• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

নোংরা পুরুষের বিরুদ্ধে অদিতির ঘৃণা প্রতিবাদে অভিবাদন

প্রকাশ:  ১০ মার্চ ২০১৮, ১১:৩৬ | আপডেট : ১০ মার্চ ২০১৮, ১১:৫১
খুজিস্তা নূর-ই-নাহারিন (মুন্নি)

অদিতি বৈরাগী ভিকারুন্নেসা স্কুল এন্ড কলেজের যে সংগঠনটির প্রতিনিধিত্ব করছেন তার নাম ‘৭১ অবিনাশী সত্তা’। ৭১ কে অবিনাশী করে তুলতে অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করেছে ৭ই মার্চ। আর ২০১৮ সালের ৭ই মার্চ, মিছিলের মধ্যে পড়ে ভয়ংকর যৌন নিপীড়নের শিকার হলো অদিতি। এরচেয়ে করুণ, পীড়াদায়ক আর কিছু হতে পারে না।

অদিতি ৭ই মার্চ সন্ধ্যাবেলা ওর ফেসবুকের টাইম লাইনে লিখছে-- “শান্তিনগর মোড়ে এক ঘন্টা দাড়ায়ে থেকেও কোনো বাস পাইলাম না। হেটে গেলাম বাংলামটর। বাংলামটর যাইতেই মিছিলের হাতে পড়লাম। প্রায় ১৫-২০ জন আমাকে ঘিরে দাড়াইলো। ব্যস! যা হওয়ার থাকে তাই। কলেজ ড্রেস পড়া একটা মেয়েকে হ্যারাস করতেসে এটা কেউ কেউ ভিডিও করার চেষ্টা করতেসে। কেউ ছবি তোলার চেষ্টা করতেসে। আমার কলেজ ড্রেসের বোতাম ছিড়ে গেসে । ওড়নার জায়গাটা খুলে ঝুলতেসে। ওরা আমাকে থাপড়াইসে। আমার শরীরে হাত দিসে। আমার দুইটা হাত এতগুলা হাত থেকে নিজের শরীরটাকে বাচাইতে পারে নাই। একটা পুলিশ অফিসার এই মলেস্টিং চক্রে ঢুকে আমাকে বের করে এন্ড একটা বাস থামায়ে বাসে তুলে দেয়। বাকিটা পথ সেইফলি আসছি। প্রচন্ড শরীর ব্যথা ছাড়া আর কোনো কাটাছেড়া নাই। মেন্টালি ভয়াবহ বিপর্যস্ত বাট শারীরিক ভাবে ভালো আছি। আমি এই শুয়োরদের দেশে থাকব না। জয় বাংলা বলে যারা মেয়ে মলেস্ট করে তাদের দেশে আমি থাকব না। থাকব না। থাকব না...”

সম্পর্কিত খবর

    স্ট্যাটাসটি ভাইরাল হয়ে ৪ ঘণ্টায় ৬০০০ প্রায় শেয়ার হয়েছিল, ১৪ হাজারের অধিক লাইক পড়েছিল, আমাদের সময় হলে সবাই চুপ থাকার পরামর্শ দিত, ঘৃণা আর লজ্জায় মেয়েটি শরমে মরে যেত। পারলে আত্মহত্যা করার ইচ্ছে হত। আমার নিজেরও ঠিক ওই বয়সী একটি মেয়ে আছে, অপরিচিত মেয়ের বয়সী মেয়েটির জন্য উদ্বেগ উৎকণ্ঠা বোধ হচ্ছে। বন্ধু-বান্ধবীরা মেয়েটিকে টাইম লাইনে সাহস যোগানোর চেষ্টা করছে দেখে ভাবলাম, ''বাহ মেয়েরা এগিয়েছে বহুদূর, অন্তত প্রতিবাদটুকু করতে শিখেছে'' ।

    কিন্তু একটু পরেই মেয়েটি টাইম লাইন থেকে স্ট্যাটাসটি ডিলিট করেছে। হয়তো ভয়ে, হয়তো অহেতুক জটিলতা এড়াতে। পরে আবার লিখেছে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত নয়, কেবলই ওর কষ্টের কথা শেয়ার করতে চেয়েছে। অনেকে রাজনৈতিক ভাবে পোস্টটি ব্যবহার করছে দেখে অনলি মি করে রেখেছে।

    আমি একেবারে হতভম্ব, প্রতিবাদের ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। ইতিহাসে এ কোন মোড়ে এনে আমাদের দাঁড় করালো----- এমন অসভ্য বর্বরতা ! এই মুহূর্তে মেয়েটিকে না জানি কত সমালোচনা সহ্য করতে হচ্ছে, আসামির কাঠগড়ায় অনেকে হয়তো মেয়েটিকেই দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে। সহজ ভাষায় বলছে, ''আজ বের হওয়ার কি দরকার ছিল, কেন গেছিলা ভিড়ের মধ্যে''। কিন্তু প্রয়োজন হলে কেন যাবে না, মেয়েরা কি মানুষ নয় ! মেয়েটির প্রতি মায়ের মন স্নেহের আদ্রতায় ভিজে যাচ্ছে বারে বার। অলক্ষ্য থেকে অন্য হাজারো অসহায় নিপীড়িত নারী অতীত থেকে যেন বলছে তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ আমরা, ''হোক প্রতিবাদ''।

    ‘মা’ তোমার আত্মবিশ্বাস দেখে বড় ভাল লেগেছিল। এতোটুকুন বাচ্চা একটি মেয়ে অথচ অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে জানো। মেয়েরা প্রতিবাদ করতে জানে না বলেই পুরুষেরা এই নোংরা অসভ্য আচরণকে তাঁদের অধিকার বলেই ধরে নেয়।

    একটি মেয়ে ফুটপাথে একা হেঁটে যাচ্ছে দেখেই অসভ্য পুরুষের চোখ মুখে লালা ঝরবে, নোংরা অঙ্গভঙ্গী করবে, কিছুই না পারলে কুৎসিত ইঙ্গিত করে নিদেন পক্ষে চোখ মারা যেন তাঁদের নিত্য দিনের স্বাভাবিক ব্যবহার। আর ভিড়ের ভেতর একা মেয়ে মানুষ পাওয়া মানে সোনায় সোহাগা। একটি মেয়ের বুক চ্যাটকে দেওয়াতে যেন ওর রাজ্যের সুখ আর আনন্দ।

    সৃষ্টির ধারাবাহিকতায় প্রতিটি পশু-পাখী, পিপীলিকা এমন কি ঘাস ফড়িং এর জীবনে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ এবং যৌনতা খুব স্বাভাবিক একটি ঘটনা মাত্র । কিন্তু প্রতিটি পশুও যৌন সম্পর্ক স্থাপনের আগে ভালোবাসা আর আদরে সঙ্গিনীর মন যোগানোর চেষ্টা করে। কিছু বিকৃতকাম পুরুষই একমাত্র ব্যতিক্রম যে কিনা সুযোগ পেলেই নারীকে নির্যাতন আর অপদস্ত করার মাঝে যৌনতাকে তৃপ্ত করে নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করে।

    ৩০ লক্ষ্য প্রাণের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা, আমাদের বাবা, ভাইয়েরা কী এই জন্যই দেশটি স্বাধীন করেছিলো! আমাদের মা, বোনেরা যে ত্যাগ স্বীকার করেছিল, আত্মাহুতি দিয়েছিল তা কি এসব নোংরা অসভ্য পুরুষের লিপ্সাকে চরিতার্থ করার জন্য কেবলই! স্বাধীনতা কি পুরুষের একার অধিকার?

    ৭১ এর বীরঙ্গনা নারীদের হাহাকার বাংলার আকাশ থেকে কখনো মুছে যাবে না কোন কালেও কিন্তু স্বাধীন দেশে প্রতিনিয়ত নারী অপমানিত হবে, নিপীড়িত-অত্যাচারিত হবে, নিগৃহীত হবে অথচ বিচার হীনতায় নীরবে কাঁদবে এ কেমন কথা ! বিচারহীনতার সংস্কৃতি আর কতকাল ? নিজেকে অপরাধী মনে না করে বিনা কারণে লজ্জিত না হয়ে তোমার সাহসী উচ্চারণ, অসভ্য নোংরা পুরুষদের প্রতি উদগিরিত ঘৃণা, কন্যাসম তোমার প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান আর ভালোবাসার আনন্দে আপ্লুত আমি আজ।

    আমাদের দেশ স্বাধীন হয়েছে ঠিকই কিন্তু নারীরা এখনও পরাধীন, পুরুষের কাছে এখনও কেবলই পণ্য, কেবলই সম্ভোগের সামগ্রী। মাগো তোমায় দেখে, তোমার প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর আমায় আশাবাদী করে, স্বপ্ন দেখায়। এই দেশ তোমারও, স্বাধীনতা তোমার জন্মগত অধিকার।

    সত্যিকারের আদর্শিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ রাজনীতিবিদ কখনো পথভ্রষ্ট হতে পারেন না যেমন সত্য প্রকারন্তরে এতো বড় দলের মধ্যে খারাপ নোংরা কিছু আবর্জনা থাকতেই পারে, ফালতু বহিরাগত বা অসভ্যতা করার জন্য মিছিলে অনুপ্রবেশকারী হতেও পারে, আবার ষড়যন্ত্রকারীও হতে পারে, ''জয় বাংলা'' শ্লোগানকে কলঙ্কিত করার ঘৃণ্য উদ্দেশ্যে অশুভ পঁয়তারাও হতে পারে । যেই হোক দ্রুততার সাথে পরিচয় বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনা হোক। মেয়ে মানুষ দেখলেই যারা হামলে পড়ে, নির্দ্বিধায় যত্রতত্র হাত চালায় এমন কুলাঙ্গারদের ঐতিহ্যবাহী সংগঠন ধারন করতে পারে না কিছুতেই। এমন নোংরা কতিপয় অসভ্য পুরুষের জন্য পুরো দল বদনামের বোঝা নিবে কেন!

    লেখক: সম্পাদক, পূর্বপশ্চিম বিডি.নিউজ

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close