• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||

শবে বরাত ও হালুয়া-রুটি

প্রকাশ:  ২০ এপ্রিল ২০১৯, ১৩:৩৭
নাজনীন সুলতানা

শবে বরাত পালন নিয়ে আলেম - ওলামা ও ধর্মচিন্তাবিদদের মাঝে মতভেদ থাকলেও উনিশ শতকের শেষের দিক থেকে বাংলাদেশে ঘটা করে শবে বরাত পালন শুরু হয়।

বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম দেশে আমাদের দেশের মত করে পবিত্র শবে বরাত পালন করা হয় না। যতদূর জেনেছি বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, ইরানসহ খুব স্বল্পসংখ্যক দেশেই এভাবে শবে বরাত পালন করা হয়।

তবে আমার এই পঞ্চাশোর্ধ জীবনের যেটুকু স্মৃতি মনে পড়ে - তার সাথে শবে বরাত শব্দ, এই দিনের নানামুখি আনুষ্ঠানিকতা - সবই খুব গভীর ভাবে জড়িয়ে আছে।

সম্ভবত: আমরা বাঙালীরা ধর্মীয় - সামাজিক - ব্যক্তিগত সকল ধরনের উৎসবেই আপ্যয়নের ব্যবস্থা করতে ভালোবাসি। যেটা সময়ের প্রেক্ষিতে এক সময় হয়ে যায় নিজস্ব সংস্কৃতির অপরিহার্য অংশ। আমরাও ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি যে শবে বরাতের অন্যতম অনুষঙ্গ হালুয়া - রুটি।

ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন তাঁর গবেষণায় জানিয়েছেন যে, ১৯ শতকের শেষের দিকে ঢাকার নবাবেরা বেশ ঘটা করেই শবে বরাত পালন করতেন। তারা আলোকসজ্জা করতেন, পাশাপাশি মিষ্টি বিতরণ করতেন। সে সময় যেহেতু মিষ্টির দোকান খুব একটা প্রচলিত ছিলনা সেজন্য মিষ্টি জাতীয় খাদ্য বানানোর উপকরণ দিয়ে বাড়িতে হালুয়া তৈরির প্রচলন শুরু হয়। ধীরেধীরে এর বিস্তার ঘটতে থাকে।

ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছি এই দিনে রাত জেগে নামাজ পড়া হয়। কিন্ত এ ছাড়াও বেশ আগে থেকেই অন্দরমহলে মা- চাচীরা আরো কিছু বিশেষ আয়োজনের প্রস্তুতি শুরু করতেন।

প্রতিটা বাসাতেই বিশেষ কিছু খাবার তৈরি করা হত। তা হলো - বিভিন্ন ধরনের হালুয়া, চালের আটার রুটি এবং মাংস।

অনেকে দিনটাকে "হালুয়া রুটির দিন" বলেও উল্লেখ করত।

শবে বরাত উপলক্ষে আমাদের বাসাতেও বিভিন্ন ধরনের হালুয়া তৈরি হত। বুটের ডালের হালুয়া সব বাসাতেই করা হত। সম্ভবত: এখনও এই খাবার শবে বরাতের দিনের কমন একটা আইটেম - এই বিশেষ দিনের আগে বিভিন্ন পেপার পত্রিকা ও টিভির রান্নার অনুষ্ঠান দেখে অন্তত: তাইই মনে হয়!

এ ছাড়াও করা হত সুজির বরফি। কোনটা নরম, ছাঁচে ফেলা। কোনটা শক্ত। সুজি সারারাত ভিজিয়ে নেশেস্তা করা হতো। এছাড়াও নারিকেল, চাল কুমড়ো, কাঁচা পেঁপে, বাদাম, ডিম - কতকিছু দিয়ে যে হালুয়া তৈরি করা হত!

এর বাইরে আর একটা রান্না ঐদিন করা হতো। আম্মা দুধ জ্বাল দিয়ে ঘন করে বড় কড়াই ভরে খুব সুস্বাদু সুজি রান্না করতেন। ক্ষিরের মত সেই সুজির উপরে লালচে রঙা সর জমে থাকত।

ঐদিন প্রচুর মানুষ আসত হালুয়া - রুটি নেয়ার জন্য। অনেকের চেহারা বা পোষাক দেখে বোঝা যেত যে তারা শুধু ওদিনই এসেছে - আসলে হয়ত গৃহস্থ বাড়ীর সদস্য। তাদের হালুয়ার টুকরোর সাথে বাটি ভরে ঐ ঘন ক্ষিরের মত সুজি দেওয়া হত।

সত্যি মিথ্যা জানিনা - শুনতাম তারা এই রুটিগুলো শুকিয়ে আপদকালীন সময়ের জন্য সঞ্চয় করে রাখত।

বিকালে শুরু হত আর এক কর্মযজ্ঞ।

আমরা থাকতাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্বপাড়ায়, ৯ নং ফ্ল্যাটে। পাশাপাশি ৮ আর ৯ মিলিয়ে দু'টো ফ্ল্যাটে ছিলাম ১২টা পরিবার। বিকালের আগেই আম্মা ১১ টা পরিবারের জন্য প্লেট- পিরিচ, বাটি ভরে থরে থরে খাবার সাজিয়ে দিতেন। ট্রে ভরা খাবার, উপরে হাতে তৈরি সুন্দর কাপড়ের অথবা কুরুশে বোনা ঢাকনা। ছোট দু' ভাই সাথে থাকত সহকারী হিসাবে। মহা উৎসাহে আমরা প্রতি বাড়ি ঘুরে ঘুরে হালুয়া - রুটি দিয়ে আসতাম।

সেসব বাড়ি থেকেও খাবার আসত।

সন্ধ্যায় দেখা যেত আমাদের বাড়ির বিশাল ডাইনিং টেবিলে আর এতটুকুও জায়গা নেই। নানা ছাঁচের, নানা স্বাদের, নানা রংয়ের সুস্বাদু হালুয়া দিয়ে ভরে থাকত পুরো টেবিল।

এখনো বাসায় শবে বরাত উপলক্ষে বাসায় বিশেষ কিছু রান্না করি। তবে তা করি শুধু বাসার জন্যই! ধীরে ধীরে কবে যে হালুয়া- রুটি এ বাড়ি - ও বাড়ি পাঠানোর রেওয়াজ প্রায় বন্ধ হয়েই গিয়েছে - কে জানে!

তবে পাড়া - প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজনের সাথে সুন্দর আন্তরিক সম্পর্ক বজায় রাখতে এই আনুষ্ঠানিকতা যে খুবই ইতিবাচক ভূমিকা রাখত তাতে কোন সন্দেহ নেই।

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

লেখক: প্রফেসর, রাজশাহী কলেজ


পিপিবিডি/এসএম

শবে বরাত
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close