• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

অসহনীয় চালের দাম, সহনশীল ঘুষ

প্রকাশ:  ০৪ জানুয়ারি ২০১৮, ০১:৩৩
আবু হেনা

ইংরেজি ২০১৭ বিদায় নিল। কিন্তু এ বছরের অনেক স্মৃতি রেখে গেল মানুষের মনে। ২৪ ডিসেম্বর সচিবালয়ে গ্রামীণ ব্যাংকের লভ্যাংশ হস্তান্তর অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী এ এম এ মুহিত বললেন, ‘কৃষকের সুবিধার্থে সরকার চেয়েছিল চালের দাম বাড়ুক। তবে তা যে হারে বেড়েছে এটা অসহনীয়।’ এদিকে চালের দাম বাড়াতে দেশে শূন্য দশমিক ৩২ শতাংশ দারিদ্র্যের হার বেড়েছে এবং এই অস্বাভাবিক দাম বাড়ায় নতুন করে দারিদ্র্যের কবলে পড়েছে দেশের ৫ লাখ ২০ হাজার বাড়তি মানুষ। ২৩ ডিসেম্বর এ তথ্য প্রকাশ করে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সানেম বলেছে, চলতি অর্থবছরে প্রথম তিন মাসে যে পরিমাণ চাল আমদানি হয়েছে তা গত অর্থবছরের পুরো আমদানির প্রায় পাঁচ গুণ। অর্থমন্ত্রীর মতে, ‘এগুলো তাত্ক্ষণিক রিপোর্ট, এগুলো বিশ্বাস করা উচিত হবে না। গরিব লোক বাড়ছে না কমছে, এজন্য অন্তত বছরখানেক দেখা দরকার। বছর শেষে কী হবে জানি না। তবে চালের দাম বাড়ার কারণে অনেকের অসুবিধা হয়েছে। এতে কোনো সন্দেহ নেই। আমরা চেয়েছিলাম দাম কিছুটা বাড়ুক। তবে দামটা অনেক বেড়ে গেছে।’

মাননীয় অর্থমন্ত্রীর কথাগুলো শুনে ২০০৯ সালের এক দরিদ্র নারীর প্রশ্নটি মনে পড়ে গেল— ‘এই সরকারই কি আমাদের ৪০ টাকায় চাল খাওয়ায়?’ আজ বস্তিবাসী দরিদ্র, ভাগ্যহত সাধারণ মানুষ চড়া দামে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে গিয়ে আবার সেই একই প্রশ্ন করছে, ‘এই সরকারই কি আমাদের ৬০ টাকায় চাল খাওয়াচ্ছে?’ ভাগ্যবিড়ম্বিত এ দেশের মানুষ শুধু চেনার জন্যই এভাবে ওদের সরকারকে খুঁজে বেড়ায়। কারণ নির্বাচনী ইশতেহারে যে সরকার ১০ টাকায় চাল খাওয়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল এই সরকার সেই সরকার নয়। তারা তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী বন্যা, ঝড়, তুফান, ঘূর্ণিঝড়, খরা, মন্দা, দুর্ভিক্ষ এ সবকিছুকে অনেক ভালোভাবে চেনে-জানে। ভালো করেই জানে, কোনো কারণ ছাড়াই কীভাবে তরতর করে জীবনরক্ষাকারী নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেড়ে যায়। কিন্তু চড়া দামের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কীভাবে তড়িত্গতিতে আয়-উপার্জন বাড়ানো যায়, সে পথটি তাদের জানা নেই। তারা চেনে না, সরকারের ভিতরের সরকার কে? সেই সংঘবদ্ধ দুষ্টচক্রটিকে যারা পরিকল্পিতভাবে চাল-পিয়াজসহ বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোর দাম বাড়িয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখছে, এই প্রচণ্ড শীতে কত হতদরিদ্রের মৃত্যু হয়। গত তিন মাসে চালের আমদানি বিগত বছরের আমদানির পাঁচ গুণ, পিয়াজের মজুদও কম নয়। তবুও সরকারের অন্তত এক বছর প্রয়োজন এই দুষ্টচক্রের প্রয়োজন মেটাতে। আজ খাদ্যদ্রব্য ও আনুষঙ্গিক জিনিসপত্রের চড়া দাম সাধারণ মানুষের সহনশীলতার ওপর প্রচণ্ড আঘাত হেনেছে। সমাজের মধ্যবর্তী শ্রেণিও ধৈর্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে। মাননীয় অর্থমন্ত্রীর কথায় একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, সরকারই চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়ান-কমান। অন্তত এক বছর জনগণকে ‘গিনিপিগ’ করে কৃত্রিম দাম বাড়িয়ে এর ফলাফল না দেখে কোনো গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তাত্ক্ষণিক রিপোর্টের তোয়াক্কা করে না সরকার। জনগণের দুঃখ-দুর্দশা বাড়ছে, না কমছে তা নিরূপণ করতে প্রয়োজন এক বছরের সময়। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ যে ইশতেহার দিয়েছিল তাতে দিনবদলের ওয়াদা ছিল। রাজনৈতিক আচার-আচরণে সংস্কারের সদিচ্ছা ছিল। আরও ছিল অর্থনৈতিক সংকট মোচনের প্রতিশ্রুতি। ছিল নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনার প্রতিজ্ঞা। এরপর দীর্ঘ নয় বছর কেটে গেছে কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি আজও পূরণ হয়নি। স্বজন-তোষণ, দলপ্রীতি, প্রশাসনিক দুর্বলতা এবং দুর্নীতির কারণে সরকার জনগণের কাছে কোনো আশার বার্তা পৌঁছে দিতে পারেনি। এই ব্যর্থতার পেছনে ছিল রাজনীতির বাণিজ্যিকীকরণ এবং বাণিজ্যের রাজনৈতিকীকরণ। ফলে ঘটেছে নব্য ধনীগোষ্ঠীর উত্থান। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতাপশালী ব্যক্তিনির্ভর শাসনের পথ বেয়ে নব্য ধনীদের অভিযাত্রা রাজনীতিকে কক্ষচ্যুত করেছে। রাজনীতিবিদদের হাত থেকে রাজনীতি ছিনিয়ে নিয়েছে ধনবান শক্তিধরেরা। এদের অনেকেই পালন করে সন্ত্রাসী পেশিশক্তি। রাজনীতি ও গণতন্ত্র উভয়ই আজ এদের হাতে পণবন্দী। ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাধারণ মানুষ। একের পর এক সরকার এসেছে; কিন্তু ওদের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। আশার সংকট সৃষ্টি করেছে আস্থার সংকট। জনগণের দুঃখ-দুর্দশা কমানোর কোনো সঠিক ব্যবস্থা নেই। বেসরকারি খাতে ব্যবসা-বাণিজ্যের সংকোচন, সরকারি-বেসরকারি খাতে কর্মসংস্থানের ঘাটতি অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে বাধা সৃষ্টি করে জনসাধারণের ক্রয়ক্ষমতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

সম্পর্কিত খবর

    অর্থমন্ত্রী একসময় সোনালী ব্যাংকের ৪ হাজার কোটি টাকা অর্থ আত্মসােক ‘পিনাট’ অর্থাৎ চীনাবাজারের মতোই তুচ্ছ ব্যাপার বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। সে কারণেই হয়তো ঘটনার পর বেশ কয়েক বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও অদ্যাবধি ওই লুটেরা চক্র স্বাচ্ছন্দ্যে বিলাসী জীবন যাপন করছে। ২০০৯ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকের দিলকুশা, গুলশান, শান্তিনগর শাখা থেকে অনিয়মের মাধ্যমে মোট সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণের অভিযোগ ওঠার পর তদন্তে নামে দুদক। ঋণপত্র যাচাই না করে, জামানত ছাড়া জাল দলিলে ভুয়া ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়াসহ বিধিবহির্ভূতভাবে ঋণ অনুমোদনের অভিযোগ ওঠে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে। এরপর ২০১৫ সালের ২১, ২২ ও ২৩ সেপ্টেম্বর তিন দিনে ৫৬টি মামলায় ১৫৬ জনকে আসামি করা হয়। কিন্তু আসামির তালিকায় নেই পরিচালনা পর্ষদের কেউ। এই ব্যাংকের দুর্নীতি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের কয়েক দফা পর্যবেক্ষণ আসার পরই অতিসম্প্রতি ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুকে জিজ্ঞাসাবাদের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ব্যাংকিং খাত নিয়ে গ্রাহকদের উত্কণ্ঠা দিন দিন বাড়ছে। অনেক ব্যাংক গ্রাহকদের আমানত নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। কদিন আগে অর্থমন্ত্রী বললেন, প্রতিষ্ঠাতারাই লুটপাট করেছে ফারমার্স ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, আর্থিক খাতের অনিয়মের ক্ষেত্রে এক ধরনের বিচারহীনতার সংস্কৃতি চালু হয়েছে। সম্প্রতি ব্যাংকিং খাতের অনেক অনিয়ম-দুর্নীতি ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে। তদন্তের নামে দায়ীদের আরও সততার সনদ দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কাউকে ধরা হয় আবার কাউকে ধরা হয় না। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ব্যাপারে ফিলিপাইন এখন বাংলাদেশ ব্যাংককেই দায়ী করছে।

    আজ খেলাপি ঋণে বিধ্বস্ত ব্যাংকব্যবস্থা। এই খেলাপি ঋণের মোট পরিমাণ এখন ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। অবলোপন করা ঋণের ৪৫ হাজার কোটি টাকার হদিস নেই। এ টাকা আদায় হওয়ারও কোনো সম্ভাবনা নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ না থাকায় খেলাপি ঋণের পরিমাণ এখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। আজ শতাধিক পরিচালকের কাছে ব্যাংকিং খাত জিম্মি। পরিচালকরাই ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন ১ লাখ কোটি টাকার বেশি। কী হবে ব্যাংকের অবস্থা কেউ বলতে পারছে না। ওয়াশিংটনের ‘গ্লোবাল ফাইন্যানশিয়াল ইস্টোগ্রিটির’ রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০০৫ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে ৭৫ বিলিয়ন ডলার শুধু ইনভয়েস জালিয়াতি এবং অন্যান্য কারচুপির মাধ্যমে পাচার হয়েছে। সুইস ব্যাংকে এখন বাংলাদেশিদের পাচারের অর্থের পরিমাণ ৫ হাজার ৫৬৬ কোটি টাকা।

    এদিকে ঘাটে ঘাটে শুধুই চাঁদাবাজি। ফুটপাথ ঘিরে কোটি কোটি টাকার সিন্ডিকেট। পরিবহন সেক্টরে চলছে অবাধ বাণিজ্য। থানার চাঁদা, ফাঁড়ির চাঁদা, ঘাট চাঁদা— এ যেন চাঁদাবাজির এক মহোৎসব। চাঁদাবাজির কাছে সাধারণ জীবনযাত্রা বাঁধা পড়ে গেছে। ‘ব্যবসা-বাণিজ্য নিশ্চিন্ত রাখতে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান টেকাতে, সর্বোপরি প্রাণ বাঁচাতেও কাউকে না কাউকে চাঁদা দিতে হয়।’ (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১১ ডিসেম্বর, সাইদুর রহমান রিমনের রিপোর্ট)।

    অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়ে ঘুষ, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, লুটপাটের বিষয়ে সরকার সহনশীল নীতি অবলম্বন করেছে। ২৪ ডিসেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদফতরের কর্মকর্তাদের উদ্দেশে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বললেন, ‘আপনারা ঘুষ খাবেন, তবে সহনশীল হয়ে খাবেন। কারণ আমার সাহস নেই বলার যে, আপনারা ঘুষ খাবেন না। এটা অর্থহীন বলা হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘শুধু যে অফিসাররা চোর, তা নয়। মন্ত্রীরাও চোর। আমি নিজেও চোর। এ জগতে এমনই হয়ে আসছে।’ তিনি অভিযোগ করেন, অধিদফতরের কর্মকর্তারা ঘুষের বিনিময়ে প্রতিবেদন দেন। স্কুল পরিদর্শনে গেলে খাম রেডি করাই থাকে। তারা খেয়ে-দেয়ে খাম নিয়ে রিপোর্ট দেন। বলেন, ‘স্কুল ঠিক আছে’। ১৯ ডিসেম্বর এশিয়াটিক সোসাইটির এক অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ প্রফেসর রেহমান সোবহান বলেছেন, ‘রাজনীতি এখন ব্যবসার সম্প্রসারিত অংশ এবং টাকা নির্বাচনে জেতার পথ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দলগুলোর ভিতরে অর্থ ও পেশিশক্তি প্রবেশ করেছে। ফলে রাজনীতি ধনীদের খেলায় পরিণত হয়েছে।’ একই দিনে অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাত বলেছেন, ‘সঠিক অডিট হলে অর্ধেক ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যাবে।’ আজ এ দেশে যা সবচেয়ে প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হলো ক্ষমতার নেশা। বিত্তবৈভব ও সম্পদের লোভ। প্রতিপত্তি অর্জন ও প্রভাব বিস্তারের দুর্নিবার কামনা-বাসনা। দূষিত পরিবেশ ও ব্যাধিগ্রস্ত মনমানসিকতা। অপশাসন, ক্ষমতার অপব্যবহার সমাজকে দুর্নীতির করালগ্রাসে ক্ষতবিক্ষত করেছে। চলছে হরিলুট। ঘুষখোর সরকারি কর্মকর্তা, দুর্নীতিপরায়ণ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্যে জনজীবন আজ বিপর্যস্ত। রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রায় অকার্যকর। গত দুই দশকে দুর্নীতি শুধু বিস্তার লাভই করেনি, দুর্নীতি সারা দেশ গ্রাস করেছে। ২০০০ সালের বিশ্বব্যাংকের এক দলিলে বলা হয়, ‘দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হলে বাংলাদেশের মোট বার্ষিক জাতীয় (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার আরও ২.৯ ভাগ বৃদ্ধি পেত এবং মাথাপিছু গড় জাতীয় আয় দ্বিগুণ দাঁড়াত।’ অর্থাৎ আমাদের হিসাবে প্রবৃদ্ধি জিডিপির শতকরা ১০ ভাগে উন্নীত হতো এবং জাতীয় মাথাপিছু আয় পৌঁছে যেত ৩ হাজার ডলারে।

    দুর্নীতি শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নই ব্যাহত করে না, সুশাসন ও গণতন্ত্রকেও বিকলাঙ্গ করে। এই দুর্নীতির উৎস কোথায়? এর উৎস মস্তিষ্কে। ফলে ধীরে ধীরে প্রশাসনের অঙ্গসমূহ ব্যাধিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। রাজনৈতিক স্তরে দূষণ ও বিকৃতি দুর্নীতির উৎসস্থল। ১৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশ প্রতিদিনে নিজামুল হক বিপুলের এক প্রতিবেদনে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের একটি চিত্র ফুটে উঠেছে। ‘মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর অব্যবহৃত গাড়িতেও ব্যয়’ শিরোনামে প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘২০১৪ সালে ভোটারবিহীন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এলে পুরনো গাড়ির বদলে মন্ত্রীরা নতুন গাড়ির আবদার জানান। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৬ সালের জুনে ৫০টি কোটি টাকা মূল্যের হাইব্রিড ক্যামরি সিডন গাড়ি কেনা হয়। কিন্তু এই গাড়ির ৪০টি পরিবহন পুলেই পড়ে আছে। কারণ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা ব্যবহার করছেন বিভিন্ন দফতর, অধিদফতর ও প্রকল্পের গাড়ি। তবে মন্ত্রীরা এসব গাড়ি ব্যবহার না করলেও গাড়ির বিপরীতে বরাদ্দ জ্বালানির টাকা চলে যাচ্ছে তাদের বেতনের সঙ্গে। সূত্রমতে, প্রতিটি গাড়ির জন্য ১৮ লিটার জ্বালানি বা অকটেন বরাদ্দ। সেই হিসাবে প্রতিটি গাড়ি বাবদ ৪৮ হাজার ৬০ টাকা মাস শেষে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীদের বেতনের সঙ্গেই তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হচ্ছে।’

    প্রসঙ্গত, দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশেই এত দামি ও বিলাসবহুল গাড়ি মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের দেওয়া হয় না। আমাদের পাশের দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে সচিব-মন্ত্রীরা বাসে চড়েন। বাংলাদেশেও ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত যুগ্ম-সচিবদের গাড়ি দেওয়া হতো না। এরশাদ সরকার আমলে দুজন যুগ্ম-সচিবের জন্য একটি গাড়ি বরাদ্দ করা হয়। বাংলাদশ প্রতিদিনের রুকনুজ্জামান অঞ্জনের আরেকটি প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, ‘উপসচিবদের গাড়ির জন্য ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ’ হওয়ার পরও আরও ২৯১ কোটি টাকা দাবি করা হয়েছে। বর্তমানে উপসচিবের সংখ্যা ১ হাজার ৫৩৯। যদিও মঞ্জুরিকৃত পদের সংখ্যা ৫০০-এর অধিক নয়। এদের সবাই ৩০ লাখ টাকা বিনাসুদে ঋণ পাবেন গাড়ি কেনার জন্য। শুধু তাই নয়, এই গাড়ি ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রতি মাসে আরও ৫০ হাজার টাকা তারা সরকারের কাছ থেকে ভাতা হিসেবে পাবেন। উল্লেখ্য, ১৯৭১-এর আগে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সচিবালয়ে ৫৯ জন যুগ্ম-সচিব ও ২০৩ জন উপসচিব ছিলেন। সচিবের সংখ্যা ২০-এর অধিক ছিল না। বাংলাদেশ সচিবালয়ের এই অবাস্তব স্ফীতাবস্থার সঙ্গে ভারতের দিল্লির সচিবালয়ের একটি তুলনামূলক পর্যালোচনা করলেই এই বক্তব্যের যথার্থতা প্রমাণিত হবে। ভারতে এমনও রাজ্য আছে যার আয়তন বাংলাদেশের চেয়ে বড়। রাজ্যের সংখ্যা ২৮টি।

    আজ মূল্যবোধের অবক্ষয় ও নৈতিকতার স্খলন সমাজের শিরায় শিরায় প্রবাহিত হচ্ছে। সমাজ একটি সমন্বিত সত্তা। জীবসত্তার মতো সমাজের বিভিন্ন অঙ্গও পরস্পর নির্ভরশীল। তাই এক অঙ্গের রোগ ও দুর্বলতা অন্য অঙ্গকেও ব্যাধিগ্রস্ত করে। ইংরেজ শাসনামল থেকেই এ দেশের শাসক-প্রশাসক গোষ্ঠীর ঐতিহ্যের অঙ্গ ছিল একটি সুস্পষ্ট ও অলঙ্ঘনীয় আচরণবিধি। এর দ্বারা তাদের মধ্যে যে মূল্যবোধের বিকাশ হতো তার নির্যাস ছিল রাজনৈতিক, জাতিগত, শ্রেণিগত সব বিষয়ে নিরপেক্ষতা, সততা, বিশ্বস্ততা ও দক্ষতা। এ কারণেই তারা অন্য সবার দৃষ্টিতে এক বিশেষ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। আজ সেই অবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। আজ শাসন-প্রশাসনে কোথাও নিরপেক্ষতা, সততা, বিশ্বস্ততা, দক্ষতার কোনো স্থান নেই।

    সম্প্রতি সিপিডির একটি অনুশীলনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ধনবানদের শীর্ষে ৫%-এর আয়-রোজগার সর্বনিম্নের ৫%-এর চেয়ে ১২১ গুণ বেশি। ২০১০ সালে এটা ৩১.৫ গুণ ছিল। ২০১০ সালে এই শীর্ষ ৫% বিত্তশীলর সম্পদ ছিল গরিব ৫%-এর সম্পদের ১১৭৬ গুণ। এখন তারা গরির ৫%-এর চেয়ে ২৫০০ গুণ বেশি সম্পদশালী। এ দেশের শতকরা ৯৭ ভাগ মানুষ বিপত্সংকুল পরিস্থিতিতে জীবনযাপন করে। এর মধ্যে গ্রামের মানুষ সবচেয়ে বেশি অবহেলিত, নিগৃহীত।

    সম্প্রতি ভারতে ‘ফগ’ নামে একটি পারফিউমের প্রচুর চল হয়েছে। এই পারফিউমের বিজ্ঞাপনটিও খুব মজার। এতে একজন পাকিস্তানি সীমান্তরক্ষী, ভারতীয় সীমান্তরক্ষীকে জিজ্ঞাসা করে জনাব কী চলছে? উত্তরে হিন্দুস্তানি জওয়ান বলছে, ‘হিন্দুস্তানে তো এখন ফগ চলছে।’ আজ একই প্রশ্ন যদি ভারতীয় বিএসএফ, বিজিবিকে করে তাহলে তার উত্তর হবে, ‘বাংলাদেশে এখন হরিলুট চলছে।’ চলছে লুটেরা, প্রবঞ্চক আর কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর রমরমা ব্যবসা। আর এর মাশুল দিচ্ছে এ দেশের ৯০ ভাগ সাধারণ মানুষ। যারা ভ্যাট, কাস্টমস, একসাইজ এবং এআইটি দিয়ে বাংলাদেশের রাজস্ব সম্ভার পূর্ণ করছে। আর তা লুটপাট করছে ধনবান, বিত্তশালী আর ক্ষমতাধরেরা। আজ এই ক্ষুধার্ত, অপুষ্ট, নিগৃহীত জনগোষ্ঠীর অনিশ্চিত বিপত্সংকুল জীবনসংগ্রামে শোভন, শালীন ও সুষ্ঠু চিন্তার কোনো স্থান নেই। তাই যারা এখনো বালুতে মুখ গুঁজে দিবাস্বপ্ন দেখছেন তাদের কাছে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের বার্তাটি পৌঁছে দিয়ে শেষ করছি :

    ‘হে মহাজীবন আর এ কাব্য নয়

    এবার কঠোর কঠিন গদ্য হানো

    ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়

    কবিতা তোমায় দিলাম আজকে ছুটি

    পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।’

    লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য।

    সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close