• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

মুজিব কন্যা এগিয়ে যান, রক্তের বন্যায় ভেসে যাবে সু চির অর্জন?

প্রকাশ:  ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ০২:৩৮ | আপডেট : ১০ অক্টোবর ২০১৭, ১৮:৫২
পীর হাবিবুর রহমান

আমাদের জাতির জনক, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা এগিয়ে যান। মিয়ানমারের সামরিক জান্তার হাতে রোহিঙ্গাদের গণহত্যার বিরুদ্ধে বিশ্ববাসীর সামনে মানবতার লড়াইয়ে যে পতাকা উত্তোলন করেছেন সেটি সমুন্নত রাখুন। যুগের পর যুগ সামরিক শৃঙ্খল কবলিত মিয়ানমার বা বার্মার সামরিক শাসকের দুঃশাসনে অধিকার হারা মানুষের অবর্ণনীয় বেদনার কথা দুনিয়াবাসী জানতে পারেনি। এবারই প্রথম গোটা দুনিয়া আপনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ যেভাবে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছে, বর্বরতার বিরুদ্ধে মানবতার জয়গান গেয়েছে; তাতে গোটা বিশ্ব প্রবল ঝাঁকুনি খেয়েছে।

অবাক বিস্ময়ের সঙ্গে দেখেছে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী কিভাবে আরাকান রোহিঙ্গাদের ভিটে মাটি ছাড়া করে শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলার নৃশংসতার নতুন নজির স্থাপন করেছে। হিটলার, মসোলিনী, পাকিস্তানের ইয়াহিয়া ও টিক্কাখানের বর্বরতার উত্তরাধিকারিত্ব নিয়ে বারে বারে জাতিগত দাঙ্গা নতুবা সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ নারী ধর্ষণ, শিশু হত্যা এমনকি অসহায় বৃদ্ধদের রক্তের নেশায় কিভাবে উন্মত্ত হয়ে উঠেছে, বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করা জাতির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলাদেশ ও তার জনগণ এ পর্যন্ত প্রায় ৮ লাখ রোহিঙ্গা শরণানার্থীর আশ্রয় দিয়েছে, খাবার দিচ্ছে, গভীর ভালোবাসায় শরণার্থী শিবিরে সর্বাত্মক সহযোগিতা নিয়ে ছুটে যাচ্ছে।

সম্পর্কিত খবর

    এদিকে, উদ্ভুত পরিস্থিতিতে মিয়ানমারের গণতন্ত্রের নেত্রী ও আধুনিক বার্মার জনক অন সান কন্যা অন সান সু চির জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণ পর্যবেক্ষকদের কাছে সমালোচিত হয়েছে। বার্মার সামরিক জান্তা হিটলার, ইয়াহিয়ার উত্তরসূরী মিন উই হিলাইংয়ের নিষ্ঠুরতা ও নৃসংশতার সহযোগী হিসাবে শান্তিকন্যা বা শান্তিতে নোবেল বিজয়ী, জীবন-যৌবন উৎসর্গ করা চিরসংগ্রামী অন সান সু চিকে একপাল্লায় তুলে দিয়েছে। আমি এখনো আশাবাদী রোহিঙ্গাদের রক্তের বন্যায় বিশ্বের মানবতাকামী মানুষের আরাধ্য ধন গণতন্ত্রের সংগ্রামের মহান নেত্রী সু চির সারাজীবনের অর্জন ভেসে যেতে পারে না। সু চি কঠিন অগ্নিপরীক্ষার মুখোমুখি। সবার দৃষ্টি ছিল জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে তিনি কি বলছেন, তা শোনার। গভীর আগ্রহ ও ব্যাকুলতা নিয়ে বাংলাদেশই নয়, উপমহাদেশই নয়; বিশ্বের মানবিক শক্তি অপেক্ষায় ছিল সু চি কি বলছেন তা শোনার জন্য।

    জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে সু চি রাখাইনদের নৃ-গোষ্ঠী হিসাবে স্বীকৃতি না দিয়ে বাঙালি বলে কুখ্যাত সেনাশাসন মিন উন হিলাইংয়ের ভাষায় কথা বলেছেন। গণহত্যার বর্বোরোচিত নৃসংশতার চিত্রকে এড়িয়েই জাননি, প্রশ্ন তুলেছেন রোহিঙ্গারা কেন বাংলাদেশে চলে যাচ্ছে। তিনি বলেছেন পরিচিতি নিয়ে তাদের ফিরিয়ে নেয়া হবে। সকল ধর্ম ও জাতিগোষ্ঠীর নিরাপত্তা দেয়া হবে। কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়ে সেনাশাসকদের সঙ্গে আপোসকামীতার সুরে সু চি বর্বোরোচিত গণহত্যার অভিযানকে সমর্থন করেছেন বলে নিন্দার ঝড় উঠেছে। অভিযোগের তীর সবাই তার দিকে ছুঁড়ছেন।

    সু চি একটি কথা বলেছেন, তাদের গণতন্ত্র মাত্র ১৮ মাসের, যেটি ভঙ্গুর। সেখানে সামরিক শাসকরা দেশ গঠনে কাজ করেছেন। আর তারা গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠার কাজ করছেন। অর্থাৎ এভাবে ধরে নেয়া যায়, ১৮ মাসের গণতান্ত্রিক শাসনে দীর্ঘ সামরিক শাসন কবলিত মিয়ানমারের সামরিক শক্তির সামনে তিনি কতটা অসহায়। বিশ্বের মানবিক শক্তির চাপ যত আসবে, একজন গণতন্ত্রের নেত্রী হিসাবে সু চির শক্তি ততই বাড়বে। সু চি আরো বলেছেন, তারা যুদ্ধ চান না, বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক চান। শান্তি ও বন্ধুত্ব চান, সীমান্তে নিরাপত্তা নিশ্চিত চান, শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেবেন।

    সু চির ভাষণের দু’দিন আগে দেয়া সেনাপ্রধান মিউ অন হিলাইংয়ের ভাষণ ছিল সু চির ওপর মনস্তাত্বিক চাপ। অসহায় রোহিঙ্গা মুসলমানরা কতটা নির্যাতিত ও অবহেলিত সেটি বিশ্ববাসীর চেয়ে সু চি ভালো জানেন। সেখানে তিনি অসহায়ত্বের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কঠিন অগ্নি পরীক্ষার মুখে চতুরতার সঙ্গে ভাষণ রাখলে ১৮ মাসের ভঙ্গুর গণতন্ত্রের কথা বলে তার অবস্থান বিশ্ব বিবেকের সামনে তুলে ধরতে ভুলেননি। এমনকি তিনি কফি আনান কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়নের কথাও বলেছেন।

    এমন পরিস্থিতিতে সু চির বর্ণাঢ্য অতীত সামনে নিয়ে আমরা তার বক্তব্যকে ইতিবাচকভাবে বিবেচনা করতেই পারি। কারণ আমরা যুদ্ধ বা শত্রুতা চাচ্ছি না। বিশ্বময় মানবতাবাদী, গণতান্ত্রিক শক্তির কাছে বার্মার সামরিক বাহিনীর চেয়ে গণতন্ত্রের নেত্রী সু চিই অনেক আপনজন, বিশ্বাস ও নির্ভরতার জায়গা। অন সান সু চির পিতা অং সান তার দেশের জাতির জনক হলেও গুপ্তঘাতকের হাতে জীবন দিয়েছিলেন। সু চি তার তা ক্ষিন চি এবং দু’ভাই লিন ও অন সান ও’র সাথে রেঙ্গুনে বড় হয়েছিলেন। রেঙ্গুন মানে বর্তমান ইয়াঙ্গুন। তার পিতা আধুনিক বর্মি সেনাবাহিনী গঠন করে আলোচনার পথে ব্রিটিশ শাসন থেকে বার্মাকে স্বাধীন করেছিলন। সেই স্বাধীনতা তিনি ভোগ করতে পারেননি। ঘাতকের হাতে জীবন দিতে হয়েছিল। সু চির ভাই লিন ৮ বছর বয়সে বাড়ির শোভবর্ধক লেকে ডুুবে মারা যান। অন সানও পরে আমেরিকার নাগরিকত্ব নিয়ে ক্যালিফোর্নিয়ার সানডিয়াগোতে প্রবাসী হন। লিনের মৃত্যুর পর তাদের পর বাসা বদল ইনয়া লেকের কাছে ৫৪ ইউনিভার্সিটি এভিনিউয়ের এক বাড়িতে চলে আসেন। সু চি এখানে এসে বহুরকম অভিজ্ঞতাসম্পন্ন, রাজনৈতিক মতাদর্শী ও ধর্মানুসারীদের সঙ্গে পরিচিত হন।

    বার্মার শৈশব জীবনে তিনি মোথোডিস্ট ইংলিশ হাইস্কুলে বেশি সময় পড়েছেন। সেখানে বিভিন্ন ভাষা শেখার দক্ষতার কারণে সুপরিচিত ছিলেন। বর্মী, ইংরেজি, ফরাসি ও জাপানি ভাষায় কথা বলতে পারতেন। ধর্মীয় বিশ্বাসে তিনি থেরোবাদী বুদ্ধ। সু চির মা ক্ষীন চি নবগঠিত বার্মা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেন। ১৯৬০ সালে তাকে ভারত ও নেপালে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব দেয়া হয়। সু চিও তার সঙ্গে যান। নয়াদিল্লীর কনভেন্ট অব জিসাস এন্ড মেরি স্কুলে পড়াশোনা করেন তিনি। ১৯৬৪ সালে দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে লেডি শ্রী রাম কলেজ থেকে রাজনীতি বিষয়ে ডিগ্রি পাস করেন। ১৯৬৭ সালে অক্সফোর্ড থেকে দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে গ্র্যাজুয়েট করেন। রাজনীতিতে স্নাতোকোত্তর ডিগ্রিও অর্জন করেন। স্নাতক পাসের পর জনপ্রিয় বর্মী পপ গায়িকা মা থান ইয়ের সাথে বসবাস করতে থাকেন। এসময় তিন বছর তিনি জাতিসংঘে কাজ করেন।

    অক্সফোর্ডে থাকাকালীন লুঙ্গি আর বার্মিজ থামি পরে অনিন্দ্য সুন্দরী সু চি যখন সাইকেল চালিয়ে যেতেন তখন অনেক তরুণের হার্টব্রিট বেড়ে যেত। কিন্তু তার প্রেম গড়ে উঠেছিল ড. মাইকেল এরিসের সঙ্গে। ১৯৭২ সালে ১ লা জুনে সু চি এবং এরিস বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। পরের বছর লন্ডনে তাদের প্রথম সন্তান আলেকজেন্ডার এরিসের জন্ম হয়। ২য় সন্তান কিম জন্ম দেন ১৯৭৭ সালে। পরবর্তীতে তিনি বর্মী সাহিত্য বিষয়ে লন্ডনে এমফিল ডিগ্রি নেন। ১৯৮৮ সালে সু চি বার্মায় ফেরেন অসুস্থ মায়ের দেখাশুনার জন্য।

    স্বাধীনতার ৭৭ বছরের ৫৫ বছর ধরে সামরিক শাসন কবলিত বার্মার জনগণের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তিনি যুক্ত হন। তিনি হয়ে উঠেন গণতন্ত্রের নেত্রী। তার স্বামী ১৯৯৫ সালের ক্রিসমাসে বার্মায় এলে তাদের শেষ দেখা হয়। কারণ সু চি বার্মাতেই থেকে যান গণতন্ত্রের সংগ্রামে। সামরিক শাসকরা এরিসকে আর বার্মার ভিসা দেয়নি। ১৯৯৭ সালে প্রোস্টেট ক্যান্সার ধরা পরে এরিসের। জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনান এবং পোপ ২য় জনপলসহ বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তি ও আন্তর্জাতিক সংস্থার অনুরোধের পরও বার্মা স্বৈর শাসক এরিসকে ভিসা দেয়নি। তারা বলে দেয়, এরিসের চিন্তার দায়িত্ব সরকারের নয়; সু চির ই উচিত তাকে দেখতে যাওয়া। গৃহবন্দীত্ব থেকে সাময়িক ছাড়া পেলেও সু চির আশংকা ছিল সামরিক জান্তা দেশের বাইরে তাকে আর ফিরতে দিবে না। তাই তিনি যাননি।

    ১৯৯৯ সালের ২৭ মার্চ এরিস তার ৫৩ তম জন্মদিনে মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৮৯ সালে সু চি গৃহবন্দী হবার পর থেকে তাদের মাত্র ৫ বার দেখা হয়েছে। সু চির সন্তানরা মায়ের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন। ২০১১ সাল থেকে যুক্তরাজ্য থেকে মিয়ানমারে এসে তারা মায়ের সঙ্গে দেখা করে যান। ২০০৮ সালে দুই মেয়ে মিয়ানমারে ঘূর্ণিঝড় নার্গিস আঘাত হানলে সু চির রথ তীরবর্তী ভাঙাচোরা বাড়ির ছাদ উড়ে যায়। বিদ্যুত চলে যাওয়ায় অন্ধকারে তাকে থাকতে হয়। রাতের বেলায় তিনি মোমবাতি ব্যবহার করতেন। সামরিক শাসকরা তাকে জেনারেটর পর্যন্ত দেয়নি।

    ২০০৯ এর আগস্টে বাড়িটা মেরামত ও সংস্কার করা ঘোষণা করা হয়। আর ২০১০ সালে ১৩ নভেম্বর সু চি গৃহবন্দীত্ব থেকে মুক্তি পান। সু চি একজন বড় মাপের লেখকও। সু চি ও এরিসকে নিয়ে লুক বেসনের ‘দ্যা লেডি’ চরিত্র নির্মিত হয়েছে। ভারতনট্যম নৃত্যশিল্পী রোক্ষীনি বিজয় কুমার ‘দ্যা লেডি অব বার্মা নাটকে একক অভিনয় করে যাচ্ছনে। গৃহবন্দী থাকাকালে সু চির গাইনী সমস্যার অস্ত্রোপচারই হয়নি, পায়ে অপারেশনও হয়েছে। চোখের অপারেশন হয়েছে ২০১৬ সালের এপ্রিলে। তার চিকিৎসক বলেছেন, তার শারিরীক সমস্যা নেই তবে ওজন মাত্র ৪৮ কেজি।

    গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ায় কয়েক মেয়াদে প্রায় ১৫ বছর গৃহবন্দী ছিলেন সু চি। গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় অহিংস লড়াই সংগ্রামের নজির স্থাপনের জন্য ১৯৯১ সালে শান্তিতে নোবেল পান তিনি। ২০১৫ সালে নভেম্বরে মিয়ানমারের সাধারণ নির্বাচনে সু চির এনএলডি বিপুল জয় পায়। ২০১৬ সালের শুরুর দিকে দলটি ক্ষমতা গ্রহণ করে। কিন্তু সামরিক জান্তা সংবিধানে সংশোধনী এনে বিদেশী বিয়ে করার অজুহাত দেখিয়ে সু চির প্রেসিডেন্ট হবার পথ রুদ্ধ করে দেয়। প্রেসিডেন্ট হিসাবে তিনি ঘনিষ্ঠ সহযোগী থিন কিউকে বসান। সু চি নিজে হন দেশটির স্ট্যাট কাউন্সিলর ও পররাষ্ট্র মন্ত্রী। সেনাবাহিনীর সঙ্গে মানিয়ে চলছে তার সরকার।

    গত বছর অক্টোবরে মিয়ামারের রাখাইন রাজ্যে পুলিশের চৌকিতে সন্ত্রাসী হামলা হয়। হামলার জেরে রাখাইনে অভিযান শুরু করে সেনা ও পুলিশ। টার্গেট তাদের রোহিঙ্গা মুসলমান। অভিযানে হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগের মতো মানবতা বিরোধী অপরাধ সংগঠিত হয়। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন স্পষ্ট করে বলেছে, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিষয়ে সু চির সরকার উদাসীনতার পরিচয় দিয়েছে। সু চি জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত নাকচ করেছেন। সমালোচকরা বলেছেন, সু চি আর সু চি নেই; ভোট আর ক্ষমতায় তার হিসাব। আরেক নোবেল লরিয়েট ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, সু চিকে এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

    এবারের গণহত্যার কারণে যুক্তরাজ্যের দেয়া সম্মাননা সু চির বিরুদ্ধে বাতিল করেছে। সু চি নোবেল পুরষ্কার নিয়ে বলেছিলেন, মানবাধিকারের প্রত্যাখান ও ঘৃণার ফলে বিশ্বজুড়ে যে বর্বরতার সূত্র হয়, তা থেকে মানুষের বিবেকে জেগে উঠে প্রবল প্রতিরোধ, সেই প্রতিরোধ থেকে জন্ম নেয় মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণা; যেখানে স্পষ্ট ঘোষিত হয়েছে এমন এক বিশ্ব ব্যবস্থার প্রতি সমর্থন, যেখানে প্রত্যেক মানুষ বাক স্বাধীনতা ও ধর্ম বিশ্বাস প্রতিপালনের অধিকার ভোগ করবে এবং ভীতি ও অভাব থেকে মুক্তির অধিকার অর্জন করবে।

    আজকের রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর সেনাবাহিনীর যে উচ্ছেদ অভিযান, যে গণহত্যা ধর্ষণ ও বর্বরতা চলছে, যেভাবে নৃশংসতার নজির স্থাপন হচ্ছে; সেখানে যে সু চি যৌবনে আপোস করেননি, জীবনের পড়ন্তবেলায় আপোস করবেন কি না? এই প্রশ্ন আজ বিশ্ব মানবতার তার প্রতি। তিনি ক্ষমতায় আসার আগে আরেকবার ব্যালট বিপল্পে অভিষিক্ত হলেও সেনাশাসকরা সেটি বানচাল করেছিল। আজকের সু চিকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, রোহিঙ্গাদের রক্তে তার অতীতের ত্যাগ, তিতীক্ষা, সংগ্রাম ভেসে যাবে নাকি তিনি সামরিক জান্তার সঙ্গে আপোসকামীকার পথ ছেড়ে, ক্ষমতার মোহ থেকে বেরিয়ে এসে বিশ্বমানবতার আকুতি ও ডাকের প্রতি মানবতার লড়াইয়ে নিজেকে উৎসর্গ করবেন? সত্য ও মানবতার প্রতি অবস্থান নিলে তার ক্ষমতা চলে যেতে পারে, তিনি কারাবন্দী হতে পারেন; তাতে কি আসে যায়? শতাব্দীর পর শতাব্দী, যুগের পর যুগ মানব কল্যাণের রাজনীতিতে নিবেদিত প্রাণ রাষ্ট্রনায়ক ও রাজনীতিবিদরা আদর্শ ও অঙ্গিকারের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে জীবন উৎসর্গ করেছেন। সু চির সামনে প্রশ্ন, মিয়ানমারের সামরিক জান্তার বর্বর, নৃশংসতার সাফাই গাইবেন নাকি মানবিক হৃদয় দিয়ে রোহিঙ্গা মুসলমানই নয়; বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের পক্ষে অবস্থান নিবেন? সেটি সু চির বিষয়।

    আজকের বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য মানবিকতার যে সীমান্ত খুলে দিয়েছে, যে আশ্রয় ও সাহায্য দিয়েছে, দিয়েছে সহানুভূতি, ভালোবাসা, প্রেম; সেটি মানবকল্যাণের জয়ধ্বনি করছে। জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগদান করতে গিয়ে মুজিব কন্যা শেখ হাসিনা সুপার পাওয়ার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নিয়ে বলেছেন, উনার কাছে চাওয়ার কি আছে? এই ওদ্ধ্যত, এই জাতীয়বাদী শক্তি মুজিব কন্যা বলেই সম্ভব হয়েছে। ১৯৭৪ সালে দেশের জনগণ যখন খাদ্য সংকটের মুখোমুখি তখন হোয়াইট হাউস সম্মান সমাদর দিলেও আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, মার্কিন খাদ্য সাহায্যের প্রশ্নে যদি সেটি শর্তযুক্ত হয়; সেটি আমি চাই না। তার রক্ত ও আদর্শ যার ধমনীতে সেই শেখ হাসিনা বুকের পাটা নিয়ে এমন কথাই বলতে পরেন। কিন্তু পররাষ্ট্র সচিব যখন বলেন, শেখ হাসিনার দিকে ছুটে আসা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ছবি দেখে ‘যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের পাশে আছে।’ তখন বুঝতে বাকি থাকে না সেগুনবাগিচার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ব্যর্থ, ফালতু। রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার ভাষা ও চিন্তার গভীরতা উপলব্দি করার ক্ষমতা তাদের নেই। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা জাতিসংঘে ৬টি প্রস্তাব দিয়েছেন। এগুলো হচ্ছে- এক. রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর সব ধরনের নিপীড়ন এই মুহূর্তে বন্ধ করতে হবে।

    দুই. নিরপরাধ বেসামরিক জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য মিয়ানমারের ভেতরে নিরাপদ এলাকা (সেইফ জোন) তৈরি করা যেতে পারে, যেখানে তাদের সুরক্ষা দেওয়া হবে।

    তিন. বলপ্রয়োগের ফলে বাস্তুচ্যুত সব রোহিঙ্গা যেন নিরাপদে এবং মর্যাদার সঙ্গে মিয়ানমারে তাদের বাড়িতে ফিরতে পারে, সেই ব্যবস্থা করতে হবে।

    চার. রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনে কফি আনান কমিশনের পূর্ণাঙ্গ সুপারিশ অবিলম্বে নিঃশর্তভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।

    পাঁচ. রোহিঙ্গাদের ‘বাঙালি’ হিসেবে চিহ্নিত করার যে রাষ্ট্রীয় প্রপাগান্ডা মিয়ানমার চালাচ্ছে, তা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।

    ছয়. রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে না ফেরা পর্যন্ত তাদের জরুরি মানবিক সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে হবে ভ্রাতৃপ্রতিম মুসলিম দেশগুলোকে।

    মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাই কমিশনার হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা দিল্লীকে বোঝাতে পেরেছেন বাংলাদেশ আমাদের বন্ধু। তাদের পাশে আমাদের থাকতেই হবে। আপনি এগিয়ে যান, চীনের সঙ্গে কথা বলুন, রাশিয়ার সঙ্গে কথা বলুন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়কদের সঙ্গ কথা বলুন। আমরা মহান মুজিবের নেতৃত্বে নির্যাতিত, নিপীড়িত হিসাবেই যুদ্ধ জয়ের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হয়েছি। আমরা নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের ক্রন্দন উপলব্ধিই করিনি, হৃদয়াঙ্গম করেছি। বিশ্ব বিবেক জাগ্রত হচ্ছে। মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি অব্যাহত রাখতে হবে। রোহিঙ্গা শরনার্থীদের ফিরিয়ে নিতে হবে। তাদের নিরাপত্তা, ভোটাধিকার ও নাগরিকত্ব সামরিক জান্তার শক্তির ওপর দাঁড়ানো অন সান সু চিকে দিতেই হবে। ইতিহাস মানবিক শক্তিকেই লালন করে, দানব শক্তিকে। আপনি মানবিক শক্তির প্রতিনিধিত্ব করছেন। অন সান সু চিকে এই অগ্নি পরীক্ষার মুখে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, মানব শক্তি নাকি দানব শক্তির পক্ষে থাকবেন? মানব শক্তি ইতিহাসে উজ্জল, বর্ণময় হয়ে উঠে; দানব শক্তি আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়।

    লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close