• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

প্রেমিকা হিসেবে হুমায়ূনের কাছে পাওয়া প্রথম উপহার ছিল মশার স্প্রে

প্রকাশ:  ১৪ নভেম্বর ২০১৭, ১৪:৪০
পূর্বপশ্চিম ডেস্ক

অভিনেত্রী, সংগীতশিল্পী এবং নির্মাতা হিসেবে সকলের কাছে পরিচিত মেহের আফরোজ শাওন। নিজ গুণেই তিনি স্বকীয়। তার উপর দেশের প্রখ্যাত কথা সাহিত্যিক ও নির্মাণের কারিগর হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী তিনি।

প্রথমে ভালোলাগা, প্রেম তারপর ২০০৪ সালে হুমায়ূনের সঙ্গে বিয়ে হয় তার। হুমায়ূনের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত(২০১২ সাল পর্যন্ত) প্রায় আট বছর ছিল তাদের সংসার যাপন। হুমায়ূনের সঙ্গে তার যাপিত জীবন কেমন ছিল, তার দ্বারা তিনি কতোটা প্রভাবিত ছিলেন ব্যক্তি জীবনে, হুমায়ূন তাকে কতোটা পছন্দ করতেন, তাকে নিয়ে কতোটা ভাবতেন, তাদের প্রণয়, প্রেম ও জীবন যাপনের এসমস্ত গল্প বলেছেন মেহের আফরোজ শাওন-

সম্পর্কিত খবর

    হুমায়ূন আহমেদ নাই বহুদিন। তার কোনো স্মৃতি কী কখনো আপনাকে পোড়ায়? হুমায়ূন আহমেদের কোনো স্মৃতি আমাকে কখনো পোড়ায় না। হুমায়ূন আহমেদের সাথে যতো স্মৃতি আমার রয়েছে, সেগুলোই আসলে আমাকে বাঁচিয়ে রাখে। আমাকে প্রতিনিয়ত উজ্জীবিত করে। সামনের দিকে আমাকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে।

    জীবন কেমন? জীবন সুন্দর। জীবনটা অনেক সুন্দর। বেঁচে থাকাটাই অনেক সুন্দর একটা ব্যাপার। এবং আমরাই জীবনটাকে জটিল করি। চাইলে আমরাই জীবনটা সহজ করতে পারি। তো আমার মনে হয় যে, এই জায়গাটা আমি হুমায়ূন আহমেদের কাছ থেকে শিখেছি। তিনি জীবনটাকে খুব সহজভাবে দেখতেন। যখন যেভাবে তিনি ইচ্ছে জীবন কাটাতে পারতেন, ইচ্ছেমত জীবন যাপন করতেন। তিনি কখনো ভাবতেন না মানুষ তাতে কী বলবে, তার লেখা নিয়ে মানুষ কী বলবে, তার নাটক নিয়ে মানুষ কী ভাববে, তার সিনেমা, ছবি আঁকা, তার ম্যাজিক এসব নিয়ে অন্যের কথা বলার ভয় তিনি করতেন না। তার যেভাবে ভালো লেগেছে সেভাবে জীবন যাপন করেছেন। তার যখন লিখতে ইচ্ছে হয়েছে তিনি লিখেছেন, যখন সিনেমা বানাতে ইচ্ছে হয়েছে সেটা তিনি করেছেন। যখন নাটক বানাতে ইচ্ছে হয়েছে সেটা করেছেন। চলচ্চিত্র নিয়ে পড়াশোনা না করেও তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণে এসেছেন। শিখে শিখে চলচ্চিত্র বানিয়েছেন। নিজে শিখে ছবি আঁকা রপ্ত করেছেন। তিনি সুন্দর ম্যাজিক দেখাতেন। আমারতো মনে হয়, সর্ব ক্ষেত্রেই তিনি একজন চমৎকার ম্যাজিশিয়ান ছিলেন। জীবনটাকে কিভাবে উপভোগ করতে হয়, জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে কিভাবে আনন্দের সঙ্গে সহজভাবে উপভোগ করতে হয় এই জিনিষটা আমার মনে হয় আমি হুমায়ূন আহমেদের কাছ থেকে শিখেছি। এবং এই জিনিসটাকে সবারই শেখা উচিত।

    হুমায়ূনহীন জীবন কেমন? হুমায়ূনহীন জীবন নয় আমার। আমার জীবন এখনো হুমায়ূনময়। উপস্থিতির কথা যদি বলি, হ্যাঁ, তার শারীরিক উপস্থিতি নেই । আমার যখন তাকে দেখতে ইচ্ছে হয় তাকে আমি দেখতে পারি না। সেদিক থেকে যদি হুমায়ূন আহমেদহীন বলা যায়। তার কথা শুনতে আমার খুব ইচ্ছে হয়। তার সাথে গল্প করতে খুব ইচ্ছে হয়। তাকে দেখতে খুবই ইচ্ছে হয়। কিন্তু আমার জীবন এক মুহূর্তের জন্যও হুমায়ূনহীন নয়। আমার জীবনের প্রতিটি কাজ হুমায়ূন আহমেদ থাকলে যেভাবে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতাম, আমি এখনো তারসঙ্গে আলোচনা করে সব কিছুর সিদ্ধান্ত নেই। আমি তার কাছ থেকে সিদ্ধান্ত পাই, তিনি আমাকে ঠিক কাজ করার সিদ্ধান্ত দেন। আমার প্রতিটি কাজে তিনি আমাকে এনকারেজ করেন। আমার জীবন এখনো হুমায়ূনময়, এবং সারাজীবনও তাই থাকবে।

    হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে প্রথম কাজ নিশ্চয় স্পেশাল? উনার সঙ্গে প্রথম কাজের অভিজ্ঞতা যদি বলেন? জননী নাটক দিয়ে তারসঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। ১৯৯১ সালে। সুইজারল্যান্ডের কো-অপারেশনের একটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম। পায়ে চালিত পানির পাম্প, এই বিষয়টার উপর ছিল ডকুফিল্মটা। যখন এটা করলাম, তখন আমি শুধু হুমায়ূন আহমেদ নামটাই জানতাম। অডিশন দিতে যখন গেলাম বাংলাদেশ টেলিভিশনে, তখন এটার পরিচালকের রুমেই আমাদের অডিশনটা হল। তখন কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ শুধু নাট্যকার, লেখক হিসেবেই ছিলেন। অডিশন দিতে যখন রুমে গেলাম, তখন প্রথম তাকে দেখি ঢিলেঢালা শার্ট পরা একটা মানুষ। এবং চেয়ারে পা তুলে বসে আছেন। নরমালিতো বাংলাদেশ টেলিভিশনের মতো একটি প্রতিষ্ঠানে দেখিনি যে এভাবে চেয়ারে পা তুলে কেউ বসে থাকতে পারে। সবাই একটু ফরমালি বসে, একটু স্মার্টলি বসে। তাছাড়া এটাতো আরো সরকারি প্রতিষ্ঠান। তো উনাকে দেখি চেয়ারে পা তুলে বসে কুঁজো হয়ে সিগারেট ফুঁকছে। তখন আমাকে বললো দুটি ডায়ালগ বলতে, আমি বললাম। উনি শুনে বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ পারবে পারবে। তো, ওই দেখাটা আমার মধ্যে এতোটা ছাপ ফেলেনি, যতোটা ফেলেছে আমরা যখন শুটিংস্পটে যাই। শুটিং হয়েছিল ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়াতে। সেখানে শুটিংয়ে গিয়ে দেখলাম, এই মানুষটি কিন্তু ওই নাটকের শুধুই নাট্যকার, কাহিনীকার। কিন্তু দেখলাম শুটিং চলাকালীন সময়ে ডিরেকশনে একটু একটু করে, ছোট ছোট বেশকিছু বিষয় যুক্ত করছেন ইনস্ট্যান্ট। আমিতো তখন ছোট ছিলাম, এতোকিছু বুঝতাম না। ভাবলাম, বাহ, ডিরেকশনতো তাহলে উনিও দিচ্ছেন। মানে তিনি যে শুধু নাটক লিখে দিয়ে চলে গেছেন, আর কোনো কাজ নাই তা কিন্তু না। অসম্ভব ইন্টারেস্টিং একজন মানুষ ছিলেন, খুব মজা করে কথা বলতেন। আমার মনে হয়, সামনা সামনি তার মুখ থেকে যারা গল্প শুনেছেন তারা সৌভাগ্যবান। হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে সামনা সামনি ত্রিশ মিনিট কথা বললে যে কোনো মানুষের মন অন্যরকম হয়ে যেত।

    হুমায়ূন আহমেদের চলচ্চিত্রের বেশীর ভাগগুলোতেই নায়িকা আপনি। পরবর্তীতে তার ব্যক্তি জীবনেরও সঙ্গী। নায়ক হিসেবে হুমায়ূন কেমন?

    আসলে দুটি ক্ষেত্রইতো সম্পূর্ণ আলাদা। আমি হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে যখন অভিনয় করেছি, তার বিভিন্ন নাটক সিনেমায় যখন প্রধান নারী চরিত্রে অভিনয় করেছি তখন অভিনয়ের জায়গাতে আমি শুধু অভিনেত্রীই ছিলাম। সেটা বিয়ের পরেও, বিয়ের আগেও। এমন কখনো হয়নি যে আমি বিবাহের পর হুমায়ূনের কোনো নাটক সিনেমায় অভিনয় করেছি, কিন্তু তিনি কখনো শুটিংয়ের সময় স্ত্রী হিসেবে ট্রিট করেছেন। উনি যেভাবে অভিনয়টা করিয়ে নিতে চাইছেন, সেভাবেই হয়েছে। এমন না যে শুটিং সেটে আমার কোনো ভুলের কারণে সবার সামনে আমাকে বকা দিবেন না, এটা হয়নি। সেটে তিনি আমাকে সব সময় একজন অভিনেত্রী হিসেবেই দেখেছেন। আমার শুটিং ভালো হলে তিনি যেমন সবার সামনেই আমার প্রশংসা করতেন, তেমনি ভালো না হলে সবার সামনেই আমাকে বকা দিতেন। তিনি খুব প্রফেশনাল ছিলেন।প্রতিটি ক্ষেত্রে যেভাবে ব্যবহার করা উচিত তিনি সেভাবেই করতেন। সেটে এসে আমার কাছে কখনো মনে হয়নি যে আমি উনার স্ত্রী। কিংবা যখন আমার সঙ্গে তার খুব ভালো সম্পর্ক, প্রচলিত অর্থে যাকে আমরা প্রণয় বলি সেসময়ও কিন্তু শুটিং সেটে আমাকে প্রেমিকার মতো ব্যবহার করেননি। সেসময়ে যেমন অভিনেত্রী ছিলাম। ব্যক্তিজীবন, কর্মজীবন দুটোই আলাদা ছিল তার কাছে। এই জিনিসটিও তার কাছ থেকে শেখার ব্যাপার।

    হুমায়ূন আহমেদ সবাই জানেন চলচ্চিত্রকার হিসেবে, নাট্যকার হিসেবে, সাহিত্যিক হিসেবে। কিন্তু আমরা জানতে চাই, হুমায়ূন আহমেদ প্রেমিক হিসেবে কেমন ছিলেন?

    আমার মনে হয় যে, একজন সাধারণ মানুষ প্রেম করতে গিয়ে যা চিন্তা করেন। বা কি বলবো, কাউকে খুশি করার জন্য কাউকে ভোলানোর জন্য যে পন্থাগুলো বা মুগ্ধ করবার যে চেষ্টা সেটা কিন্তু হুমায়ূন আহমেদের মধ্যেও ছিল। কিন্তু যারা হুমায়ূনের পাঠক তারা খেয়াল করলে দেখবেন যে হুমায়ূনের বইয়ের নায়কেরা একটু অন্যরকম হতো। হুমায়ূন আহমেদের বইয়ের নায়িকারা ‘সুন্দর লাগছে’ বললেই যে খুশি হয়ে যেত তা কিন্তু না। তারা হয়তো বা একটা শাড়ি দিলে না যত খুশি হতো তার চেয়ে অনেক বেশী খুশি হতো একটি চিঠি দিলে। এই ধরনের কিছু ভিন্নতা হুমায়ূনের নায়ক নায়িকাদের মধ্যে ছিল। আমি বলবো যে হুমায়ূনের সমস্ত নায়কই আসলে হুমায়ূনের নিজের একেকটি খন্ডিত অংশ। সেই জায়গা থেকে হুমায়ূন আহমেদ সব সময়ই একটু অন্যরকম কিছু করতেন। যেমন একটি ছোট্ট উদাহারণ দেই, হুমায়ূন আহমেদের কাছে পাওয়া আমার প্রথম উপহার সেটা হচ্ছে মশার স্প্রে, অ্যারোসল। মানে প্রেমিকা হিসেবে পাওয়া আমার প্রথম উপহার দশ বোতল অ্যারোসল। কারণ রাতের বেলায় লিখতে বসে উনাকে যখন মশা কামড়াচ্ছিল উনার হঠাৎ করে মনে হল আচ্ছা, আমাকেতো মশা কামড়াচ্ছে যার জন্য লিখতে পারছি না। সেসময় কিন্তু আমার পরীক্ষা চলছিল। তো সেটা হুমায়ূন জানতেন, তখন উনার মনে হল আরে আমার প্রিয় মানুষটিকেওতো তাহলে মশা কামড়াচ্ছে। অথচ তার পরীক্ষা! মশার কামড়ে সেও কি তাহলে পড়তে পারছে না! তারজন্যতো উপহার পাঠানো উচিত। এমন ভাবনা থেকেই তিনি দশটা মশার স্প্রে এবং একটি চিঠি আমাকে উপহার হিসেবে পাঠালেন।

    তো, এটা যে কোনো প্রেমিকের পক্ষ থেকে পাঠানো কোনো উপহার হতে পারে এটা আসলে আমার মনে হয় না যে কেউ এরআগে চিন্তা করেছে। কিন্তু এমন উপহার পাঠানোকে আমি যদি লজিক দিয়ে চিন্তা করি, তিনি ভেবেছেন পড়ার সময় আসলে কী লাগতে পারে একটা মানুষের? এরকম প্রেমিক ছিলেন হুমায়ূন…।

    একজন প্রেমিক যার প্রেমিকাকে প্রথম উপহার হিসেবে মশার অ্যারোসল পাঠালো, প্রেমিকা হিসেবে এমন উপহার কিভাবে রিসিভ করলেন। আপনার ভাবনাটা তখন কী ছিল?

    আমি বুঝতে পেরেছিলাম আমি যে কোনো সাধারণ একজন মানুষের সঙ্গে আমার সখ্যতা নয়। একটু অন্যরকম মানুষের সঙ্গে সখ্যতা, একটু অদ্ভুদ মানুষের সঙ্গে সখ্যতা। এবং খুব সম্ভবত আমিও একটু পাগল টাইপের। আর এইজন্যই বোধহয় উনার সঙ্গে আমার সখ্যতাটা তৈরি হয়েছিল। তখন কিন্তু আমারও মনে হয়নি তিনি কেনো উপহার হিসেবে একটি শাড়ি দিলেন না বা একটি ফুল দিলেন না! হুমায়ূন ফুল কিন্তু আমাকে কখনো দেননি। তো একটু আগে বললাম না যে আমিও একটু পাগল ছিলাম যে কারণে এমন উপহারে রিয়েকশন যে খুব অবাক হয়েছিলাম তা কিন্তু না। বরং আমি মজা পেয়েছিলাম।

    অনেক বড় বড় সাহিত্যিক, চলচ্চিত্রকারদের সঙ্গে সংসারে অ্যাডজাস্টমেন্ট করা সঙ্গীনির জন্য কখনো কখনো কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ উনাদের যে চিন্তা তারসাথে সাধারণ মানুষের মার্চ করা কঠিন হয়ে পড়ে। আপনি কিভাবে হুমায়ূনের সঙ্গে অ্যাডজাস্টমেন্ট করেছেন?

    কঠিন ভাবলে কঠিন। আমিতো কঠিনেরে ভালোবাসিলাম। এই ভেবে যদি সহজভাবে নেয়া যায় তাহলে খুব সহজ। আমার কাছে সব সময় মনে হয়েছে, লেখক কবি সাহিত্যিকদের অন্যরকম একটি জীবন আছে। তাদের জীবনকে আলাদা করে নিতে পারবার মতো কিছু আলাদা মানুষও থাকা উচিত। তাদেরকে আট দশজন মানুষের মতো হিসেব করা উচিত না। তারা বাজার করবেন, সন্ধ্যার পর বাচ্চাদের পড়তে বসাবেন, শাড়ির দোকানে ঈদের সময় শাড়ি কিনতে নিয়ে যাবেন বা আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে দাওয়াতে যাবেন এরকম করে তাদের ভাবা মোটেই উচিত না। যদি কোনো মেয়ে একজন কবি সাহিত্যিক, চিত্রশিল্পী বা এরকম শিল্পমনা কাউকে বিয়ে করার সময় এসব ভেবে বিয়ে করেন তাহলে তাদের কাছে হয়তো মনে হবে জীবনটা কঠিন। কিন্তু আমি এসব ভেবে হুমায়ূনের সঙ্গে জীবন যাপন শুরু করিনি। আমি ধরেই নিয়েছি যে উনি রেগুলার বাজার করতে যাবেন না, এটা আমাকেই করতে হবে।

    ‘ওয়ার এন্ড পিস’ লেখার পর নাকি তলস্তয়ের স্ত্রী এর এডিট, প্রুফ সব করেছেন বলে শোনা যায়। লেখক স্ত্রী হিসেবে হুমায়ূনের এমন কোনো সাহিত্যের সঙ্গে এতো নিবির সম্পর্কের কথা কী মনে করতে পারেন?

    প্রুফ, এডিটিংয়ের সব কাজ নিয়ে হুমায়ূন আহমেদ আমার প্রতি নির্ভরশীল ছিলেন। যে কারণে ‘জ্যোৎস্না ও জননীর গল্প’ যখন প্রিন্টিংয়ে যায় তার আগে এই উপন্যাস আমাকে অন্তত দশবার পড়তে হয়েছে। ঠিক করার জন্য। এবং ছাপতে দেয়ার আগে একেবারে ফাইনাল প্রিন্টের এখানে লেখা থাকতো ‘চেকড বাই শাওন’। এটা লেখা থাকলেই কেবল পাব্লিশাররা ছাপতে দিত। মানে এমনটা লেখা থাকলেই কেবল প্রকাশকরা নিশ্চিত হত যে এটাতে আর কোনো ভুল নেই। এইসব জায়গা থেকে আমার মনে হয় যে, আমার প্রতি নির্ভরশীলতাটা হুমায়ূন আহমেদের গড়ে উঠেছিল। আমাদের মধ্যে লেখক ও প্রুফ রিডারের সম্পর্কটাও ছিল।

    সাহিত্যিক হুমায়ূনকে নিয়ে সিরিয়াস সাহিত্য মহলে এক ধরনের সমালোচনা আছে, বিতর্ক আছে। অনেকে তার সাহিত্য মান নিয়েও প্রশ্ন করেন, এই বিষয়ে শাওনের কী অবজারভেশন?

    আমি না খুব সাহিত্য বোদ্ধা নই। আমি একটা সিনেমা দেখার সময় ভাবি না যে আমি সিনেমা শিখে আসছি কিনা। একটা বই পড়ার সময় ভাবি না যে আমি সাহিত্য পড়ে এসেছি কিনা। আমি একজন সাধারণ পাঠক, আমি একজন সাধারণ দর্শক। আমার কাছে মনে হয় একজন সাধারণ পাঠকের কাছে যেই জিনিষটা পড়তে ভালো লাগবে, যখনই সেই সাহিত্য থেকে নতুন কিছু জানবে তখনই আমার কাছে মনে হয় সে সাহিত্যের একটা মূল্য আছে। এটা সিরিয়াস সাহিত্য কিনা সেটা জানি না। সাহিত্যের একটা দায়িত্ব পালনের জায়গা আছে। সেই জায়গায় আমি যখন হুমায়ূন আহমেদের ‘হিমু’ পড়ি, যেহেতু হিমুকে বলা হয় সবচাইতে হাল্কা! হিমু যখন আমি পড়ি, সেখান থেকেও কিন্তু আমি নতুন অনেক কিছু জানতে পারি। হিমুর মাধ্যমে অনেক রাজনৈতিক স্যাটায়ার কিন্তু হুমায়ূন তুলে ধরেছেন, অনেক পারিবারিক স্যাটায়ার তুলে ধরেছেন। একটু মজা করে অনেক কঠিন কঠিন বিষয় কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ তুলে ধরেন। এটা হয়তো আমরা পড়ার সময় টের পাই না, কিন্তু এটা আমাদের ভেতরে ঢুকে যায়।

    তখন আমার কাছে মনে হয় সিরিয়াস সাহিত্যটা আসলে কী! যেটা আমার পড়তেই ইচ্ছে করবে না, এবং অনেক কষ্ট করে পড়বো। এবং আমি বলতে পারবো আমি এটা পড়েছি, আমি অনেক জ্ঞানী! সেটাই কী সিরিয়াস সাহিত্য? নাকি যেটা আমার পড়তে ভালো লাগবে, আমি পড়ে যাবো কিন্তু আমি নিজেই বুঝতে পারবো না যে কতোকিছু জেনে গেলাম। জ্যোৎস্না ও জননীর গল্প যখন আমি পড়বো, তখন কি আমি ভাববো না যে আমি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়ছি! চমৎকারভাবে মুক্তিযুদ্ধকেও কিন্তু জানা হয়ে যায়। আবার দেখেন, আমি যখন মধ্যাহ্ন পড়ি তখন কিন্তু আমি এটা ইতিহাসের বই হিসেবে পড়ি না। কিন্তু দেখেন ১৯০৫ সাল থেকে ১৯৬৯ পর্যন্ত ইতিহাসটা কিন্তু জানা হয়ে যায়। আমি যখন মাতাল হাওয়া পড়ি তখন কিন্তু ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান সম্পর্কে জানা হয়ে যায়। আমাকে কেউ জোর করে পড়ায় না। দেয়াল যখন পড়ি, আমাকে কিন্তু তখন কেউ বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জোর করে জানায় না। সেই জায়গা থেকে আমার মনে হয়, সিরিয়াস হওয়াটা বেশী গুরুত্বপূর্ণ নাকি মানুষকে কিছুটা তথ্য, এবং নতুন কিছু দেয়াটা গুরুত্বপূর্ণ? সেই জায়গায় কথা হতে পারে।

    হুমায়ূন আহমেদ নির্মিত চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে কোন চলচ্চিত্রটিকে শাওনের কাছে সবচেয়ে বেশী শক্তিশালী মনে হয়? আগুনের পরশমনি।

    কেন?

    কারণ এই ছবিতে অসম্ভব একটা সারল্য আছে। যুদ্ধ দেখাতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের যে ধরনের ভয়াবহতা দেখানোর চেষ্টা করা হয় আমাদের সিনেমায়, সেখানে সম্মুখ যুদ্ধ না দেখিয়েও সেই সময়কার যেই ভয়াবহতা ‘আগুনের পরশমনি’তে দেখানো সম্ভব হয়েছে এটা আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ বলেই মনে হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সিনেমাগুলো যদি দেখেন, অনেক সিনেমা আছে যে সম্মুখ সমর দেখানো হয়েছে। ‘সেভিংস প্রাইভেট রায়ান’-এর মতো সিনেমা আছে, যেগুলোতে ভয়ংকর যুদ্ধ দেখানো হয়েছে। কিন্তু এসবের বাইরে গিয়েও যদি ‘দ্য পিয়ানিস্ট’-এর মতো সিনেমা দেখেন তাহলে দেখবেন সেখানে যুদ্ধ না দেখিয়েও যুদ্ধের ভয়াবহতা মারাত্মকভাবে তুলে ধরেছেন নির্মাতা। এইসব জায়গা থেকে ‘আগুনের পরশমনি’কেও আমাদের কাছে অনেক ইনোসেন্ট একটি সিনেমা বলে মনে হয়। অনেক বড় একটা কাজ। যদিও হুমায়ূন নিজে মনে করতেন তার নির্মিত ‘ঘেটুপুত্র কমলা’ সবচেয়ে মেচিউরড একটা কাজ।

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close