• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

জলরঙ ছবি

প্রকাশ:  ০৭ আগস্ট ২০১৭, ০১:৩১ | আপডেট : ০৭ আগস্ট ২০১৭, ০২:১১
স্মৃতি ভদ্র

রাতের কালো চাদর সরিয়ে দিন যখন উঁকি দেয়, ঠিক তখন শাঁওলি বুবুনের বিছানার পাশে এসে দাঁড়ায়। মাথার বালিশ একপাশে সরে গেছে। গায়ের কুইল্ট টা কুন্ডুলী পাকিয়ে বুকের মাঝে ধরে মেয়েটা এখন গভীর ঘুমে। শাঁওলী এয়ারকন্ডিশান টা বন্ধ করে দেয়। এরপর বুবুনের খুব কাছে গিয়ে আস্তে আস্তে ডাকে, “বুবুন পাখি, উঠে পড়ো মাম্মান, স্কুলে যেতে হবে।” মায়ের গলার আওয়াজে একটু নড়ে পাশ ফিরে আবার তলিয়ে যায় ঘুমে। শাঁওলী এবার মেয়ের মাথায় হাত দিয়ে চুলে বিলি কাটে, গালে নাক ঘষে আদর উগরে দেয়, “এবার কিন্তু দেরী হয়ে যাবে সোনা। উঠে পড়ো তাড়াতাড়ি।” বলেই মেয়েকে প্রায় জোর করে তুলে বসিয়ে দেয়।

ঘুম জড়ানো চোখে বুবুন মাকে দেখে। কিছুটা আবছা আবছা। মা যখন টেনে কোলে তুলে নেয় তখন বুবুন মাথাটা মায়ের ঘাড়ে ফেলে দেয়। বাথরুমে নিয়ে শাঁওলী মেয়েকে ফ্রেশ করে। এরপর হাত ধরে খাবার টেবিলে নিয়ে আসে। কর্ণফ্লেক্স আর দুধ আগে থেকেই টেবিলে রেখে দিয়েছিলো শাঁওলী। বেশ কিছুটা সময় নিয়ে মেয়েকে খাওয়ায়। বেশীরভাগ টাই বুবুন খায় না। বুবুন সব সময় খাবার নষ্ট করে। প্রথম দু'চার বার খেয়েই মুখটা যে ঘুরিয়ে ফেলে,এরপর জোরাজুরিতে আর কাজ হয় না। তাই শাঁওলী আর চেষ্টা করে না। এরপর বুবুনকে নিয়ে আসে অনিকেতের কাছে। “পাপা আজ চলে যাবে, বাই বলে দাও” বলে মেয়ের হাত ধরিয়ে দেয় বাবাকে। বুবুন কিছুক্ষণ বাবার দিকে তাকিয়ে থেকে হাতটা ছাড়িয়ে মায়ের পাশে এসে দাঁড়ায়। আর দেরী না করে মেয়েকে স্কুলের জন্য তৈরি করে নীচে নেমে আসে শাঁওলী।

সম্পর্কিত খবর

    এখন ডিসেম্বর মাস। এবার ঠান্ডা বেশ জমিয়ে পড়েছে। এর মধ্যেই কয়েকবার স্নো পড়া হয়ে গেছে। আর আজ শীতের তীব্রতা বাড়াতে সাথে যোগ হয়েছে বেশ একলয়ে বয়ে যাওয়া হালকা বাতাস। তাই মেয়ের টুপি আর স্কার্ফ টা আরেকবার ঠিক করে দেয় শাঁওলী। এপার্টমেন্টের মেইন ডোর থেকে আরেকটু দূরে এসে থামে বুবুনের স্কুল বাস। তাই কিছুটা সময় বেশ কনকনে ঠান্ডায় মা আর মেয়েকে প্রতিদিন অপেক্ষা করতে হয়। আজও শাঁওলী আর বুবুন স্কুল বাস স্টপেজে এসে দাঁড়িয়েছে একদম সবার আগে। লাইনে সবার আগে মেয়েকে দাঁড় করিয়ে শাঁওলী বেশ আত্মতৃপ্তিতে ভোগে। যদিও এই লাইনে পরে থাকলেও খুব একটা ব্যত্যয় হয় না। একে একে সব বাচ্চাকেই বাসে নেওয়া হয়। তবুও সবকিছুতে শুরুতে থাকার ইচ্ছাটা কেন যেন শাঁওলীকে সব সময় তাড়িয়ে বেড়ায়। নিজের জীবনে সবকিছুতে প্রথম হওয়া শাঁওলী, মেয়েকে নিয়েও এখন প্রথম হবার মিছিলে সামিল।

    কিছু সময় পড়েই স্কুল বাস চলে আসে। স্কুলবাস থেকে একজন সাহায্যকারী এসে একে একে সব বাচ্চা কে বাসে তোলে। শাঁওলী বুবুনের কপালে চুমু দিয়ে সাহায্যকারীর হাতে ধরিয়ে দেয়। সাহায্যকারী বুবুনকে বলে," ছে (say)বাই টু মামা"। এরপর বুবুনের হাত ধরে দু'পাশে নেড়ে বাই বাই বলে সাহায্যকারী। বুবুনরা একটু এগিয়ে গেলে পিছন থেকে শাঁওলী প্রতিদিনকার মত জোরে বলে ওঠে, “মাম্মা উইল মিস ইউ, বুবুন” মেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে একবার তাকাবে এই আশায়। কিন্তু বুবুন আজও পিছন না ঘুরে মাকে হতাশ করে বাসে গিয়ে ওঠে। বাস চলে গেলে কিছু গ্রোসারী করতে পাশের একটি সুপার শপে যায়। লিষ্ট মিলিয়ে সবকিছু চটপট নিয়ে বিল মিটিয়ে বাসার দিকে ছোটে।

    আজ দুপুরের ফ্লাইটে অনিকেত দেশে ফিরবে। অনিকেতের একটি নিজস্ব সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট ফার্ম আছে।তিন বন্ধু মিলে দিয়েছে। অনিকেতের প্রায় ছয় মাস দেশে নেই। তাই বাকি দু'জন বন্ধু অফিস সামলাতে এখন হিমশিম খাচ্ছে। যদিও অনিকেত এখান থেকেই অফিসের অনেক কাজ করছে, তবুও ঢাকাতে ওর অনুপস্থিতি খুব ভোগাচ্ছে বাকি দুজনকে। তাই অনিকেতকে এবার ফিরতে হবে। অনিকেত নিজের আর শাঁওলীর জন্য পিনাট বাটার স্যান্ডুইচ করে, কফির জন্য মগে পানি নিয়ে মাইক্রোওয়েভে দেয়। এরমধ্যেই শাঁওলী চলে আসে। গ্রোসারীগুলো রান্নাঘরের কাউন্টারে রেখে শীতের কোটটা খুলে ক্লোজেটে রেখে খাবার টেবিলে আসে। অনিকেত চিনিবিহীন কালো কফির মগটা শাঁওলীর হাতে দিয়ে বলে, “সবটা একা সামলাতে পারবে সে ভরসা আমার আছে। কিন্তু নিজেকে সামলাতে পারবে কি না,এটা নিয়েই ভাবছি আমি। বুবুনের ব্যাপারে এত পজেসিভ তুমি!! কিছু ব্যাপার ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিতে হয়।”

    “ভাগ্য নয় পরিস্থিতি বলো। ভাগ্যে আমার বিশ্বাস নেই। ভাগ্য বললে কেমন যেন অনির্ধারিত কিছু মনে হয়। বরং পরিস্থিতি চেষ্টা করলে অনুকূলে আনা যায়।” কফির মগে আয়েশ করে চুমুক দেয় শাঁওলী। “আর বুবুন তো এমন ছিল না। হঠাৎ করেই এমন হয়ে গেছে। কোনো প্রতিকূলতায় ও কিছুটা থমকে গেছে। আমি ওকে আবার আগের মতো করে তুলবো।” বলতে বলতে শাঁওলীর মুখটা দৃঢ় হয়ে ওঠে।

    অনিকেত ভাবতে থাকে একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্প্যানির বিপণন বিভাগের প্রধান শাঁওলী আজ সব ছেড়ে এই বিদেশ বিঁভুইয়ে শুধুই “মা” হয়ে আছে। আর এই “শুধুই মা” হয়ে ওঠাটা যেন শাঁওলীর এক অন্যরকম যুদ্ধ।শাঁওলীর কাছে তা যেন এক প্রতিজ্ঞা।

    বুবুন ওদের একমাত্র সন্তান। বিয়ের প্রায় চার বছর পর স্বর্গের একটি অংশ আসে বুবুন রূপে ওদের ঘরে। বুবুন বেড়ে উঠতে থাকে পরীর মতো আলো ছড়িয়ে। মাম্মা, পাপা ডাকে ঘর ভরিয়ে রাখতো। অসম্ভব চঞ্চল ছিল বুবুন। স্থিরতা যেন ওর ধাতেই ছিল না। তবে যেকোনো নতুন পরিবেশে বুবুন খুব অস্থির হয়ে উঠতো। যেন খুব অস্বস্তি হত ওর। আর এই অস্বস্তিটুকুই খুব ভাবাতো অনিকেত আর শাঁওলীকে। এই টুকু বাদে শাঁওলীদের জীবন খুব নির্বিঘ্ন ছিল। তিন বছরের খুব ধুমধাম করে জন্মদিন পালন হলো। এর কিছুদিন পর থেকেই আস্তে আস্তে বুবুন পালটাতে থাকে। চুপচাপ হতে শুরু করে। কথা কম বলতো। ধীরে ধীরে কথা একদম বন্ধ করে দেয়। অনেক ডাক্তার দেখানো হয়েছে। সবাই বলে অটিজম। খুব অবাক হয়েছিল ওরা। যে বাচ্চার সবকিছু জন্ম থেকে স্বাভাবিক সে কিভাবে অটিস্টিক হয়। পরে জেনেছে অটিজম জীবনের যে কোনো সময়ে হতে পারে। আর সেই যে বুবুনের চঞ্চলতা, স্থীর হীনতা, নতুন পরিবেশে মানিয়ে না নেওয়া এ সবই ছিল অটিজমের এলার্ট সাইন। তবে ঠিক কি কারণে অটিজম হয় তার সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যাখ্যা নেই। প্রথমে খুব ভেঙে পড়েছিল শাঁওলী। কিছু কিছু বিশেষ সেবার মধ্যে থাকলে অটিজমকে অনেকটাই জয় করা যায়, এটা জানার পর শাঁওলী শুরু করে বুবুনকে নিয়ে যুদ্ধ। অটিজমকে জয়ের যুদ্ধ।

    বুবুনের পাঁচ হবার পর ওরা আমেরিকা এসেছে। বুবুনকে এখানকার বিশেষ স্কুলে ভর্তি করেছে। যেখানে এইসব বাচ্চাদের বিশেষ সেবা দেওয়া হয়। আর এরসাথে শাঁওলীর প্রাণান্তকর চেষ্টা। বুবুন আবার কথা বলবে এটা যেন নিজের কাছে পণ শাঁওলীর।

    অনিকেত চলে গেছে আজ প্রায় একমাস। জানুয়ারি শেষ হয়ে আসছে। শীতের তীব্রতা বেড়ে গেছে অনেকগুণ এর মধ্যে। আর এর সাথে শুভ্রকাঞ্চনের মতো এক একটি দিন, তুষার অধিকার করে রাখছে। আজও এমন একটি দিন। সকাল থেকেই বুবুন আজ জানালায় দাঁড়িয়ে একমনে তুষার দেখছে। কাজের ফাঁকেফাঁকে শাঁওলী উইন্ডো দিয়ে বুবুনের হাত বাড়িয়ে তুষার স্পর্শ করাচ্ছে। “মাম্মান ইট'স স্নোয়িং। আর ইউ ইনজয়িং!” শাঁওলী নিজের উচ্ছ্বাসের উত্তাপ সবটা বুবুনকে দিতে চায়। বুবুন একবার মার দিকে নিরুত্তাপ তাকিয়ে চোখ ভাসায় তুষারে। বুকের ভিতরের হাহাকার টাকে নিজেই অবদমিত করে শাঁওলী যত্ন করে। আবার ডুবে যায় নিজের কাজে। নতুন করে শক্তি জমায় যুদ্ধের।

    সন্ধ্যায় বুবুনের মিউজিক থেরাপি শেষে ঘরে ফিরছে মা - মেয়ে। চারদিক সাদা হয়ে স্নো পড়ছে। সন্ধ্যার আকাশটা আলোকময়। স্নো যখন পড়ে তখন রাতের আকাশ এক অদ্ভুত আলোকচ্ছটায় নিজেকে প্রকাশ করে। হঠাৎ "লা লা লা" সুর এসে ধাক্কা দেয় শাঁওলীর কানে। সুরের উৎস খোঁজে শাঁওলী। আবার সুরটা হতেই চমকে ওঠে শাঁওলী। বুবুন গাইছে। আনন্দে গলা চিরে বেড়িয়ে আসে," মাম্মান"। মেয়েকে কোলে তুলে ঠাণ্ডা গালে নাক ঘষে। চোখের জল বাঁধভাঙে শাঁওলীর। আকাশ থেকে ঝড়ে পড়া শুভ্রকান্তি সাক্ষী হয় যোদ্ধা মায়ের এক চিলতে সুখের।

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close