• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

অতিউৎসাহী, চাটুকার, বাঁচালদের সামাল দিন

প্রকাশ:  ২২ জুলাই ২০২৩, ২২:৪৯
সৈয়দ বোরহান কবীর

১৭ জুলাই। নিরুত্তাপ ঢাকা-১৭ আসনের উপ-নির্বাচনের ভোট গ্রহনের শেষ পর্যায়। অধিকাংশ ভোট কেন্দ্র খাঁ খাঁ করছে। বিকেল সাড়ে তিনটা। বনানী একটি কেন্দ্রে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিরো আলম গেলেন, শেষ মুহুর্তের তদারকির জন্য। ততোক্ষণে নির্বাচনের ফলাফল কি হতে যাচ্ছে, তা মোটামুটি নির্ধারিত। এ সময় ঘটে অঘটন। কিছু অতি উৎসাহীরা (কিংবা ষড়যন্ত্রকারীরা) হামলা করে এই স্বতন্ত্র প্রার্থীকে। পুলিশ নিরাপদ দূরত্বে থেকে তামাশা দেখে। হিরো আলমকে কিল ঘুষি মারার দৃশ্য দ্রুত ছড়িয়ে পরে টেলিভিশনে, সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে। এটি এখন আন্তর্জাতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। স্বাভাবিক এবং সংগত কারণেই এর নিন্দা জানিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশ। তর্কের খাতিরে আমরা যদি ধরেও নেই, বিএনপি এই অপকর্মটি করেছে। সেক্ষেত্রে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কি করলো? বিএনপিতো চাইবেই নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে। একটা ইস্যু তৈরী করতে। সেক্ষেত্রে পুলিশ এবং আওয়ামী লীগের উচিত ছিলো এব্যাপারে বাড়তি সতর্ক থাকা। সেটি কি করতে পেরেছে সংশ্লিষ্টরা?

ঘটনা ঘটে যাবার পর এর অনেক রকম ব্যাখ্যা দেয়া হচ্ছে। নানা রকম আবিষ্কারের অতি উৎসাহী খেলা চলছে। হিরো আলমই আগে আক্রমন করেছেন, এমন প্রচারণায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভেসে বেড়াচ্ছে। কিন্তু এসব কোনটাই গ্রহণযোগ্য নয়। সাধারণ মানুষ এসব বিশ্বাস করছে না। আওয়ামী লীগের অন্ধ সমর্থক ছাড়া সবার ধারণা আওয়ামী লীগের উচ্ছৃঙ্খল কিছু কর্মী এই কান্ড ঘটিয়েছে। একজন প্রার্থীকে সুরক্ষা দেয়া, তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর, সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের। এক্ষেত্রে তাদের ব্যর্থতা কোন ভাবেই উপেক্ষা করার উপায় নেই। সকলেই জানে, ঢাকা-১৭ উপ নির্বাচন বাংলাদেশের জন্য নয়, আন্তর্জাতিক মহলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব, তা প্রমাণের শেষ সুযোগ এই নির্বাচন। ঢাকায় সবচেয়ে অভিজাত এলাকায় এই উপ-নির্বাচন যখন অনুষ্ঠিত হচ্ছিল তখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল বাংলাদেশে অবস্থান করছিলেন। মার্কিন প্রতিনিধিদল সদ্য বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। বিএনপি সহ বেশ কিছু রাজনৈতিক দল একদফা আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। এরকম বাস্তবতায় একটি সুন্দর, সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দেয়া ছিলো নির্বাচন কমিশন এবং সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় দায়িত্ব। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকার এবং নির্বাচন কমিশন ব্যর্থ হয়েছে। হিরো আলমের উপর হামলার ঘটনা যারাই ঘটাক না কেন, এর দায় সরকারের উপরই এসে বর্তেছে। বিএনপি এখন তাদের দাবীর পক্ষে এক অব্যর্থ অস্ত্র হাতে পেল। আন্তর্জাতিক মহল যারা বংলাদেশে একটি অনির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তারা এই ঘটনায় উল্লাসিত।

গত ১৪ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারকে বিভিন্ন ভাবে বিব্রত করছে কিছু অতি উৎসাহী নব্য আওয়ামী লীগ। নানা সময়ে এরা এমন কান্ড করেছে যে সরকারের মাথা হেট হয়েছে। কিন্তু এখন সময়টা ভিন্ন। জটিল রাজনৈতিক সমীকরণের মুখে এধরনের বালখিল্যতার পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে। এই ঘটনার পর পুলিশ বেশ ক’জনকে গ্রেপ্তার করেছে। এটা খুব ভালো উদ্যোগ। ঘটনার নির্মোহ এবং নিরপেক্ষ তদন্ত দরকার। সরকার দলের সমর্থক করুক, বিএনপি করুক, কিংবা হিরো আলম আলোচিত হবার জন্য এই ঘটনা ঘটাক-তা পক্ষপাতহীন ভাবে খুঁজে বের করতে হবে। সরকার দলের সমর্থকরা যদি কেউ এমন কান্ড করে, তাহলে বুঝতে হবে এরা ষড়যন্ত্রকারী। কখনও ধর্ষণ, কখনও চাঁদাবাজি, কখনোবা দুপক্ষের মারামারি। এরা সরকারের জন্য ভয়ংকর ব্যাধি। আওয়ামী লীগ বা সরকারের কোন উপকারে এরা আসে না, আসবে না। এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। আমি খুশী হতাম, ঘটনার পর যদি আওয়ামী লীগের বিজয়ী প্রার্থী হিরো আলমকে দেখতে যেতেন, তাকে সহানুভূতি জানাতেন। ঘটনার পর তার সংবাদ সম্মেলন আমার ভালো লেগেছে। কিন্তু একজন সদ্য নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির কাছে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিলো আরো বেশি। ঘটনার পর প্রথম দিকে আওয়ামী লীগ নেতাদের বক্তব্য ছিলো দায়িত্বশীল। কিন্তু এরপর হিরো আলম কেন্দ্রিক ঘটনা নিয়ে শুরু হলো চাটুকারিতার প্রতিযোগিতা। কোন কোন নেতা এমন বক্তব্য দিচ্ছেন যাতে মনে হচ্ছে হিরো আলমই অপরাধী। চাটুকারদের আবোল-তাবোল বক্তব্য আওয়ামী লীগকেই জনগণের কাছে হাস্যকর করেছে। এখানে দায় এড়ানোর কোন সুযোগ নেই। অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়েও লাভ নেই। বনানী বিদ্যানিকেতনের সামনে ১৭ জুলাইয়ের ঘটনা অনভিপ্রেত, অনাকাঙ্খিত এবং দুর্ভাগ্যজনক। এনিয়ে কাঁদা ছোড়াছুড়ি না করে দরকার নির্ভেজাল তদন্ত। প্রকৃত অপরাধীকে খুঁজে বের করা। এই ঘটনাটিকে খাটো করে দেখার কোন সুযোগ নেই। আমি একে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবেও মনে করি না। বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ, বিতর্কিত এবং অনিশ্চিত করার সুদূর প্রসারী পরিকল্পনার বাস্তবায়ন এই ঘটনা। এরা বাইরের হোক বা সরকারের ঘরের লোক হোক, এরা গণতন্ত্রের শত্রু। এরকম ছোট ঘটনা বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে অনির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতার মসনদে বসিয়েছে। তাই এই ঘটনা অন্য খাতে নেয়ার সুযোগ নেই। একে হালকা ভাবে নিলে কিংবা পাশ কাটাতে চাইলে সরকারেরই ক্ষতি হবে সবচেয়ে বেশি। কেউ নিজের ক্ষতি করতে চায় না। হিরো আলমকে পিটিয়ে, তাকে বিশ্বে পরিচিত করে আওয়ামী লীগের কোন লাভ নেই। বরং ক্ষতি। কিন্তু অতি উৎসাহী এবং চাটুকারদের বক্তব্য এবং কর্মকান্ড এই ঘটনার জন্য আওয়ামী লীগকেই কাঠ গড়ায় দাড় করাচ্ছে। অতি উৎসাহী এবং চাটুকারদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কতিপয় বাঁচাল মন্ত্রী।

তৃতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকারের সবচেয়ে বড় ‘আপদ’ হলো কতিপয় দায়িত্ব জ্ঞানহীন অর্বাচীন মন্ত্রীর কথাবার্তা। এদের মধ্যে লাগামহীন অতিকথনের প্রতিযোগিতা হলে কে চ্যাম্পিয়ন হবে তা বলা মুশকিল। তবে একজন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী যে অসংলগ্ন কথা বলার প্রতিযোগিতায় এগিয়ে আছেন, তা দেশের সাধারন জনগণের অজানা নয়। তিনি কখনো বলেন ‘বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক স্বামী স্ত্রীর মতো।’ আবার রেগে গেলে বলেন ‘গণতন্ত্র সম্মেলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ না জানানো যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ঢং।’ একবার তিনি বললেন ‘ভারতকে বলেছি শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখতে হবে।’ পরদিন রেগে বললেন ‘কি তাজ্জব। এমন কথা বলিনি। সাংবাদিকরা আমার বক্তব্য টুইষ্ট করেছে।’ হিরো আলমের ঘটনার সময় তিনি দেশে ছিলেন না। বিদেশ থেকে আসার পর তিনি গণমাধ্যম কর্মীদের মুখোমুখি হলেন। গণমাধ্যমের তিনি খুবই প্রিয়। কারণ যেকোন বিষয়ে অকূটনৈতিক সুলভ মেঠো বক্তব্য তিনি গড়গড় করে বলে ফেলেন। মিডিয়ার জন্য নানা উপাদেয়, মুখরোচক খোরাক দিতে তিনি সিদ্ধ হস্ত। গত বুধবার (১৯জুলাই) ১২ দেশের দূতাবাসের বিবৃতি নিয়ে প্রশ্ন করতেই তিনি রেগে গেলেন। তিনি নির্বাচনে একজন প্রার্থীর উপর হামলার ঘটনায় সঙ্গে তুলনা করলেন আমেরিকায় লোক মরে যাওয়ার ঘটনার। উত্তেজিত মন্ত্রী বললেন, আপনারা কেন তাদের জিজ্ঞাসা করেন না? প্রতিদিন বিভিন্ন দেশে লোক মারা যায়। তখন তারা কেন বিবৃতি দেয় না? আর বাংলাদেশ হলেই মগের মুল্লক পায় ওরা। এভাবে বিবৃতি দেয়া গ্রহণযোগ্য নয়।’ ওমা একি কথা শুনি আজ মন্ত্রীর মুখে। এই মন্ত্রী কদিন আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের নিয়ে উচ্ছ্বাসিত হলেন। উজরা জেয়া বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায় না, এনিয়ে মন্ত্রীর খুশি দেখে তো আওয়ামী লীগের কর্মীরা বলতে শুরু করলো, বিএনপির সাথে যুক্তরাষ্ট্র নেই। এই মন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে দুর্দিনে উদ্বাস্তু অবস্থায় তাকে ঠাই দেয়ার কথা স্মরণ করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি কৃতজ্ঞতায় নুইয়ে পরলেন। ‘যতোখুশী বিদেশী পর্যবেক্ষকদের স্বাগত জানাতে’ উন্মুক্ত মন্ত্রী হিরো আলমের উপর হামলার ঘটনার নিন্দা জানিয়ে ১২ দেশের বিবৃতিতে ক্ষুদ্ধ কেন, বুঝলাম না। ১২ দেশের বিবৃতির সমালোচনা করে মন্ত্রী কি আওয়ামী লীগকেই ঐ ঘটনার জন্য আসামীর কাঠগড়ায় দাড় করালেন না? দুটি কারণে তার বক্তব্য অগ্রহণযোগ্য এবং অপ্রাসঙ্গিক। প্রথমত: সব দেশেই নানা কারণে মানুষ মারা যায়। সব ঘটনায় মৃত্যু নিয়ে বিশ্ব আলোড়িত হয় না। যুক্তরাষ্ট্র, কিংবা ফ্রান্সের উদাহারণ মন্ত্রী দিয়েছেন। বাংলাদেশেও তো জমি-জমা, নানা স্বার্থে মানুষ মারা যায় প্রতিদিন। এসব নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিবৃতি দেয় না। ঐ সব আইন শৃঙ্খলা জনিত অপরাধ। নির্বাচনে একজন প্রার্থীর উপর হামলার ঘটনা আর সহিংসতায়, দূর্ঘটনায় মৃত্যু এক নয়। এতটুক বোঝার বোধ-বুদ্ধি যদি একজন মন্ত্রীর না থাকে, তাহলে সেক্ষেত্রে আমার কিছু বলার নেই। দ্বিতীয়ত: নির্বাচন নিয়ে গত একবছরের বেশি সময় ধরে কূটনীতিকরা নানা তৎপরতায় লিপ্ত। একটি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে এধরনের প্রকাশ্য হস্তক্ষেপ কতটা যুক্তিযুক্ত সে প্রশ্ন রয়েছে। কিন্তু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এনিয়ে কখনো শক্ত অবস্থান নিতে পারেনি। বরং সরকারের পক্ষ থেকে এধরনের হস্তক্ষেপকে স্বাগত! জানিয়েছে। আওয়ামী লীগ বিভিন্ন দূতাবাসের আমন্ত্রণে বৈঠক করেছে। এই তো কদিন আগে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষকদের পাঁচ তারকা হোটেলে খাইয়ে দাইয়ে আশ্বস্ত করেছে, নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ এবং সুষ্ঠু হবে। বিদেশীরা তত্ত্ববধায়ক সরকার চায় না এনিয়ে আলোচিত বাঁচালমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ নেতাদের উল্লাস দেশবাসী দেখেছে। তখন আপনি উল্লাসিত হলেন, শিহরিত হলেন, আর এখন আপনি গোস্বা করলেন কেন? যখন সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক চাপ আছে তখন পশ্চিমা দেশগুলোকে ক্ষেপিয়ে তোলা কি পাগলামী না পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র, তা ভেবে দেখা দরকার।

বাংলাদেশের গণতন্ত্র এক কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি। সংবিধানের ধারা অব্যাহত থাকবে কিনা, তা এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। আবার দেশে একটা অসাংবিধানিক শাসন আনার ষড়যন্ত্র চলছে। বিএনপিকে সামনে রেখে সেই নীল নকশা বাস্তবায়নের চেষ্টা চলছে। এই ষড়যন্ত্র নসাৎ করে একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনই হলো বাংলাদেশের জন্য, সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু এই চ্যালেঞ্জকে আরো কঠিন করে তুলছে সরকারের ভেতর থাকা অতিউৎসাহী, চাটুকার এবং বাঁচালরা। এরা অর্বাচীন না ষড়যন্ত্রের অংশ তা নিয়ে আমার ঘোরতর সন্দেহ রয়েছে। এরা একদিকে যেমন সরকারের নীতি নির্ধারকদের বিভ্রান্ত করছে। অন্যদিকে, জনগণের কাছে সরকারের আস্থা নষ্ট করছে। আগামী কয়েকমাস এদের লাগাম টেনে ধরতে হবে। না হলে সর্বনাশ হবে আওয়ামী লীগের, সরকারের এবং জনগণের।

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত

মতামত
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close