‘এত বছর সংসার টানলাম, আর একটা লাশ টানতে পারব না’
হাজেরা খাতুনকে তার বিছানাসহ চ্যাংদোলা করে এনে বাড়ির আঙ্গিনায় শুইয়ে দিল তার দুই নাতি। নাতীদের বয়স যথাক্রমে এগার ও তেরো। দাদীর অস্থিচর্মসার দেহটাকে বহন করতে তাদের মোটেই কষ্ট হয় না। বরং এটা তাদের কাছে এক ধরণের খেলার মতো। রোজ স্কুলে যাবার আগে তারা নিয়ম করে দাদীকে ঘর থেকে দাওয়ায় বের করে রেখে যায়, আবার সন্ধ্যা হলে তাকে ঘরে তোলে।
হাজেরা কে তার শতচ্ছিন্ন কাঁথাসহ উঠোনে শুইয়ে দিতেই সে তার শুকনো খড়ির মত হাত দু’টো মাটিতে বারি দিয়ে দিয়ে বিলাপ করতে শুরু করে।আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে পুত্রের মৃত্যুশোকে মুহ্যমান তার বৃদ্ধা মা। অথচ হাজেরা খাতুনের মাথায় এই মুহূর্তে সম্পূর্ণ অন্য চিন্তা এসে ভর করেছে। পুত্রবধূর অবর্তমানে কে তাকে পস্রাব-পায়খানা করাবে, কে তাকে খাবার দেবে, সাত আটদিন পর গা টা যখন জ্বলে কেই বা তখন কলপাড়ে নিয়ে গা টা ধুইয়ে দেবে? তার পস্রাব-পায়খানা যদিও খুব কম, দিনে দু বা তিন ফোটা করে পস্রাব হয়, আর তিন-চারদিন পরপর একটু পায়খানা। তাও তো বউটা টেনে-হিঁচড়ে বাড়ির পেছনে নিয়ে বসিয়ে দেয়। খারাপ ব্যবহার যে করে না তা না, তবু তো দেয়। বউটা গেলে এগুলো কে করবে, ভেবে বিলাপের গতি এবং আওয়াজ দুইই বাড়িয়ে দেয় হাজেরা বেগম।
সম্পর্কিত খবর
পুলিশের কথা মতো তার ছেলে খুন হয়েছে দিন সাতেক আগে, যদি লাশ পাওয়া গেছে দিন-তিনেক আগে বাড়ির পেছনের ডোবায়। রহমত প্রায়ই এরকম সাত আটদিন বাড়ি ফিরত না বলে তার খোজ করেনি কেও। আর খোজ করার কেও নাই ও।
তার দুই নাতিই প্রথম খুঁজে পায় বাপের গলিত লাশ। বাড়ির পেছনে খেলতে গিয়ে ডোবায় বাপের লাশ ভাসতে দেখে তারা। তাদের চিৎকারে পাশের ভিটা থেকে কলিমুদ্দিন আর তার ছেলেরা ছুটে আসে তারপর তারাই পুলিশ খবর দেয়। পুলিশ দুইদিন ধরে গ্রামের মানুষকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে,পাড়া প্রতিবেশিদের ঘুম হারাম করে ফেলেছে, কিন্তু খুনের কোনো মোটিভ পায়নি। তারপর আজকে সকালে এসে মৃতের পরিবারকে আবার জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। আর কিছুক্ষণ জেরা করার পরেই খুনি ধরাও পড়ে।
প্রথমেই হাজেরা বেগমের সাথে কথা বলে তারা। তার ছেলে কখনও কারো সাথে ঝামেলা হয়েছে কিনা, ভিটা নিয়ে, জমি জমা নিয়ে কারো সাথে কোনো বিরোধ আছে কিনা, সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করেছে।
হাজেরা হেসেছে মনে মনে। গত বিশ বছর ধরে হাজেরা বিছানায় পড়া, এই বিশ বছরের প্রথম ছয় বছর তার কন্যা আর কন্যার বিবাহের পর থেকে তার ছেলের বউই তাকে দেখা দেখাশোনা করে। ছেলে হয়েছে তার বাপের মতন,পাষাণ প্রকৃতির। সে কোনোদিন জিজ্ঞেসও করেনি তার মা কেমন আছে, মরে গেছে না বেচে আছে।
হাজেরা বেগমের অভ্যাস আছে এমন পাষণ্ড দেখে। এক পাষণ্ড মরে গিয়ে বাঁচিয়ে দিয়েছিল বছর দশেক আগে, আরেকটা গেল সাতদিন আগে। গেছে ভালো হয়েছে, ভাবে হাজেরা বেগম কিন্তু পুলিশের সামনে খুব করে কাঁদে। মা যে তাই কাঁদতে হয়। তার সাথে কথা বলে বেরিয়ে যাবার একটু পরেই হাজেরা বাইরে থেকে পাড়া প্রতিবেশিদের উত্তেজিত কথাবার্তা শুনতে পান এবং চিৎকার করে নাতিদের ডাকেন যেন তারা তাকে ঘরের বাইরে বের করে।
মমতার একটা হাতে পুলিশ হ্যান্ডকাফ পরিয়ে, হ্যান্ডকাফের অন্য মাথা বারান্দার খুঁটিতে লাগিয়ে রেখেছে। মমতার খুব ঘুম পাচ্ছে, কিন্তু ঘুমানোর কোনো উপায় নাই। সে মাঝে একবার বলারও চেষ্টা করেছে পুলিশকে, ও ভাই শুনেন, আমি সাতদিন ধইরা ঘুমাই না। আমার জম্মের ঘুম ধরসে, বিশ্বাস করেন। আমারে এটটু ঘুমাইতে দেন গো ভাই। এই বারান্দাতই ঘুমাইয়াম। এটটু ঘুমাই??
ঘুমাতে দেয়া তো পরের কথা, পুলিশ একই প্রশ্ন তাকে বার বার করছে। প্রতিবার একই উত্তর দেয়ার পরেও একই কথা জিজ্ঞেস করছে। সত্যি কথা বল, কে খুন করসে?
এখন পর্যন্ত মমতা বিশবার বলে ফেলেছে- বিশ্বাস করুইন যে আমিই খুন করসি। আমিই খুন করসি হেরে।
-আর কে ছিল তোমার সাথ? কারো সাথে অবৈধ সম্পর্ক ছিল তোমার? স্বামী খারাপ কাজ করতে দেখে ফেলসিল? বল কে ছিল, কে সাহায্য করসে তোমারে?
মমতা প্রতিবার একই উত্তর দেয়
-ও স্যার আমার পোলাগো কসম খাইয়া কইতাসি, আমার কারো সাথে কোনো সম্পর্ক নাই, আমারে কেও সাহায্যও করে নাই, আমি নিজে একলাই খুন করসি গো স্যার।
-কিভাবে করসো আবার বল
মমতার গলা শুকিয়ে কাঠ গয়ে গেছে,সে তার বড় পুত্রের দিকে ইশারা দিয়ে বলে
-আব্বা, এক গেলাস পানি দেও।
তার পুত্র মেলামাইনের গ্লাসে করে পানি এগিয়ে দেয়। পানি খেয়ে মমতা চর্বিতচর্বণ আবার শুরু করে
-স্যার সে কাম থাইকা ফিরার পর আমারে খুব পিটায়।
-কেন পিটায়
-সে আমারে রোজ পিটায় কিছু না কিছু লইয়া বলে মমতা তার গায়ে কিছু দগদগে আঘাতের চিহ্ন দেখায়।
-সেদিন কেন পিটাইসে?
-তারে বিয়া করনের অনুমতি দেই নাই নাই তাই, সে গঞ্জের এক যাত্রাওয়ালির প্রেমে মজছিল। তারে বিয়া করনের লাইগা আমারে রোজ পিটাইতো।
-তারপর?
-তারপর সে যখন খাইয়া-দাইয়া শুইয়া পরসে, তখন আমি খাওন-দাওন গুছাইয়া, বাসন-কোসন মাইঞ্জা, ঘরে আসছি।
-তারপর?
-ঘরে আইসা দরজা বন্ধ কইরা দিয়া যখন শুইতে যাব তখন আমার ক্যান জানি খুব রাগ হইল তার মুখটার দিক তাকাইয়া!!
-তারপর??
-আমি খাটের তলা থাইকা পুঁতা বাইর কইরা তার মাথায় বারি দিয়া মাথাটা থ্যাতলাইয়া দেই।
-তারে ডোবায় ফেলসো কেমনে? কে সাহায্য করসে?
-কেও না আমিই টাইন্না নিসি।
-এতো শক্তি তোমার? একটা লাশের কত ওজন থাকে তুমি জানো, তারে তুমি একলা টাইনা নিলা?
-এতো বছর এই সংসারটা টানলাম, আর একটা লাশ টানতে পারব না স্যার? জ্যাতা মানুষ যদি ভালো না বাসে তার ওজন লাশের থাইকাও বেশি হয় স্যার। তারে ষোল বছর টানলাম।
-সত্যি বলতেস?
-জ্বে সব সত্য বলসি
মমতাকে ঘিরে থাকা উৎসুক প্রতিবেশিদের দিকে তাকিয়ে বলল
-আপনারা এটটু হরুইন যে, একটু তফাত যান। বাতাস আইয়ে না, আমার গরম লাগে।
মমতার সাথে সাথে পুলিশও তাদের ধমক লাগায়
-এই সবাই বের হও, আউট আউট। যার যার কাজে যাও সবাই।
প্রতিবেশিরা একটু নড়েচড়ে দাড়ায় কিন্তু কারো মধ্যে চলে যাবার কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। পুলিশের অপেক্ষাকৃত বড় অফিসার তার সহকারীর দিকে তাকিয়ে বলেন
-ভ্যানে তোল একে
কনস্টেবল মমতার খুঁটিতে লাগিয়ে রাখা হ্যান্ডকাফের প্রান্তটা খুলে উঠে দাড়াতে ইশারা করে। মমতা উঠে দাঁড়িয়ে স্বাভাবিক গলায় বলে
-আমার শাশুড়ি আর পোলা গো লগে বিদায় নিয়া আসি স্যার। কে জানে আবার কবে দেখা হইব।
মমতা তার দুইপুত্রের কাছে যেয়ে তাদের জড়িয়ে ধরে স্বাভাবিক গলায় বলে
-আব্বারা ভালো থাইকো, ইশকুলে যাইও আর দাদীরে দেইখ। তারে খাওন দিও, টাটটি পেশাব করাইও। অচল মানুষরে অবহেলা কইরো না আব্বা।
মমতার দুই পুত্র ভাবলেশহীন চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। এরপর মমতা তার শাশুড়ির সামনে হাঁটু গেড়ে বসে!!
-যাই গো আম্মা, ভুল ত্রুটি মাফ কইরা দিয়েন।
হাজেরা বেগম খুব চেষ্টা করেন, পুত্রবধূকে দু’চারটা ভালোমন্দ শোনাবেন, গালি-গালাজ করবেন, সদ্য পুত্রহারা মায়ের পুত্রের খুনির প্রতি যেরূপ ব্যবহার করা উচিত, সেরকম। কিন্তু হাজেরা বেগম ব্যর্থ হন বরং কুনুই এ ভর দিয়ে সামান্য সোজা হয়ে মমতাকে জড়িয়ে ধরে। চিৎকার করে কাঁদতে থাকেন। তার সেইদিন টার কথা খুব মনে পড়তে থাকে। যেদিন তার স্বামী লাঠি দিয়ে পিটিয়ে তার মেরুদণ্ডের হাড় গুড়িয়ে দিয়েছিল। তার মনে হতে থাকে তিনি যদি বুঝতেন সেইদিনের পর থেকে তাকে এই অথর্ব জীবন কাটাতে হবে,তাহলে হয়ত তিনি মমতার মতই করতেন।
এক পর্যায়ে উনি কান্না থামিয়ে বলেন
-মারলি ক্যান? পলাইয়া গেলেই তো পারতি।
মমতা রসিকতা করে বলে,
-আপনারারে রাইখা কই পলাইতাম? আমারে ছাড়া তো আপনের হাগন-মুতনও হয় না। দুইটা পোলা রাইখা সংসার রাইখা পলানো কি এতো সোজা আম্মা? যেইটা সোজা মনে হইসে সেইটাই করসি।
মমতার কথা শুনে পুলিশ অফিসার বলে ওঠে
-এই বেহায়া মহিলা, স্বামীরে খুন কইরাও দেখি তোমার কোনো লজ্জা নাই, কেমন মেয়ে মানুষ তুমি?
মমতা উঠে দাড়াতে দাড়াতে বলে
-জ্বে না স্যার, আমার কুন লজ্জা নাই। সে আমারে এত মারসে সারাজীবন, এতো অত্যাচার করসে যে তার জন্য আমার আর কিছুই নাই। সে আমারে তিলে তিলে মারসে আমি তারে একবারে। আফসুসের ব্যাপার, শরীলের মরণ মানুষ মানুষ বুঝে, মনের মরণের দাম নাই। চলেন রওনা দেই আল্লাহর নাম লইয়া।
মমতাকে নিয়ে পুলিশের ভ্যান রওনা দেয়, পিছে পিছে গ্রামের বাচ্চাগুলো আনন্দে দৌড়াতে শুরু করে। মমতা এর আগে কোনদিন জীপ গাড়িতে উঠেনি। তার খুব ভালো লাগে গাড়িতে চড়ে যেতে। ইস, কতবছর পরে যে সে আজ ঘর ছেড়ে বের হল।
বাউকুমটা বাতাসে মমতার চুল উড়তে থাকে, শাড়ির আচল উড়তে থাকে। কিছুক্ষণ পর কংক্রিটের চার দেয়ালের মধ্যে চিরতরে আটকা পড়বে জেনেও কেন যেন মমতার আজ নিজেকে খুব স্বাধীন লাগে...............!!
(লেখকের ফেসবুক থেকে নেওয়া)
/অ-ভি