• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

আমাদের মুক্তিসংগ্রাম ও কৃষক

প্রকাশ:  ১৬ ডিসেম্বর ২০১৭, ০০:৪৭
শাইখ সিরাজ

হাজার বছরের ঐতিহ্যে লালিত বাংলার জীবন-জীবিকা ও সংস্কৃতি কৃষিনির্ভর। এখানে জীবনের সব অনুষঙ্গই রচিত হয়েছে কৃষকের চিন্তা, শক্তি, প্রয়াস ও উদ্যোগ ঘিরে। কৃষক তথা মেহনতি মানুষই শাসন-শোষণের প্রচলিত বৃত্তগুলো ভেঙেছে। মানুষের জন্য নতুন নতুন পথ তৈরি করেছে। জীবন কাঠামো এগিয়ে নিয়েছে।

ইতিহাসের একটু পেছন ফিরে তাকালেই দেখা যায় সুবিধাভোগী উচ্চবিত্ত শ্রেণি প্রচলিত প্রথার বিরুদ্ধে গিয়ে কোনো দিন আন্দোলনে নামেনি, বরং তারা আপস করেছে। আর সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন রচনা করেছে একেবারে তৃণমূল জনগোষ্ঠী। তেভাগা কিংবা নীল চাষবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে এই বাংলার সব বিদ্রোহ-আন্দোলনের পেছনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে গ্রামীণ জনগোষ্ঠী। বিশেষ করে কৃষক। কৃষকের স্বপ্নসাধের পথ ধরেই রচিত হয়েছে সমাজ বিনির্মাণের রূপরেখা। শোষকের বিরুদ্ধে সূচিত হয়েছে একেকটি আন্দোলন।

সম্পর্কিত খবর

    সেখানে সবচেয়ে বড় ত্যাগ স্বীকার করেছে তৃণমূল সাধারণ মানুষ। কৃষক। ব্রিটিশবিরোধী সিপাহি আন্দোলনে অধিকাংশ সুবিধাভোগী জমিদারই ব্রিটিশদের পক্ষাবলম্বন করেছে। সুবিধাভোগীরা সংগ্রাম করে না, করে বঞ্চিতরা। আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্নসাধও রচিত হয়েছে কৃষিজীবী জনগোষ্ঠীর শোষণ, বঞ্চনা, উপেক্ষার পটভূমি সামনে নিয়ে। আমি ২০০৭ সালে গিয়েছিলাম দিনাজপুরের চিরিরবন্দরে। সেখানে তালপুকুর নামে একটি জায়গা তেভাগা আন্দোলনের রণাঙ্গন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ওই যুদ্ধের স্থানীয় সংগঠকদের মধ্যে শরত্চন্দ্র মণ্ডল, বীরেন মণ্ডলের সঙ্গে আমার কথা হয়। তারা এখন আর বেঁচে নেই। সেদিন তারা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম গড়ে তুলেছিলেন, তা কারও ব্যক্তিগত স্বার্থে ছিল না। তারা চেয়েছিলেন গোটা বাংলার কৃষকের মুক্তি। নির্যাতিত-নিপীড়িত বহু বছরে পুঞ্জীভূত দাবি আদায়ের লক্ষ্যেই তারা সেদিন নিজের জীবন বাজি রেখেছিলেন। ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ রাজত্ব শেষে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল এবং মোট রপ্তানি আয়ের বড় অংশটি আসত পূর্ব পাকিস্তানে উৎপাদিত পাট থেকে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক ক্ষমতা ও অর্থনৈতিক সুবিধা আনুপাতিক ছিল না। বছরের পর বছর আঞ্চলিক ভিত্তিতে ক্রমাগত বৈষম্যের শিকার হতে থাকে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ। এ বৈষম্য মোচনের পথ হিসেবেই আসে স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্ন। এর চূড়ান্ত রূপরেখা হিসেবে আসে ঐতিহাসিক ছয় দফা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষকের বঞ্চনা বিশ্লেষণ করে ছয় দফা দাবি উত্থাপনের পর পাকিস্তানি শাসকদের টনক নড়ে যায়। যার পরতে পরতে ছিল কৃষকের বঞ্চনামুক্তির দাবি-দাওয়া। তাদের আশা-প্রত্যাশার কথা। পরবর্তীতে ১৯৬৯ সালে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ যে ১১ দফা প্রণয়ন করে সেখানে আরও বেশকিছু দাবি সংযোজিত হয়। এই ১১ দফায় পূর্ণতা পায় এ দেশের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের দাবিগুলো। আমরা দেখি, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এ দেশের ছাত্র আন্দোলনের ভূমিকা শুরু হয়। পরবর্তীতে ’৬২ সালের হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে তাদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত সক্রিয়। অতঃপর তারা ’৬৮ সালের ডিসেম্বর থেকে ’৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ছাত্ররা যে এক সুসংবদ্ধ ও সফল আন্দোলন গড়ে তুলেছিল তা ইতিহাসে বিরল যা তারা ঐতিহাসিক ১১ দফা দাবি পেশ করে তার সূচনা করেছিল। সে সময়ের ছাত্রনেতারা তখন আন্দোলনের শক্তি সঞ্চয়ের জন্য গ্রামে চলে যেতেন। কৃষকের চাহিদা নিরূপণ করতেন। দেশের সংকটগুলো বিশ্লেষণ করতেন। দেশের সামগ্রিক চিত্র হৃদয়ে আঁকার জন্য তাদের বার বার গ্রামের কৃষিজীবী মেহনতি মানুষের সান্নিধ্য, তাদের ভাষা, তাদের জীবনীশক্তিকে গ্রহণ করতে হয়েছে। বর্তমান সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী, ডাকসুর সাবেক ভিপি তোফায়েল আহমেদ, সে সময়ের তুখোড় ছাত্রনেতা ক্ষেতমজুর আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ও বর্তমানে কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, বঙ্গবন্ধুর একাত্তরে ছাত্রলীগের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকীসহ অনেকের সঙ্গেই আলোচনা করেছি। তারা বলেছেন, একাত্তরের পটভূমি রচনার পেছনে বাংলার কৃষি ও কৃষকের নিবিড় এক প্রভাব রয়েছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুও তার প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামের নেতৃত্বদানের ক্ষেত্রে কৃষকের সেই ভূমিকাকে সবচেয়ে বেশি সামনে এনেছেন। এর পথ ধরেই আসে একাত্তরের মার্চ। ৭ মার্চের ভাষণে ঝাঁপিয়ে পড়া সমবেত লাখো মানুষের প্রায় সবই ছিল কৃষক শ্রমিক সাধারণ মানুষ। বঙ্গবন্ধুর আত্মবিশ্বাসের জায়গাটিও ছিল কৃষক। আহ্বানও ছিল এই সাধারণ মেহনতি মানুষের উদ্দেশ্যেই। এ ভাষণ পৃথিবীর রাজনৈতিক ইতিহাসের এক অমর মহাকাব্য। সম্প্রতি ইউনেসস্কো স্বীকৃতিপ্রাপ্ত এ ভাষণ ছিল একটি জাতির দিকনির্দেশনা ও আত্মপরিচয়ের প্রধান ক্ষেত্র। এটিই ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার মূলমন্ত্র। মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে তারাই অংশ নিয়েছিলেন যারা পাকিস্তানিদের নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়ে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন। এটি ছিল তাদের শোষণমুক্তির যুদ্ধ। স্বাধীন ভূমিতে ফসল ফলানোর চূড়ান্ত তাগিদ। পরাধীনতার গ্লানি ঘোচাতে অর্থনৈতিক মুক্তি লাভ করতে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ছাড়া আর তাদের সামনে কোনো পথ খোলা ছিল না।

    মুক্তিযুদ্ধে গ্রাম বাংলার সাধারণ কৃষকের ভূমিকা প্রশ্নাতীত একটি বিষয়। তাদের বীরত্বগাথা ইতিহাসের এক সোনালি অধ্যায়। সুদীর্ঘ বঞ্চনার পথ পেরিয়ে এসে তারা নিজের জীবনকে তুচ্ছ করেছেন। সবাই ভেবেছেন জীবনের বিনিময়ে একটি স্বাধীন দেশ পেলে তা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য হবে নিরাপদ এক আবাস ক্ষেত্র। তাই যে হাতে তারা লাঙল ঠেলেছেন, ধান কেটেছেন, নৌকার দাঁড় টেনেছেন, জীবিকার জন্য প্রাণান্ত শ্রম দিয়েছেন সে হাত তাদের উদ্যত হয়েছি শত্রুর মোকাবিলায়।

    মুক্তিসংগ্রাম ধারণার মধ্যে দুটি উপাদান আছে। একটি হলো জাতীয় মুক্তি এবং অন্যটি অর্থনৈতিক, সামাজিক, শ্রেণিগত শোষণমুক্তি। আর এই মুক্তির মন্ত্রক ছিল আমাদের কৃষকসমাজ। আমরা গত দেড় দশকে দেশের বিভিন্ন রণাঙ্গনের স্মৃতিক্ষেত্রে গিয়েছি। কুষ্টিয়ার দুর্বাচারা বংশীতলার এখনো জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের জবানিতে পাই মুক্তিযুদ্ধের সেই চেতনার কথা। তারা অকপটে বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে যারা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন, তাদের শতভাগই ছিলেন গ্রামের মানুষ, তাদরে মধ্যে ৯৮ ভাগই কৃষক। ঢাকার অদূরে মানিকগঞ্জের বীর মুক্তিযোদ্ধারাও বলেন একই কথা। তখন কৃষকের ঘরের সন্তান টগবগে তরুণরা কেবলই প্রবেশ করবে সংসার জীবনে। কেউ যাবে চাকরিতে। সবকিছু ফেলে তারা আগে ঝাঁপিয়ে পড়েন দেশমাতৃকা মুক্ত করার সংগ্রামে। নারায়ণগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত বন্দরের মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে গিয়েছিলাম কয়েক দিন আগে। তারাও শোনালেন একই চেতনার সুর।

    সেদিনকার পূর্ব পাকিস্তানের ৫৫ হাজার বর্গমাইলের একটি গ্রাম। ১৬টি জেলা সদরের বাইরেই ছিল বিস্তীর্ণ কৃষিভূমি। গ্রামের ঘরবাড়ি, কয়েকটি চায়ের দোকান, দু-একটি আড়ত আর তরিতরকারি ও মুদি দোকানের বাইরে ছিল মেঠোপথ, কৃষিজমি, জলাভূমি, গাছের ছায়া। সেখানে শহুরে অট্টালিকা আর নাগরিক আভিজাত্যের স্থান ছিল না। কৃষক ছিল সবকিছুর মূলে। তারাই ছিল ঐতিহ্যের বাহক। এখনো যুদ্ধদিনের সবচেয়ে গভীর স্মৃতিচিহ্ন, কষ্ট, যন্ত্রণা, স্বজন হারানোর বেদনা গ্রামের সাধারণ কৃষকই বেশি বহন করে চলেছে। আবার তারাই দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করছে। স্বাধীনতার স্বপ্ন পূরণে তারা ঠিকই তাদের শপথ ধরে রেখেছেন। একচুলও সরে যাননি একাত্তরের সেই চেতনা থেকে। কিন্তু এমন শপথ সকল শ্রেণি পেশার মানুষ কি ধরে রাখতে পেরেছি? মহান বিজয়ের ৪৭ বছরে পৌঁছেছি আমরা। আমাদের জীবনধারার সব ক্ষেত্রে পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখছি বিশ্বায়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে। বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছি টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনা। কিন্তু তা বাস্তবায়নের পথ কতটা কৃষি ও কৃষককে কেন্দ্র করে, প্রশ্ন থেকে যায়। আজকের এই মহান দিনে আমরা আবারও মেহনতি মানুষের কথাই ভাবতে চাই। ভাবতে চাই গ্রামের সাধারণ মানুষের কথা। যারা ছাড়া আমাদের আত্মপরিচয় থাকে না। একাত্তরের সকল শহীদ, বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ দেশের আপামর কৃষিজীবী মানুষের প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা।

    লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

    সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close