• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||

টাকার অভাবে কৃষকদের পাওনা দিতে পারছে না মোবারকগঞ্জ চিনিকল

প্রকাশ:  ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১০:৫৪
শাহজাহান আলী বিপাশ, ঝিনাইদহ

টাকার অভাবে কৃষকদের পাওনা পরিশোধ করতে পারছে না দেশের দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম ভারি শিল্প প্রতিষ্ঠান মোবারকগঞ্জ চিনিকল। চলতি মৌসুমে মিলটির কাছে কৃষকের পাওনা রয়েছে প্রায় ২৫ কোটি টাকা। কারখানা সচল রাখতে প্রতিদিন প্রায় ৫০ লাখ টাকার আখ প্রয়োজন হয়। গত ৭ ডিসেম্বর চলতি মাড়াই মৌসুম শুরু হওয়ার পর প্রথম কিস্তিতে কৃষকদের তিন কোটি টাকা পরিশোধ করা হলেও এখনো বাকি রয়েছে প্রায় ২৫ কোটি টাকা।

গত এক মাস ১০ দিনে বাকি পাওনা পরিশোধ না করায় আখচাষীদের মধ্যে চরম অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। চাষীরা প্রায়ই পাওনা টাকার জন্য বিক্ষোভ প্রদর্শন করছে। আর নাজুক এ অবস্থার জন্য মিলে উৎপাদিত চিনি বিক্রি না হওয়াকে প্রধান কারণ বলেছেন মিলটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইউছুপ আলী শিকদার। অপর দিকে শ্রমিকদের শতকরা ১২ % টাকা কমিশন দিয়ে বেতন নিতে হচ্ছে বলে অভিযোগ।

মোবারকগঞ্জ সুগার মিলে আখ চাষীদের বকেয়া পাওনা আদায়ের দাবিতে স্বারকলিপি পেশ করেছেন আখঁচাষীরা। গত সোমবার সকালে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবর এ স্মারকলিপি পেশ করেন তারা।এসময় মোবারকগঞ্জ চিনিকল আখচাষী কল্যাণ সমিতির সভাপতি জহুরুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক মাসুদুর রহমান মন্টু, কৃষক মিজানুর রহমান, মনিরুজ্জামান স্বপন, আক্কাস আলী, আলি আকবর মালিতা, রমজান আলী, আব্দুস সাত্তারসহ অন্যানরা উপস্থিত ছিলেন।

কৃষকনেতারা বলেন, চলতি অর্থবছরে কালীগঞ্জের প্রায় সাড়ে ৫ হাজার আখচাষী মিলের কাছে ২০ কোটি টাকা পাবেন। দ্রুত এ টাকা পরিশোধ করার দাবি জানান তারা। এছাড়াও তারা চিনি শিল্পের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকেও অপসারণের দাবিও জানান।

মিল সুত্র থেকে জানা গেছে, গত ২০১৭-১৮ মৌসুমে উৎপাদিত প্রায় আড়াই হাজার মেট্রিক টন চিনি গুদামে পড়ে আছে। আর চলতি মৌসুমে উৎপাদিত চিনি যোগ হয়েছে আরো ৪ হাজার মেট্রিক টন। ২ ফেব্রুয়ারি রাত ১২টা পর্যন্ত ৩ হাজার ৯০৫ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদন হয়েছে। মিলগেটে চিনির প্রতি কেজি মূল্য ৫০ টাকা। ফলে অবিক্রিত এসব চিনির মূল্য প্রায় ৩৫ কোটি টাকা। অন্যদিকে চিটা গুড় আছে দুই হাজার মেট্রিক টন। যার মূল্য প্রায় দুই কোটি টাকা।

মিলের শ্রমিকরা জানায়, প্রতি কেজি চিনি মিলগেটে বিক্রি হয় ৫০ টাকা। মিলগেটের বাইরে বিভিন্ন বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে উৎপাদিত চিনি বিক্রি হচ্ছে ৪৮ টাকা কেজি। যে কারণে মিলের তালিকাভুক্ত ডিলাররা এ মিলের চিনি কিনতে অপারগতা প্রকাশ করে আসছে। আর চিনি বিক্রি না হওয়ায় চরম বিপাকে পড়েছে মিলটি।

১৯৬৫ সালে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ পৌর শহরের ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে বলিদাপাড়ায় প্রতিষ্ঠিত মিলে পাওনা পরিশোধের দাবিতে প্রতিদিনই বিক্ষোভ করছে কৃষকরা। তবে কর্তৃপক্ষ আখচাষিদের পাওনা পরিশোধে তেমন কোন কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না বলে তাদের অভিযোগ।

উপজেলার বুজিডাঙ্গা মুন্দিয়া গ্রামের আখচাষী মোহন জানান, এবছর সে ৬ বিঘা জমিতে আখ চাষ করেছে। ইতিমধ্যে চার বিঘা জমির ২৫ গাড়ি আখ মিলে সরবরাহ করেছে। যার পাওনা প্রায় দেড় লাখ টাকা। কিন্তু ডিসেম্বরের ২৩ তারিখ পর্যন্ত দুটি ভাউচারের ১০ হাজার টাকা পেয়েছে। এক পুর্জির আখ মিলে পৌছে দিতে শ্রমিক ও পরিবহনসহ ১৮শ টাকা প্রয়োজন হয়। এখন আখ তুলতে শ্রমিক ও গাড়ি খরচের টাকা নেই। ফলে বাধ্য হয়ে এক বিঘা জমি বন্দক রেখে আখ তোলার খরচ যোগাতে হচ্ছে বলে জানালেন মিলে আখ নিয়ে আসা এই কৃষক।

মোল্লাকোয়া গ্রামের আখচাষী রুবেল হোসেন জানান, এবছর চার একর জমিতে আখ রয়েছে। এ পর্যন্ত ৮৫ হাজার টাকার আখ মিলে দিয়েছি। ডিসেম্বরের ২৩ তারিখে মাত্র ১০ হাজার টাকা পেয়েছিলাম। এখন আখ তোলার শ্রমিক ও পরিবহন খরচ ধার দেনা করে যোগাড় করতে হচ্ছে।

ছোটঘিঘাটি আখ ক্রয় কেন্দ্রে চাষী শরিফুল ইসলাম জানান, আমার এবছর ১২ বিঘা জমিতে আখ ছিল। এ পর্যন্ত ৯ বিঘা জমির আখ মিলে দিয়েছি। যে আখ কাটা ও পরিবহন খরচ হয়েছে প্রায় ৬০ হাজার টাকা। মিলের কাছে পাওনা প্রায় তিন লাখ টাকা। কিন্তু মিল থেকে যে টাকা দিয়েছে তা দিয়ে ঋণ কেটে নিয়েছে। ফলে ধার করে শ্রমিক ও পরিবহনের টাকা যোগাড় করা হচ্ছে।

এদিকে মিলের শ্রকিদের বেতন পরিশোধ করা হলেও ১২ শতাংশ কেটে রাখা হচ্ছে। যা দেশের কোন চাকুরিদের ক্ষেত্রে এমনটি করা হয় বলে রেকর্ড নেই। এর আগে কয়েক মাস পর পর বেতন দেওয়া হলেও ৮ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত কেটে রাখা হত। ফলে মিল শ্রমিকদের মধ্যে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে। শ্রমিক নেতারা বলছে চিনি বিক্রি হচ্ছে না তাই ডিলারদের কাছে কম দামে চিনি বিক্রি করে শ্রমিকদের বেতন দেওয়া হয়েছে। চিনির বিপরীতে বেতন নিয়ে ১২% টাকা লস করতে হয়েছে শ্রমিকদের। এ নিয়ে শ্রমিকরা মিলগেটে একাধিকবার বিক্ষোভ প্রদর্শন করলেও কোন সুরাহা হয়নি। তবে প্রশাসন আর দুর্নীতিগ্রস্ত শ্রমিক ইউনিয়ন নেতাদের নানা অনিয়মের কারনে দিনে দিনে মিলটির এমন দুরাবস্থা বলে জানালেন সাধারণ শ্রমিকরা। এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই মিলটি বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলেও তাদের আশঙ্কা।

গত ৭ ডিসেম্বর প্রায় তিনশত কোটি টাকা পুঞ্জিভূত ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে ২০১৮-২০১৯ মাড়াই মৌসুম শুরু করে মিলটি। এটি চিনিকলের ৫২তম মাড়াই মৌসুম। এ বছর ১ লাখ ৮ হাজার ৪২৩ মেট্রিক টন আখা মাড়াই করে ৮ হাজার ১৩২ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করা হয়েছে। চিনি আহরণের হার ধরা হয়েছে ৭.৫০। সর্বশেষ ২০১৭-২০১৮ ম্ড়াাই মৌসুমে ৩২ কোটি ৮৪ লাখ টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে মিলটির। এর আগে ২০১৬-২০১৭ লোকসান হয় ২৬ কোটি ৯ লাখ টাকা। এ পর্যন্ত ৩৫ মাড়াই মৌসুমে লোকশান হয়েছে ৩শ ১ কোটি টাকা। বাকি ১৬ মৌসুমে লাভ হয়েছে ৩৭ কোটি ৮৮ লাখ টাকা।

এদিকে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি আর সরকারের ভুল নীতির কারণে দিন দিন কমে যাচ্ছে আখ চাষ। ২০১৮-১৯ আখ রোপন মৌসুমে ১০ হাজার একর আখ রোপনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও এখনো পর্যন্ত তিন মাসে রোপন হয়েছে মাত্র ৪ হাজার একরের মতো। গত ২০১৭-১৮ আখ মৌসুমে আখ রোপনের লক্ষ্যমাত্র ছিল ১০ হাজার ৫শ একর। কিন্তু সর্বশেষ আখ রোপন করা হয়েছিল মাত্র ৫ হাজার ৬৫ একর।

দিনে দিনে আখ চাষ কমে যাচ্ছে এমন প্রশ্নে মোবারকগঞ্জ সুগারমিল আখ চাষী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মাসুদুর রহমান মন্টু কর্তৃপক্ষের খাম খেয়ালীপনা, অব্যবস্থাপনা আর নানা দুর্নীতির কথা উল্লেখ করে জানান, আখচাষ লাভজনক কিন্তু মিল কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণে চাষ কমে যাচ্ছে। আখ রোপনের সময় সার বিতরণে অনিয়ম, আখ বিক্রির টাকা পরিশোধে অনিময়সহ নানা কারণে আখচাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে কৃষকরা।

মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইউছুপ আলী শিকদার জানান, মিল গোডাউনে প্রায় ৩০ কোটি টাকার বেশি চিনি অবিক্রিত পড়ে রয়েছে। চিনি বিক্রি না হওয়ায় চাষীদের আখ বিক্রির পাওনা পরিশোধ করা যাচ্ছে না। চলতি মৌসুমে চিনিকলটি সচল রাখতে ৩৪ কোটি টাকা ভর্তুকি চাওয়া হয়েছিল বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশনের কাছে। কিন্তু দুই মাস হতে চললেও এখনো কোন টাকা পাওয়া যায়নি। তবে টাকার ব্যবস্থা হলেই আগে কৃষকদের টাকা পরিশোধ করা হবে বলে যোগ করেন মিলটির এই শীর্ষ কর্মকর্তা।

/পিবিডি/পি.এস

ঝিনাইদহ,কৃষক,মোবারকগঞ্জ চিনিকল

সারাদেশ

অনুসন্ধান করুন
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close