• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||

ত্রি-উদ্যানই পাল্টে দিল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসা সেবা

প্রকাশ:  ১৭ জানুয়ারি ২০১৯, ১১:১৬
সুলতান মাহমুদ (দিনাজপুর)

সৎ উদ্দেশ্যে, সততা, উদ্যোম, আর দলগত একই মনোভাব থাকলেই যে কোন কঠিন কাজই সহজ আর সাফল্য অর্জন করা যায় তার জলন্ত প্রমাণ দিনাজপুর জেলার চিরিরবন্দর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আজমল হক। গত দুই বছর আগেও যে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হাসপাতাল ভূতুড়ে পরিবেশে চিকিৎসা সেবা প্রধান করা হতো আজ সেই উপজেলা কমপ্লেক্স হাসপাতালে প্রবেশ মুখ থেকে করিডোর, করিডোর থেকে ছাদ সর্বত্রই সারিবদ্ধভাবে সাজানো হয়েছে টবে লাগানো হরেক রকমের ফুল গাছ দিয়ে। ভবনের সামনের অংশে পৃথকভাবে তিনটি স্থানে করা হয়েছে পুষ্টি উদ্যান, পুষ্প উদ্যান ও ভেষজ উদ্যান।

শুধু ভালবাসা আর সহকারীদের ঐকান্তিক সহযোগিতায় গড়ে তুলেছেন দিনাজপুর জেলার চিরিরবন্দর উপজেলার ৫০ শয্যা বিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এই সৌন্দর‌্য বর্ধনের অন্যতম কারিগর হিসেবে এলাকায় বেশ সুনাম ছড়িয়েছেন হাসপাতালের শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ ও উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আজমল হক।

সম্পর্কিত খবর

    লোকালয় থেকে খানিকটা নিরিবিলি পরিবেশে নয় একর জমির উপরে দাঁড়িয়ে মানুষের চিকিৎসা সেবা প্রদান করে আসছে উপজেলার ৫০ শয্যা বিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি। হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে মেইনগেট দিয়ে ঢুকতেই পুরাতন ভবনের পাশে চোখে পড়বে পুষ্টি উদ্যানের সাইনবোর্ড। খানিকটা সময় চোখ আটকে যাবে পুষ্টি উদ্যানে। পুরো জায়গাটি ছোট ছোট অংশে ভাগ করে ১৩ রকমের সবজি চাষ করা হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে চলতি মৌসুমের সবজিসহ পাতাকপি, বেগুন, মুলা, শালগম, ফুলকপি, মরিচ, গাজর, আলু, সীম, লাউ, পেঁপে। একটুখানি এগিয়ে নুতন ভবনের সামনে সাইকেল গ্যারেজের পাশ ঘেষে ভেষজ উদ্যান। লাগানো হয়েছে আঁদা, রসুন, পেঁয়াজ, ধনেপাতা, আকন্দ পাতা, তেজপাতা, ঘৃত কাঞ্চন, ওলট কম্বল ও ধুতরার গাছ। ডা. আজমলের ভাষায় ভেষজ বলতে শুধু কবিরাজের বাটা পথ্যকেই বোঝায়না। তিনি বলেন আঁদা, রসুন, পেঁয়াজ যেগুলো আমাদের শরীরে এ্যানজাইম তৈরী করতে সহায়তা করে এগুলোও ভেষজের পর‌্যায়ে পড়ে।

    দুই ভবনের প্রবেশ মুখের দুইদিকে দেখা মিলে পুষ্প উদ্যানের। নানা রকমের পাতাবাহারের গাছসহ ৮০০ টবে প্রায় ৪০ রকমের ফুলের গাছ রয়েছে হাসপাতাল চত্ত্বর ঘিরে। যার অধিকাংশটিতেই শোভা পাচ্ছে বাহারী সব ফুলের সৌন্দরর‌্য। নীচতলা থেকে ৪তলা প্রতিটি করিডোরে সারিবদ্ধভাবে সাজানো হয়েছে টবে লাগানো ফুলের গাছ দিয়ে। যার মধ্যে রয়েছে গোলাপ, গাঁদা, জবা, মালতী, চন্দ্র মল্লিকা, মোরগ ফুল, কসমস, ডালিয়া প্রভৃতি। সবমিলিয়ে হাসপাতালটি হয়ে উঠেছে একটি ফুল বাগানের মত।

    এ প্রসঙ্গে ডা. আজমল হক বলেন, ‘ক্লীন হাসপাতাল ইনোভেটিভ থিউরি থেকে হাসপাতাল চত্ত্বরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি ও পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার জন্য সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে এই কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে চলেছি।’

    শুধু বাগান করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেননি ডা. আজমল হক। সম্পতি হাসপাতালের নতুন ভবনের প্রবেশ মুখের বাম পাশের একটি কক্ষে গড়ে তুলেছেন লাইব্রেরি। তিনটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকাসহ গল্প, উপন্যাস, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, এনাটমি, ফার্মাকোলজি, ফিজিওলজি, সার্জারীসহ স্বাস্থ্য ও পুষ্টি জ্ঞান সমৃদ্ধ প্রায় ২৫০কপি বই ইতোমধ্যে স্থান পেয়েছে লাইব্রেরীতে।

    লাইব্রেরীর তত্ত্বাবধানকারী হাসপাতালের আর.এম.ও ডা. মর্তুজা আল মামুন বলেন, স্যারের এবং আমাদের নিজেদের সংগৃহীত কিছু বই দিয়ে এবং নিজেরাই চাঁদা দিয়ে কিছু বই কেনা হয়েছে এবং এবারের বই মেলা থেকে বই কিনবার পরিকল্পনাও ইতোমধ্যে গ্রহণ করা হয়েছে।

    চিরিরবন্দর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে নরমাল ডেলিভারি। গর্ভবতী মায়েদের নরমাল ডেলিভারী করে চিকিৎসা সেবা প্রদানের মাধ্যমে প্রসূতি মায়েদের ভীতি দূর করেছেন তারা। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত চিকিৎসক নার্স মিলে টিম ওয়ার্ক করে নরমাল ডেলিভারির মাধ্যমে সন্তান প্রসবের উদ্যোগে সফলতা লাভ করেছেন ইতোমধ্যে। ফলে উপজেলায় বেসরকারি হাসপাতাল আর ক্লিনিকগুলো পড়েছেন বিপাকে। হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ডা. ফারিয়া

    তাসমিন দিশা বলেন, ২০১৬ সালে ৭১ জন, ২০১৭ সালে এখানে নরমাল ডেলিভারি করা হয়েছে ১৪৯ জন প্রসূতি মায়ের, ২০১৮ সালে নরমাল ডেলিভারি হয়েছে ৩২৯ জনের এবং চলতি বছরের ১ম মাসে এ যাবত ১৪জন প্রসূতি মায়ের নরমাল ডেলিভারি করা হয়। নরমাল ডেলিভারির মাধ্যমে সন্তান প্রসবে প্রসূতি মায়েদের উদ্বুদ্ধ করতে তারা চালিয়েছেন বিভিন্ন রকম প্রচার প্রচারণা।

    এজন্য স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পক্ষ থেকে প্রসূতি মায়েদের বিনামূল্যে প্রসূতি কার্ড প্রদান করা হয়েছে। এরপর ডেলিভারি না হওয়া পর‌্যন্ত ফ্রীতে পরামর্শ ও চেকআপের ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রসূতি কার্ড ও নরমাল ডেলিভারি করাতে মাঠ পর্যায়ে শিক্ষক, জনপ্রতিনিধি, ইমাম ও বিভিন্ন এনজিও স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমে বার্তা পৌঁছানো হয় প্রসূতি মায়ের কাছে। এছাড়াও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকরাও নিজেরা বিভিন্ন সময় কমিউনিটি হেলথ সেন্টারগুলোতে মা সমাবেশ করে থাকেন।

    তিন দিন হলো উপজেলার জগন্নাথপুর বাংলা বাজার থেকে আসা শিরিন আক্তার (২২) এর নরমাল ডেলিভারি করা হয়েছে। অনুভূতির কথা জানতে চাইলে শিরিন আক্তার বলেন, ‘নরমাল ডেলিভারিতে বাড়ির আশেপাশের কয়েকজনের কথায় ভয় পেয়েছিলাম। অনেকে ক্লিনিকে সিজার করার পরামর্শ দিয়েছিলো। কিন্তু স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মাঠকর্মী এবং ডাক্তার আমাকে সাহস দেয়। এরপর আমি নরমাল ডেলিভারি করাতে রাজি হই। এখন আমার ছেলে সন্তান সহ আমি বর্তমানে সুস্থ্য আছি।’

    ডা. আজমল জানান ডেলিভারী নিরাপদ করতে হাসপাতালে রাখা হয়েছে দক্ষ ধাত্রীদের। তিনি আরো জানান, উপজেলা সমাজ সেবা অধিদপ্তরের সহযোগিতায় জন্ম নেয়া নবজাতকের জন্য জামা-কাপড়, মশারী ও প্রসূতি মাকে উপহার দেয়ার ব্যবস্থাও আছে এখানে। তবে ডেলিভারীর সময় বেশি অসুস্থ্য মায়েদের রেফার্ড করে এ্যাম্বুলেন্সে করে ফ্রীতে দিনাজপুর সদর হাসপাতাল ও দিনাজপুর মেডিকেলে পৌঁছানোর ব্যবস্থাও আছে বলে জানান তিনি।

    ভবনের দ্বিতীয় তলায় রয়েছে এন্টি ন্যাটাল কেয়ার। এখানে রাখা হয়েছে পুষ্টি ট্রে। যাতে রাখা হয়েছে নানান ধরনের সবজি ও ফলমূল। গর্ভবতী মায়েরা চেকআপে আসার সময় তাদেরকে স্বাস্থ্য বিষয়ক পরামর্শ দিয়ে ট্রেতে রাখা সবজি ও ফলমূলের পুষ্টি গুনাগুন সম্পর্কে ধারণা দেয়া হয় এবং ফলোআপ গ্রহণ করা হয়।

    নতুন ভবনের দ্বিতীয় তলায় রয়েছে টেলি মেডিসিন ও ভিডিও কনফারেন্সিং সেন্টার। প্রসূতি মায়েরা ছাড়াও এখানে রোগীরা আসে বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে। হাসপাতালে যে সব বিষয়ের সমাধান পাওয়া যায়না সেক্ষেত্রে দেশের বিভিন্ন মেডিকেলে টেলি মেডিসিন বিভাগে কর্তব্যরত ডাক্তারের সাথে ভিডিও কনফারেন্সিং এর মাধ্যমে রোগীকে সেবা প্রদান করা হয়ে থাকে।

    এই বিভাগে কর্মরত সাপোর্টিং ইঞ্জিনিয়ার খাদিজাতুল কোবরা বলেন সাধারণত স্কীন সমস্যা নিয়ে এখানে বেশী রোগী পাওয়া যায়। রেজিস্ট্রার খাতা দেখে তিনি জানান শুধুমাত্র ২০১৮ সালেই টেলি মেডিসিন কর্ণার থেকে ২ হাজার ৯৫৬ জন রোগীকে সেবা দেয়া হয়েছে। তারই ফলশ্রুতিতে এই বিভাগের মাধ্যমে জনগনকে সুন্দরভাবে স্বাস্থ্য সেবা দেবার কারনে জাতীয় পর‌্যায়ে বছরে ৫২ সপ্তাহের মধ্যে ২৬ সপ্তাহ নিয়মিত প্রথম দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে চিরিরবন্দর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।

    এছাড়াও হাসপাতালে রাখা হয়েছে ডাইনিং রুম। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দাবী করছে বাংলাদেশে ৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে কর্মকর্তা - কর্মচারি, রোগী কিংবা রোগীর সাথে আসা ব্যক্তিরা যেন নির্দিষ্ট স্থানে খাবার খেতে পারে সে জন্যেই এই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। ডাইনিং রুমে রাখা হয়েছে বিশুদ্ধ পানির ফিল্টারও।

    তবে খানিকটা পরিতাপের বিষয় সুন্দর পরিবেশে স্বাস্থ্য সেবা প্রদানকারি এই প্রতিষ্ঠানটিতে রয়েছে জনবলের অভাব। প্রতিষ্ঠানের অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী ১ম শ্রেনীতে ডাক্তার ও কর্মকর্তাদের মধ্যে ৩৪টি পদের বিপরীতে আছেন ৫জন, দ্বিতীয় শ্রেনীতে ১৮ জনের স্থলে রয়েছেন ১৬জন, তৃতীয় শ্রেণিতে ৮৫ জনের স্থলে রয়েছেন ৬০ জন এবং চতুর্থ শ্রেণিতে ২১ জনের স্থলে রয়েছেন ১৫ জন কর্মচারী। তারপরও ঘাবড়ে যাননি উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. আজমল হক।

    তিনি বলেন ‘জনবল কম আছে ঠিকই। কিন্তু সহকর্মী হিসেবে যারা আছে তারা সকল সময়ের জন্য আন্তরিকতার সাথে হাসপাতালের চিকিৎসাসেবার মান বাড়াতে তাকে সহযোগিতা করছেন বলে জানান তিনি। তিনি আরো বলেন, হাসপাতালের উন্নয়নে বিভিন্ন খাত থেকে সামান্য সহযোগিতা নিয়ে এবং ব্যক্তিগতভাবে ও সহকর্মীদের সহযোগিতায় ক্লীন হাসপাতাল ইনোভেটিভ থিউরি বাস্তবায়ন করবার চেষ্টা করেছি। অনেকে সহায়তার হাত বাড়িয়েছে কিন্তু প্রাথমিক অবস্থায় আমরা গ্রহণ করিনি। তবে এই ধরণের কাজে প্রতিটি এলাকায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের এগিয়ে আসবার আহবান জানান তিনি।

    চিন্তা ও কাজের স্বীকৃতিস্বরুপ উন্নয়ন মেলা-২০১৮তে হাসপাতালের সার্বিক কর্ম পরিবেশ ও চিকিৎসা সেবার মান সন্তোষজনক হওয়ায় প্রথম স্থান অর্জন করে সম্মাননা গ্রহণ করেছে চিরিরবন্দর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।

    এ প্রসঙ্গে দিনাজপুর জেলার সিভিল সার্জন অফিসার আব্দুল কুদ্দুস জানান ‘চিরিরবন্দর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বর্তমান পরিবেশ সত্যিই প্রশংসার দাবী রাখে। ইতিমধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ আমরা পরিদর্শন করেছি। বাংলাদেশে যেকটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে মডেল ঘোষনা করা হবে তার মধ্যে দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নাম থাকবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

    তিনি আরও বলেন খুব শীঘ্রই আমরা পর‌্যায়ক্রমে দিনাজপুরের প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে ক্লীন হাসপাতাল ইনোভেটিভ থিউরির মধ্যে নিয়ে আসবো।’

    পিবিডি/ওএফ

    সারাদেশ

    অনুসন্ধান করুন
    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close