• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

বিদেশে পালাচ্ছে মাদক ব্যবসায়ীরা

প্রকাশ:  ২২ মে ২০১৮, ০১:১৭
পূর্বপশ্চিম ডেস্ক
প্রতীকী ছবি

সারা দেশে কথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে মাদক বিক্রেতাদের মৃত্যুর ঘটনায় নিজেদের বাঁচানোর পথ খুঁজছে চট্টগ্রামের মাদক ব্যবসায়ীরা। যাদের অধিকাংশই এখন গা-ঢাকা দিয়েছে। কেউ কেউ বিদেশে পাড়ি দিয়েছে। অনেকে পাড়ি দেয়ার চেষ্টা করছে। আর এ বিষয়টি নজরে আসেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার মো. কামরুজ্জামান এই সত্যতা স্বীকারও করেছেন।

তবে তিনি বলেন, প্রথমে আসেনি এখন পুরোটাই নজরে। গা-ঢাকা দেয়া মাদক ব্যবসায়ীদেরও খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে। তিনি বলেন, চট্টগ্রামে বন্দুকযুদ্ধে দুই মাদক বিক্রেতাসহ সারা দেশে সাঁড়াশি অভিযানে গোলাগুলির ঘটনায় কয়েকজন মাদক বিক্রেতা নিহত হয়। এতে ভিত নড়ে উঠে চট্টগ্রামের মাদক ব্যবসায়ীদের। এদের অধিকাংশই ইতিমধ্যে গা-ঢাকা দিয়েছে। তাদের মধ্যে ইয়াবা পাচার করে রাতারাতি কোটিপতি হওয়া মাদক ব্যবসায়ীরা কেউ কেউ বিদেশে পাড়িও জমিয়েছে। তবে তা সংখ্যায় কম। মাদক ব্যবসায়ীদের ধরতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিমান ও স্থলপথে বিশেষ নজর রাখা হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, গত ১৭ই মে চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় মাদকের আখড়া বরিশাল কলোনিতে র‌্যাব ও মাদক বিক্রেতাদের গোলাগুলিতে হাবিবুর রহমান প্রকাশ মোটা হাবিব (৪২) ও মো. মোশাররফ (২২) নামে দুই মাদক বিক্রেতার মৃত্যু হয়।

সম্পর্কিত খবর

    এরপর গত কয়েকদিনে সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানে আরো কয়েকজনের মৃত্যু ঘটে। আর এতেই মাদক বিক্রেতাদের কাছে মেসেজ পৌঁছে যায়। ফলে তাদের বুকে কাঁপন ধরে। তারা এখন মাদক পাচার ও বিক্রির চেয়ে নিজেকে বাঁচাতে গা-ঢাকা দিয়েছে। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম মহানগর ও জেলা পুলিশের তৈরি মাদক ব্যবসায়ীদের তালিকা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর হাতে পৌঁছেছে। প্রধানমন্ত্রী মাদক ব্যবসায়ীদের কোনো ছাড় দিতে নারাজ। র‌্যাব প্রধানও বলেছেন মাদক থাকলে তা র‌্যাব কার্যালয়ের সামনে রেখে যেতে। কিন্তু কোনো কিছুতেই কান দেয়নি মাদক ব্যবসায়ীরা।

    ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযানে নামে। চট্টগ্রাম পুলিশ সুপার নুরে আলম মিনা বলেন, ইয়াবা পাচারকারীদের তালিকা তৈরি করতে গিয়ে চট্টগ্রামে রাতারাতি গজে উঠা শতশত কোটিপতির সন্ধান মিলেছে। এ নিয়ে গঠিত তদন্ত প্রতিবেদন সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পাঠানো হয়েছে। যেখান থেকে নির্দেশনা পেয়ে আমরা অভিযানে নেমেছি। তিনি বলেন, চট্টগ্রামে ইয়াবা পাচারকারীদের মধ্যে অধিকাংশই রাঙ্গুনিয়া, লোহাগাড়া, আনোয়ারা, বাঁশখালী, পটিয়া ও সাতকানিয়ায়। এ ছাড়া রয়েছে কুমিল্লা ও বরিশাল জেলার লোক। যারা সড়ক, সমুদ্র ও আকাশপথ দিয়ে নিয়মিত ইয়াবা পাচারে জড়িত।

    তিনি বলেন, ২০০৬ সাল থেকেই মিয়ানমার থেকে টেকনাফ হয়ে ইয়াবার চালান আসতে থাকে এ দেশে। অবস্থা এমন যে কয়েকবছর আগেও টেকনাফে পেশা হিসেবে যারা জেলে, রিকশাচালক, বেকার যুবক, পিঠা বিক্রেতা, কৃষক বা ক্ষুদ্র লবণচাষি ছিলেন, তাদের অধিকাংশই এখন কোটিপতি, গাড়ি হাঁকিয়ে চলে। গ্রামের রাস্তার দু’পাশে সব সুরম্য বাড়িঘর। এর মধ্যে অন্যতম টেকনাফের নাজিরপাড়া গ্রামের বাসিন্দা এজাহার মিয়ার ছেলে নূরুল হক ওরফে ভুট্টো। একটি রিকশা কেনার সামর্থ্য ছিল না নূরুল হকের। বসতবাড়ি বলতে ছিল গোলপাতার একটি ঘর। সেই নূরুল হক এখন নাজিরপাড়ায় দুটি বাড়ির মালিক। চট্টগ্রাম ও খুলনায় তাঁর ফ্ল্যাট আছে। আছে তিনটি গাড়িও। জমিজমাও কিনেছেন অনেক। নাজিরপাড়ায় রাস্তার পাশে এখন একটি মার্কেটও নির্মাণ করছেন। নূরুল হক মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত। তিনি একা নন, তাঁর সঙ্গে আছেন তাঁর পিতা এজাহার মিয়া, ভাই নুর মোহাম্মদ ওরফে মংগ্রী, ভগ্নিপতি নূরুল আলম, ভাগিনা জালাল উদ্দিন, বেলাল, আবছার উদ্দিন, হেলাল, হোছেন কামাল ও নুরুল আমিন ওরফে খোকন। তাঁরা সবাই ইয়াবা মামলার আসামি। আনোয়ারা গহিরায় ইয়াবা সিন্ডিকেটের প্রধান মোজাহের আনোয়ারা উপজেলার রায়পুর এলাকার চান মিয়ার ছেলে।

    ভালো মানুষের মুখোশের আড়ালে তিনি ইয়াবা পাচার করতেন। র‌্যাবের হাতে ধরা পড়ার পর বিষয়টি জানাজানি হয়। নগরীতে মোজাহেরের আছে ছয়তলা বাড়ি। ইয়াবা ব্যবসায়ী জিয়াউর রহমান নয়-দশ বছর আগেও ছিলেন বেকার। টেকনাফ মৌলভীপাড়ার চোরাচালানের ঘাট নিয়ন্ত্রণকারী হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার পর ইয়াবা পাচার শুরু করেন। এখন দুটি মাইক্রোবাস ও চারটি ভারতীয় বিভিন্ন মডেলের দ্রুতগামী মোটরসাইকেলের মালিক। একটি আলিশান বাড়িও বানিয়েছেন। তাঁর ছোট ভাই আবদুর রহমান ও কামাল হোসেন ইয়াবা ব্যবসায় সক্রিয়। ৪ঠা মে শুক্রবার চট্টগ্রাম হালিশহরের শ্যামলী হাউজিং সোসাইটির একটি ফ্লাটে ধরা পড়ে ইয়াবার সবচেয়ে বড় চালান। এই অভিযানে ১৩ লাখ ইয়াবাসহ মো. আশরাফ (৩৪) ও হাসান (২৪) নামে দুই ভাইকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর মধ্যে আশরাফ ছিলেন সৌদি আরব প্রবাসী। তাদের বাড়ি বান্দরবান পার্বত্য জেলায়।

    আশরাফের শ্যামলী হাউজিং সোসাইটির ওই ফ্লাট ছাড়াও নাসিরাবাদে একটি ফ্লাট ও বাকলিয়ায় একটি প্লট আছে। রয়েছে দুটি গাড়িও। গত বছর ৩১শে আগস্ট সিদ্দিকুল ইসলাম নামে এক ইয়াবা ব্যসায়ীর খোঁজ মিলে। যার কৌশলের কাছে বারবার পরাস্ত হতে হয় পুলিশের কৌশল। তবে শেষ রক্ষা হয়নি তার। ইয়াবা পাচারে সিদ্দিকুল ইসলাম গড়ে তুলেন পারিবারিক সিন্ডিকেট।

    সূত্র জানায়, টেকনাফ থেকে ঢাকায় ইয়াবার চালান নিয়ে আসেন সিদ্দিকের দুই ছেলে রবিউল ইসলাম ও ফরিদুল ইসলাম। একেক সপ্তাহে একেক ছেলে এই দায়িত্ব পালন করে। এর মধ্যে ছেলে রবিউল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। যদিও ঠিকমতো সে ক্লাস করে না, বাবার ইয়াবা ব্যবসা নিয়েই ব্যস্ত সে। স্ত্রী রশিদা খাতুনও গ্রেপ্তার হয়েছে দুদফা।

    চট্টগ্রামের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সাউদার্ন ইউনিভার্সিটির এলএলবি সপ্তম সেমিস্টারের শিক্ষার্থী আতিকুল ইসলাম তারেক (২০) তার বাড়ি টেকনাফে। তার বাবা টেকনাফের মহেশখালীয়া পাড়ার বাসিন্দা নুরুল ইসলাম একজন ব্যবসায়ী।

    চট্টগ্রাম মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার (ডিসি বন্দর) মো. শহীদুল্লাহ বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ইয়াবা ব্যবসায় জড়িতদের একটা তালিকা জমা দেয়া আছে। এক সংসদ সদস্য, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতাসহ প্রায় সব পেশার লোকের নাম ওই তালিকায় রয়েছে। যাদের দামি গাড়ি ও একাধিক ফ্ল্যাটের খোঁজ মিলছে। যাদের দুই থেকে পাঁচ বছর আগেও নুন আনতে পান্তা ফুরাত।

    তিনি বলেন, সাঁড়াশি অভিযানে নামার পর এসব মাদক ব্যবসায়ীদের অনেকের খোঁজ মিলছে না এখন। গা-ঢাকা দিয়েছে। তাদের কেউ কেউ বিদেশে পাড়িও জমিয়েছে। অনেকে পাড়ি দেয়ার চেষ্টায় আছে। বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close