযোগ নিয়ে তারা আমার মানহানি ঘটিয়েছে এবং আমার সঙ্গে স্পষ্টতই প্রতারণা করেছে। এতে যেন কেউ বিভ্রান্ত না হন, এই অনুরোধ করি।
উপরন্তু আমি আরো জানতে পেরেছি ও এমন চাক্ষুষ প্রমাণ পেয়েছি যে, আমার নামে ছাপা হওয়া ওই ভুয়া বক্তব্যটি উক্ত বইয়ের বিজ্ঞাপনে এবং প্রচারণার জন্য ছাপা হওয়া পোস্টার, ব্যানার এমনকি বিলবোর্ডেও ব্যবহার করা হয়েছে। ... আমার নামে বানোয়াট বক্তব্য তৈরি করে পোস্টার ব্যানারে ছাপানো, তা নিয়ে ব্যবসা করা ও প্রচারের সুবিধার্থে আমাকে ব্যবহার করার অধিকার মাসরুর আরেফিনকে কে দিলো? আর ওই বইটির প্রকাশককে অনুরোধ জানাই, আমার নামে ছাপা হওয়া বানোয়াট মন্তব্যটি প্রত্যাহার করে নিয়ে তারা যেন বইয়ের মলাট নতুনভাবে ও সংশোধিত আকারে ছাপায়।"
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হাসান আজিজুল হকের এই বিবৃতি ছড়িয়ে পড়ার পর এর প্রতিবাদ জানিয়ে মাসরুর আরেফিন একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। নিচে সেটি তুলে ধরা হলো
শ্রদ্ধেয় লেখক হাসান আজিজুল হকের বিবৃতি প্রসঙ্গে আমার বক্তব্য:
" ভয়াবহ। ভয়াবহ এবং নির্মম-নৃশংস এক চক্রান্ত বা ষড়যন্ত্রের শিকার হচ্ছি আমি। শ্রদ্ধেয় হাসান আজিজুল হক স্যার এক অবিশ্বাস্য বিবৃতি দিয়েছেন আমার ‘আগস্ট আবছায়া’র পেছন-প্রচ্ছদে তাঁর মন্তব্যের বিষয়ে। উনি বলেছেন এই মন্তব্য তাঁর নয়, বলেছেন আমি তাকে টাকা সেধেছিলাম এই মন্তব্য পাওয়ার আশায়, বলেছেন আমি তাকে বার বার ফোন করেছি এই মন্তব্য পাওয়ার জন্য।
সত্য এই। আমি যা নিচে বলছি এর চেয়ে বড় সত্য আর নেই। সত্য এই:
কবিবন্ধু ও আমার বড় ভাই মারুফ রায়হান আমার অফিসে বসে থাকাকালীন আমি জনাব হাসান আজিজুল হককে ফোন করি জানুয়ারির ২১-২২ তারিখের দিকে তাঁকে এই প্রস্তাব দিতে যে, তিনি আমার লেখাটা রিভিউ করার মতো করে পড়তে পারবেন কি-না।
হাসান ভাইয়ের (যাকে আমি ‘স্যার’ বলে ডাকি) সঙ্গে আমার সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। ১৯৯৬ সালে তিনি আমাদের খুলনার বাসায়ও এসেছিলেন। তিনি সবসময়ই বলতেন, আমি ভালো লিখি, আমার লেখা তাকে অবাক করে, আমার পড়াশুনার পরিধি তাকে বিস্মিত করে।
আমি তাকে জিজ্ঞাসা করি, “স্যার, বইটা পড়ে শেষ করতে পারবেন? তাহলে কালকে কুরিয়ার করে দিই? আপনার ভালো লাগলে আপনি জানাবেন, সেটা আমি বইয়ের প্রচারণায় ব্যবহার করবো।”
হাসান স্যার বলেন, “অবশ্যই। কুরিয়ারে পাঠাও।”
এরপর আমি তাকে বলি, “স্যার, এ-জাতীয় প্রি-পাবলিকেশন রিভিউয়ের বা মন্তব্যের জন্য বিদেশে পারিশ্রমিক দেওয়ার রেওয়াজ আছে। আপনি এত বড় বই পড়ে শেষ করবেন সপ্তাহখানেকের মধ্যে। সাহিত্যজগতে যে লেখকদেরকে হেয় করার, বিনে পয়সায় কাজ করিয়ে নেওয়ার রীতি আছে, আমি তাতে বিশ্বাস করি না। বইটা এত জলদি পড়ার জন্য আমি আপনাকে সম্মানী দিতে চাই। আপনি কি তা নিতে রাজি আছেন স্যার?”
উনি বলেন, ‘মাসরুর, বাংলা সাহিত্যের এক বিখ্যাত লেখক বলে গেছেন, “বৎস, আগে কাজ, পরে পারিশ্রমিক।” কত দেবে তুমি?’
আমি বলি, “স্যার ২০-২৫ হাজার টাকা?”
স্যার শুনে বলেন, “আগে কাজ, পরে পারিশ্রমিক। বৎস, হা-হা।”
আমার সামনে বসা মারুফ ভাইকে বলি, “স্যারের সঙ্গে পারলে যোগাযোগ করেন মারুফ ভাই। আমি ব্যস্ত, ভুলে যাবো। আমার এই উপকারটুকু পারলে করেন।”
পরদিন বইটা কুরিয়ার করি স্যারের ঠিকানায়।
এরপর দিন যায়। এর মধ্যে হাসান স্যারের সঙ্গে আর একবারও আমার কথা হয়নি। অবশেষে ৬ই ফেব্রুয়ারি তারিখ দুপুরে আমি কবি মারুফ রায়হানের কাছ থেকে একটা ইমেইল পাই হাসান স্যারের মন্তব্যসহ। ছোট ইমেইল। তাতে দু-তিন লাইনে লেখা হাসান স্যারের পাঠ-প্রতিক্রিয়া।
আমি সেদিনই সেই মেইল ফরোয়ার্ড করে দিই ‘প্রথমা’র ব্যবস্থাপক জনাব জাফর আহমেদ রাশেদের কাছে। ওই দিনই সন্ধ্যায় আমি দ্বিতীয়বার কথা বলি হাসান স্যারের সঙ্গে, তাঁকে ধন্যবাদ দিই তার এই উদার মন্তব্যের জন্য।
তখন তিনি আমাকে ফোনে দীর্ঘসময় ধরে বিস্তারিত বলেন যে, উপন্যাসের কী কী তার অদ্ভুত ভালো লেগেছে, কী দারুণ দারুণ দারুণ আমার গদ্য, “তুমি এসব আইডিয়া পেলে কোথায়? তুমি... তুমি ওহ্, তুমি কী লিখেছ এটা তুমি? তোমার এই এই অংশগুলো পড়ে মনে হচ্ছে, বাংলা গদ্যে তুমি এ কী কাজ...।” ইত্যাদি, যা এখন বলতে আমার রুচিতে বাধছে।
এরপর হাসান স্যারের সঙ্গে কথা হয় উপন্যাস প্রকাশের একদিন আগে, প্রথম আলো-তে তাঁর মন্তব্যসহ উপন্যাসের বিজ্ঞাপন প্রকাশের পর। আমি নিজে তাকে ওদিন ফোন করি জানতে যে, “স্যার, প্রথম আলো দেখেছেন?”
হাসান ভাই ভয়ার্ত কণ্ঠে জানালেন, “সর্বনাশ হয়ে গেছে।”
আমি বলি, “কী!”
উনি জানান, দেশের সাহিত্যিকেরা তাঁর পেছনে লেগেছে, তাকে হুমকি-ধামকি দিচ্ছে, তাঁর বয়স আশি-র ওপরে, তিনি এই চাপ নিতে পারছেন না।
আমি বলি, “স্যার, উপন্যাস পড়ে আপনি মারুফ ভাইকে এই মন্তব্য দিয়েছেন, প্রকাশক সেটা ব্যাক-কভারে ছেপেছেন। আপনি শুধু বলেন, আপনি আন্তরিকভাবেই তো এই মন্তব্য করেছেন নাকি? যা বিশ্বাস করেন তা-ই তো বলেছেন? নাকি?”
উনি বলেন, “কী বলো এসব? অবশ্যই যা বিশ্বাস করি তা-ই বলেছি।”
তারপর আরও কত কথা। আমি বলি, “স্যার মারুফ ভাইকে আপনি একটা অ্যাকাউন্ট নাম্বার দিয়েছেন, আমি বিদেশে গেছিলাম, আপনার সম্মানীটা দিতে ভুলে গেছি, এখন আমার ব্রাঞ্চ ম্যানেজার বলছে আপনার রাজশাহীর অগ্রণী ব্যাংকের সেভিংস অ্যাকাউন্ট নাম্বার ০০৩৭৩৩, যেটা আপনি মারুফ ভাইকে ৬ তারিখ পাঠিয়েছেন, সেটা ভুল। নাম্বারের ডিজিট বাদ পড়েছে।”
উনি বলেন, “খবরদার, এখন টাকা পাঠিও না। পেছনে লোক লেগে গেছে। একটা বিরাট গোষ্ঠী তোমার ক্ষতির চেষ্টা করছে। আমি কোনো সম্মানী নেবো না। তুমি রাজশাহী বেড়াতে এলে দেখা যাবে। অ্যাকাউন্টে কোনো টাকা পাঠিও না।… মাসরুর, তুমি অনেক ভালো একটা ছেলে। তুমি ভালো থাকো।”
আমি জিজ্ঞাসা করি, “স্যার, আপনি এসব কেন বলছেন?”
তিনি বলেন, “তুমি জলদি মারুফ রায়হানকে বলো আমাকে ফোন দিতে।”
ওই শেষ। মোট তিনবার কথা হয় আমার এই শ্রদ্ধেয় লেখকের সঙ্গে। সর্বমোট তিন বার।
ফোন রেখেই আমি কবি মারুফ রায়হানকে ফোন করি। বলি, “মারুফ ভাই, হাসান স্যারকে ফোন দেন। উনি বললেন, আমার পেছনে শত্রুরা লেগে গেছে।” ইত্যাদি ইত্যাদি। আরও বলি, “মারুফ ভাই, হাসান স্যারের মন্তব্য যেটা আপনি আমাকে ই-মেইলে পাঠালেন, সেটা কী উনি লিখে দিয়েছেন, নাকি আপনাকে ফোনে বলেছেন?”
মারুফ রায়হান বললেন, “ফোনে বলেছেন। আমি তাঁর মন্তব্য হুবহু তুলে দিয়েছি। বারো মিনিটের ফোন কল ছিল।”
আমি বললাম, “ওকে।”
ওই শেষ। তারপর আজকে হাসান স্যারের এই বিবৃতি। ছিঃ!
এখন আমার এ-বিষয়ে কয়েকটা নিজের কথা বা অনুসিদ্ধান্ত:
১. হ্যাঁ, আমি ওনাকে সম্মানীর প্রস্তাব দিয়েছি। লেখকেরা সারা জীবন সন্ন্যাসব্রত পালন করবেন, তাদের শ্রমের মূল্য পাবেন না, আমি এই প্রথাকে ঘৃণা করি। তাই আমি তাকে তার যথাযোগ্য সম্মানীর প্রস্তাব দিয়েছি। আর উনি পশ্চিমবঙ্গের এক বিখ্যাত লেখকের (নাম মনে নেই এখন) উদ্ধৃতি দিয়ে আমাকে বলেছেন, “বৎস! আগে কাজ, আগে শ্রম, পরে পারিশ্রমিক।” ভালো।
২. হ্যাঁ, আমি আমার বইয়ের অনেক প্রচার করেছি ফেসবুকে এবং ৩০,০০০ পোস্টার ছাপিয়েছি। প্রথম আলো তাদের অ্যাড দিয়েছে তাদের পাতার স্পেসে, তাদের মতো। আর আমি ৩০,০০০ পোস্টার ছাপিয়েছি আমার পয়সায়, আমার মেধা দিয়ে পোস্টারের ডিজাইন করে, আমার মতো।
এদেশে একটা শ্যাম্পু, সাবান, সিমকার্ড, ভারতীয় সঙ্গীত শিল্পীর এ-দেশে আগমন, ফোক সঙ্গীত সন্ধ্যা এবং চীন থেকে আনা কনডমের বিজ্ঞাপনের পোস্টারে ঢাকা শহর ভরে ফেলা যাবে, আর এক লেখক একটা বইয়ের পেছনে চার বছর রাতদিন খাটবেন এবং ওনার পূর্ণ সামর্থ্য থাকবে সামান্য এক লাখ টাকা পোস্টারের পেছনে ব্যয় করার, কিন্তু ‘সাহিত্য’ বলে সেটা করা যাবে না, শ্যাম্পু হলে করা যাবে, আমি এই অজু-করা-সাহিত্যসাধনার নিকুচি করি।
সময় বদলেছে। সাহিত্য নিয়ে শান্তিনিকেতনী এই গরিবি আচরণের শেষ হওয়ার সময় এসেছে। সারা পৃথিবীতে লেখকদের এজেন্টরা তাদের হয়ে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে প্রচারণা চালাবে, নিজেদের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে বুস্ট করার ১০-২০ ডলারের টাকা হামেশা দিতে পারবেন আর পোস্টার ছাপালে আপনার ‘বড়লোকি’-র নিন্দা হবে, রিভিউ করালে আপনাকে তা মাগনায় করাতে হবে - আমি এই মানসিকতার নিকুচি করি। সাহিত্য - সাধনা। অবশ্যই। কিন্তু বই - বাণিজ্য। অবশ্যই। সারা পৃথিবীতে তাই এটা মাল্টি বিলিয়ন ডলার এক ইন্ডাস্ট্রি। কাফকা-সেবাল্ড-নবোকভ-কনরাড-মার্সেল প্রুস্ত সবাই সেই ইন্ডাস্ট্রির অংশ। বাংলাদেশে ঠিক ক এর উল্টোটা ভাবা হয় বলেই এদেশে পুস্তক প্রকাশনা শিল্প দাঁড়াচ্ছে না, এদেশের লেখকেরা বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছেন, এদেশের অনেক লেখককে অনেকের কাছে হাত পেতে চলতে হচ্ছে। অতি সাধারণ ঘর থেকে এসেও আমি নিজের শ্রম দিয়ে আজ এক ব্যাংকের এমডি, স্রেফ আমার মেধার ও আমার শ্রমের কারণে।
ঠিক তেমনি আমি আমার রাতের পর রাতের স্বেদবিন্দু-রক্তবিন্দু দিয়ে লিখেছি ‘ফ্রানৎস কাফকা গল্পসমগ্র’, ‘হোমারের ইলিয়াড’ (৯২৫ পৃষ্ঠার এক বই, যার আবার ১০০-১২৫ পৃষ্ঠা পাঠ পর্যালোচনা ও টীকা-ভাষ্য), লিখেছি আমার ‘আগস্ট আবছায়া’। এর প্রচারে যা যা করা দরকার তা আমি করবো। বন্ধু রাজু আলাউদ্দিন লিখেছেন, বইটার প্রচার দেখলে তাঁর মনে হয় কোনো রাজনীতিবিদ ভোটে দাঁড়িয়েছেন। এরকম। ভালো। দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ তার পোস্টার ছাপাতে পারবেন জনগণের কাছ থেকে লাখ লাখ লাখ টাকা চাঁদা নিয়ে, আর লেখক নিজের টাকায় তার বইয়ের পোস্টারের পেছনে লাখখানেক টাকা খরচ করতে পারবেন না, এ-কথা কে বলেছে রাজু আলাউদ্দিনদেরকে?
৩. আমি প্রচণ্ড ও নির্মম ধরনের একজন সৎ মানুষ। আমার ক্যারিয়ার ট্র্যাক রেকর্ড তাই বলে। ভাবতাম, কর্পোরেট দুনিয়াই শুধু নোংরা, যেখানে স্রেফ মেধা ও শ্রম দিয়ে অসংখ্য এলিটকে টপকে আমাকে ব্যাংকিংয়ে শীর্ষ পদে আসতে হয়েছে। আমি স্রেফ এক ভদ্র পিতার ভদ্র সন্তান। সেই সাধারণ, অতি সাধারণ ব্যাকগ্রাউন্ডের আমি এবার জানলাম, লেখকদের জগতটা আরও নোংরা। জনাব হাসান আজিজুল হকের মতো আশি-উর্দ্ধ এক মানুষকে ছুরির নিচে ফেলে তারা তাকে দিয়ে তাদের লেখা ‘প্রতিবাদপত্রে’ তাঁর স্বাক্ষর নিয়েছে। ভালো।
আমি সুস্থ ও সজ্ঞানে বলছি, এক সুতো অনৈতিকতা হয়নি কোথাও। আমি একটা উপন্যাস লিখেছি যা আমি জানি বাংলা সাহিত্যে আর কেউ কোনোদিন লিখতে পারেননি। আমি জানি, এটা অসম্ভব ভালো একটা লেখা। এখন পাঠকদের তা জানার পালা। ঈর্ষাকাতর সাহিত্যিক-পলিটিশিয়ানদের কোনো কথায় সেই সত্যের কোনো হেরফের হবে না। হবে, পাঠকেরা যদি বলেন এটা ভালো হয়নি, কেবল তবেই। নয়তো নয়।
এর বাদে যা কিছু চলছে তা এই পাশবিক মানুষ দিয়ে ভরা জঘন্য পৃথিবীর নির্দয় আচার। এ-ব্যাপারে আমার ভালো ব্যতীত খারাপ কিছুই বলার নেই, কারণ পৃথিবীর রীতিই এই। আমি শুধু তাকিয়ে দেখছি এবং মনে মনে নিজেকে আরও শক্ত করে নিচ্ছি এই জীবনে আরও আরও শক্ত লড়াইয়ের মোকাবিলার জন্য।
একটা হরফও আমার এই লেখায় মিথ্যা নয়। আমি এমনই। আমি লড়াকু। লড়েই, বিনয়ের সঙ্গে লড়েই, জীবনে এতদূর এসেছি এবং এখন দেখা যাচ্ছে এই জঘন্য ও ‘একপেশে’ লড়াইয়ের কারণে আরও জেদি আমি বাংলা সাহিত্যের দিগন্তরেখায় নতুন নতুন বই লিখে সূর্যের আলোর মতো উদ্ভাসিত হতে থাকবো। এতগুলো শত্রুর বিরুদ্ধে একা লড়তে আমার প্রচণ্ড ভালো লাগছে। প্রচণ্ড। নিজের প্রতি এই প্রবল আত্মবিশ্বাস ও আমার প্রতি ঈর্ষাকাতর ‘শত্রু’ কিন্তু আদতে ‘মানুষ’ বন্ধুদের উদ্দেশে এই প্রতিজ্ঞার কথাটুকু বলেই শেষ করছি।
পাঠক শুধু ‘আগস্ট আবছায়া’ কিনুন এবং পড়ে নিজেই বলুন আমি কেমন লিখেছি, আপনার বেশ কয়েক রাতের ঘুম হারাম হলো কি-না, বাংলা সাহিত্যে একদম নতুন কিছু পড়লেন কিনা। এ-ই। এটুকুই। আপাতত এটাই আমার এ-বিষয়ে শেষ লেখা। অসহ্য। এই ‘আনন্দ’ অসহনীয় কিন্তু দারুণ। পৃথিবী এভাবেই ঘুরতে থাকুক তার কক্ষপথে। মানুষের এই ন্যায়ানুমোদিত (মানুষের তৈরি সামাজিক আইনে ‘ন্যায়’ নির্ধারিত হয় দলের শক্তি দিয়ে) কিন্তু অসমীচীন খুনের খেলা আবার, আরও একবার, দেখতে ভালোই লাগছে।"
/এনই