• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

ঝিনাইদহের মানুষদের নিয়ে লেখা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছড়া

প্রকাশ:  ০৩ নভেম্বর ২০১৭, ১২:৫৭ | আপডেট : ০৩ নভেম্বর ২০১৭, ১৯:১৫
পূর্বপশ্চিম ডেস্ক

ঝিনাইদহের মানুষদের নিয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দু’টি ছড়া লিখেছিলেন। ঝিনাইদহের মানুষের চিন্তা, মন-মানসিকতা, আচরণ ও জীবন যাপন কেমন? তার সবটাই বরীন্দ্রনাথ ঠাকুর খুব সুন্দর ও নিখুঁত ভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন তার লেখনীতে। একটি ছড়া পড়ুন আজ।

পরিস্থিতি - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ঝিনেদার জমিদার কালাচাঁদ রায়রা

সে-বছর পুষেছিল একপাল পায়রা।

বড়োবাবু খাটিয়াতে বসে বসে পান খায়

পায়রা আঙিনা জুড়ে, খুঁটে খুঁটে ধান খায়।

হাঁসগুলো জলে চলে, আঁকাবাঁকা রকমে

পায়রা জমায় সভা, বক্‌-বক্‌ -বকমে।

খবরের কাগজেতে shock দিল বক্ষে,

প্যারাগ্রাফে ঠোক্কর লাগে তার চক্ষে।

তিন দিন ধ’রে নাকি দুই দলে পোড়াদয়

ঘুড়ি-কাটাকাটি নিয়ে মাথা ফাটাফাটি হয়।

কেউ বলে ঘুড়ি নয়, মনে হয় সন্ধ—

পোলিটিকালের যেন পাওয়া যায় গন্ধ।

‘রানাঘাট-সমাচারে’ লিখেছে রিপোর্টার—

আঠারোই অঘ্রানে শুরু হতে ভোরটার

বেশি বৈ কম নয় ছয়সাত হাজারে

গুণ্ডার দল এল সবজির বাজারে।

এ খবর একেবারে লুকোনোই দরকার,

গাপ করে দিল তাই ইংরেজ সরকার।

ভয় ছিল কোনোদিন প্রশ্নের ধাক্কায়

পার্লিয়ামেণ্টের হাওয়া পাছে পাক খায়।

এডিটর বলে, এতে পুলিসের গাফেলি।

পুলিস বলে যে, চলো বুঝেসুঝে পা ফেলি;

ভাঙল কপাল যত কপালেরই দোষ সে,

এসব ফসল ফলে কন্‌গ্রেসি শস্যে।

সবজির বাজারেতে মুলো মোচা সস্তায়

পাওয়া গেল বাসি মাল ঝাঁকা ঝুড়ি বস্তায়।

ঝুড়ি থেকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে মেরেছিল চালতা,

যশোরের কাগজেতে বেরিয়েছে কাল তা।

‘মহাকাল’ লিখেছিল, ভাষা তার শানানো—

চালতা ছোঁড়ার কথা আগাগোড়া বানানো;

বড়ো বড়ো লাউ নাকি ছুঁড়েছে দু পক্ষে,

শচীবাবু দেখেছে সে আপনার চক্ষে।

দাঙ্গায় হাঙ্গামে মিছে ক’রে লোক গোনা,

সংবাদী সমাজের কখনো এ যোগ্য না।

আর-এক সাক্ষীর আর-এক জবানি—

বেল ছুঁড়ে মেরেছিল দেখেছে তা ভবানী।

যার নাকে লেগেছিল সে গিয়েছে ভেবড়ে,

ভাগ্যেই নাক তার যায় নাই থেবড়ে।

শুনে এডিটর বলে, এ কি বিশ্বাস্য—

কে না জানে নাসাটা যে সহজেই নাশ্য।

জানি না কি ও পাড়ায় কোনোখানে নাই বেল;

ভবানী লিখল, এ যে আগাগোড়া লাইবেল।

মাঝে থেকে গায়ে প’ড়ে চেঁচায় আদিত্য—

আমারে আরোপ করা মিথ্যাবাদিত্ব!

কোন্‌ বংশে যে মোর জন্ম তা জান তো,

আমার পায়ের কাছে করো মাথা আনত।

আমার বোনের যোগ বিবাহের সূত্রে

ভজু গোস্বামীদের পুত্রের পুত্রে।

এডিটর লেখে, তব ভগ্নীর স্বামী যে

গো বটে গোয়ালবাসী, জানি তাহা আমি যে।

ঠাট্টার অর্থটা ব্যাকরণে খুঁজতে

দেরি হল, পরদিনে পারল সে বুঝতে।

মহা রেগে বলে, তব কলমের চালনা

এখনি ঘুচাতে পারি, বাড়াবাড়ি ভালো না।

ফাঁস করে দিই যদি, হবে সে কি খোশনাম,

কোথায় তলিয়ে যাবে সাতকড়ি ঘোষ নাম।

জানি তব জামাইয়ের জ্যাঠাইয়ের যে বেহাই

আদালতে কত ক’রে পেয়েছিল সে রেহাই।

ঠাণ্ডা মেজাজ মোর সহজে তো রাগি নে,

নইলে তোমার সেই আদরের ভাগিনে

তার কথা বলি যদি— এই ব’লে বলাটা

শুরু করে ঘেঁটে দিল পঙ্কের তলাটা।

তার পরে জানা গেল গাঁজাখুরি সবটাই,

মাথা-ফাটাফাটি আদি মিছে জনরবটাই।

মাছ নিয়ে বকাবকি করেছিল জেলেটা,

পচা কলা ছুঁড়ে তারে মেরেছিল ছেলেটা।

আসল কথাটা এই অটলা ও পটলা

বাধালো ধর্মঘটে জন ছয়ে জটলা।

শুধু কুলি চারজন করেছিল গোলমাল—

লালপাগড়ি সে এসে বলেছিল,তোল্‌ মাল।

গুড়ের কলসিখানা মেতে উঠে ফেটেছিল,

রাজ্যের খেঁকিগুলো শুঁকে শুঁকে চেটেছিল;

বক্তৃতা করেছিল হরিহর শিকদার—

দোকানিরা বলেছিল, এ যে ভারি দিকদার।

সাদা এই প্রতিবাদ লিখেছিল তারিণী,

গ্রামের নিন্দে সে-যে সইতেই পারে নি।

নেহাত পারে না যারা পাব্‌লিশ না করে

সব-শেষ পাতে দিল বর্জই আখরে।

প্রতিবাদটুকু কোনো রেখা নাহি রেখে যায়,

বেল থেকে তাল হয়ে গুজবটা থেকে যায়।

ঠিকমতো সংবাদ লিখেছিল সজনী—

সহ্য না হল সেটা, শুনেছে বা কজনই।

জ্যাঠাইয়ের বেহাইয়ের মামলাটা ছাড়াতে

যা ঘটেছে হাসি তার থেকে গেল পাড়াতে।

আদরের ভাগনের কী কেলেঙ্কারি সে,

বারাসতে বরিশালে হয়ে গেছে জারি সে।

হিতসাধনী সভার চাঁদাচুরি কাণ্ড

ছড়িয়ে পড়েছে আজ সারা ব্রহ্মাণ্ড।

ছেলেরা দুভাগ হল মাগুরার কলেজে—

এরা যদি বলে বেল, ওরা লাউ বলে যে।

চালতার দল থাকে উভয়ের মাঝেতে,

তারা লাগে দু দলের সভা-ভাঙা কাজেতে।

দলপতি পশ্চাতে রব তোলে বাহবার,

তার পরে গোলেমালে হয়ে পড়ে যা হবার।

ভয়ে ভয়ে ছি-ছি বলে কলেজের কর্তারা,

তার পরে মাপ চেয়ে চলে যায় ঘর তারা।

একদা দু এডিটরে দেখা হল গাড়িতে,

পনেরো মিনিট শুধু ছিল ট্রেন ছাড়িতে।

ফোঁস করে ওঠে ফের পুরাতন কথা সেই,

ঝাঁজ তার পুরো আছে আগে ছিল যথা সেই।

একজন বলে বেল, লাউ বলে অন্যে,

দুজনেই হয়ে ওঠে মারমুখো হন্যে।

দেখছি যা ব্যপার সে নয় কম তর্কের,

মুখে বুলি ওঠে আত্মীয় সম্পর্কের।

পয়লা দরের knave, idiot কি কেবল,

liar সে, humbug, cad unspeakable—

এই মতো বাছা বাছা ইংরেজি কটুতা

প্রকাশ করিতে থাকে দুজনের পটুতা।

অনুচর যারা, তারা খেপে ওঠে কেউ কেউ—

কুকুরটা কী ভেবে যে ডেকে ওঠে ভেউ-ভেউ।

হাওড়ায় ভিড় জমে, দেখে সবে রঙ্গ—

গার্ড এসে করে দিল যাত্রাই ভঙ্গ।

গার্ডকে সেলাম করি; বলি, ভাই বাঁচালি,

টার্মিনাসেতে এল বেলছোঁড়া পাঁচালি।

ঝিনেদার জমিদার বসে বসে পান খায়,

পায়রা আঙিনা জুড়ে খুঁটে খুঁটে ধান খায়

হেলেদুলে হাঁসগুলো চলে বাঁকা রকমে,

পায়রা জমায় সভা বক্‌-বক্‌-বকমে।

উদয়ন (শান্তিনিকেতন) ৯ মার্চ ১৯৪০ ইং।

এই ছড়াটি পাবেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছড়া সংকলন’ গ্রন্থের ১৩ খন্ডে ৯৬ পৃষ্ঠায়। এই ছড়া সংকলনের প্রকাশকাল ভাদ্র, ১৩৪৮ (১৯৪১ ইং)।

এই ছড়াটি ‘পরিস্থিতি’ শিরোনামে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ‘প্রবাসী’ সাময়িকপত্রের বৈশাখ, ১৩৪৭ সংখ্যায় ১ পৃষ্ঠায়।

সংগ্রহে: আরিফুজ্জামান, সাহিত্য গবেষক ও সাংগঠনিক সম্পাদক, আহবান সাংস্কৃতিক চর্চা কেন্দ্র, ঝিনাইদহ।

ভিডিও...

ঝিনাইদহ
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close