• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

১০ থেকে ১২ হাজার শ্রমিক বেকার

ট্যানারি স্থানান্তর প্রক্রিয়ার মধ্যে পড়ে ভালো নেই চামড়া খাত

প্রকাশ:  ১৬ মার্চ ২০১৮, ১৬:০৩
পূর্বপশ্চিম ডেস্ক

সাভারে ট্যানারি স্থানান্তর প্রক্রিয়ার মধ্যে পড়ে ভালো নেই চামড়া খাত। একদিকে রফতানি কমে গেছে আশঙ্কাজনক হারে, অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ বাজারে চামড়াজাত পণ্যের জোগান কমে যাওয়ায় ফোম ও রেক্সিন পণ্যের ব্যবহার বাড়ছে। দেশের বাজারে চামড়াজাত পণ্য তৈরি করতেন এমন ব্যবসায়ীর সংখ্যা অর্ধেকে নেমে গেছে।

এ ছাড়া এ সময়ে অন্তত ১০ থেকে ১২ হাজার শ্রমিক বেকার হয়েছেন। চামড়া নষ্ট হয়ে গেছে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার। আর যে শ্রমিকরা সাভারে গেছেন তারাও নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। ট্যানারি শিল্পের সঙ্গে সংযোগ খাতের ব্যবসায়ীরাও ভালো নেই বলে জানা গেছে।

সম্পর্কিত খবর

    গত বছরের এপ্রিলে আদালতের আদেশে ইউটিলিটি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার মাধ্যমে মূলত হাজারীবাগ থেকে চূড়ান্তভাবে ট্যানারি শিল্প চলে গেছে সাভারের হেমায়েতপুরে। যদিও পরে ইউটিলিটি সংযোগ দেয়া হলে ট্যানারিগুলোতে চামড়ার ফিনিশিংয়ের কাজ হচ্ছে। ট্যানারি স্থানান্তরের এ প্রক্রিয়া দেড় দশক ধরে হলেও সিইটিপি স্থাপন ও ট্যানারি স্থানান্তর ছাড়া বিভিন্ন সংযোগ খাত কিংবা শ্রমিকদের জন্য কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। পরিকল্পনায় এই বড় গলদের কারণেই আজ এ শিল্প সংকটের মধ্যে পড়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। অনেকেই এ সময়কে ‘অন্ধকার যুগ’ বলছেন।

    সাভারের চামড়া শিল্পনগরী পরিপূর্ণ শিল্পনগরী হিসেবে গড়ে উঠতে অন্তত ১০ বছর সময় লেগে যাবে বলে ধারণা করছেন তারা। এ সময়ে রফতানির চাকা সচল রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ। দেড় দশক আগেই মূল প্রকল্পে শ্রমিক, কর্মচারীসহ সংযোগ খাতের ব্যবসায়ীদের আবাসন, নাগরিক সুবিধা, রাস্তা-ঘাট, স্কুল-কলেজ, হসপিটালসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণের উদ্যোগ নিলে আজ এ সংকটের মধ্যে পড়তে হতো না বলে মনে করছেন তারা।

    এ সংকটের ফলেই চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে কমে গেছে। বিশেষ করে চামড়া রফতানি কমেছে ৩১ শতাংশ। তবে চামড়ার জুতা রফতানি কিছুটা বেড়েছে। গত আট মাসে ৯০ কোটি মার্কিন ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানির লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও রফতানি হয়েছে ৭৮ কোটি ৫০ লাখ ডলারের। যা গত অর্থবছরের চেয়েও কম। গত অর্থবছরের এই সময়ে এ খাত থেকে রফতানি আয় হয়েছিল ৮২ কোটি ৭৬ লাখ ডলার। অর্থাৎ রফতানি কমেছে ৫ দশমিক ১৫ শতাংশ। এর মধ্যে শুধু চামড়া রফতানি কমেছে ৩১ দশমিক ৬২ শতাংশ এবং চামড়াজাত পণ্য (জুতা ছাড়া) তিন দশমিক ৪৪ শতাংশ। তবে চামড়ার জুতা রফতানি এ সময়ে বেড়েছে ছয় দশমিক ৭৪ শতাংশ।

    চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি কম হওয়ায় অন্তত দেড় থেকে দুই হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করছেন ট্যনারি মালিকরা। ট্যানারি স্থানান্তর প্রক্রিয়ার মধ্যে পড়ে অন্তত ৩৫ শতাংশ চামড়া নষ্ট অথবা গুণগত মান খারাপ হয়ে গেছে। গুদামে পড়ে আছে অনেক চামড়া। বিদেশি বায়াররাও আস্থা রাখতে পারছে না ট্যানারিগুলোর ওপর। সাভারে এখনো কমপ্লায়েন্স ইস্যু নিশ্চিত করতে না পারায় বহু বায়ার এ দেশ থেকে চলে গেছে। তাদের ফিরিয়ে আনা এখন কষ্টসাধ্য বলে মনে করছেন রফতানিকারকরা।

    সাভারের হেমায়েতপুরে ২০০ একর জমিতে ২০৫টি প্লটে হাজারীবাগের ১৫৫ ট্যানারি স্থানান্তরের কথা। ২০০৩ সালে প্রথম ১৭৫ টাকা ব্যয়ের এ প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও পরে তা এক হাজার ৭৮ কোটি টাকার প্রকল্পে পরিণত হয়। এটিকে একটি পরিকল্পিত শিল্পপার্ক দাবি করা হলেও এই প্রকল্পে ট্যানারি শিল্পের সঙ্গে সংযুক্ত কেমিক্যাল ব্যবসায়ী, কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ী, চামড়া রফতানিকারক, অভ্যন্তরীণ জোগান শিল্পসহ বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ীদের জন্য কোনো ব্যবস্থা নেই। এ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত প্রায় চার হাজার ঠেলাগাড়ি শ্রমিক ও ত্রিশ হাজার ট্যানারি শ্রমিকের জন্য কোনো নাগরিক সুবিধা রাখা হয়নি।

    জানা গেছে, গত বছরের এপ্রিলে ইউটিলিটি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার পরে হাজারীবাগের ট্যানারিগুলো বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ট্যানারির ভারি মেশিনগুলো নিয়ে যাওয়া হয় সাভারে। কিন্তু সেখানকার অবকাঠামো এখনো পুরোপুরি প্রস্তুত না হওয়ায় ফের ইউটিলিটি সংযোগ দেয়া হয় হাজারীবাগে। এতে চামড়া প্রস্তুত করার শেষের পর্যায়গুলো হাজারীবাগে সম্পন্ন করা হচ্ছে। ওদিকে সাভারের চামড়া শিল্পনগরীতে এখন পর্যন্ত ১০৫টি ট্যানারি উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করেছে বলে জানা গেছে। বাকি ৪৬টি ট্যানারির উৎপাদন কার্যক্রম আগামী কোরবানির ঈদের আগেই শুরু হবে বলে আশা করছেন বিসিকের প্রকল্প পরিচালক জিয়াউল হক।

    কথা হয় বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. শাহিন আহমেদের সঙ্গে। তিনি মানবকণ্ঠকে বলেন, সাভারে চামড়া শিল্পনগরী প্রস্তুত হওয়ার আগেই হাজারীবাগে ট্যানারি বন্ধ করে দেয়ায় আমাদের অন্তত ৩৫ শতাংশ চামড়া নষ্ট হয়ে গেছে। অনেক বায়ার এ দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। সারাবছর চামড়া আগের মতোই সংগ্রহ হলেও এখনো ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ ট্যানারি উৎপাদনে যেতে পারেনি। এ ছাড়া যে কমপ্লায়েন্স ইস্যুতে আমাদের সাভারে যেতে হলো সেই কমপ্লায়েন্স তো এখনো নিশ্চিত করা যায়নি। সিইটিপি এখনো প্রস্তুত হয়নি, কঠিন বর্জ্য শোধনেরও ব্যবস্থা হয়নি। তিনি বলেন, এক কঠিন অবস্থা আমরা পার করছি এখন। এ সময়ে অন্তত দেড় থেকে দুই হাজার কোটি টাকার চামড়া নষ্ট হয়ে গেছে বলে তিনি দাবি করেন।

    প্রকল্পের প্রস্তুতির ঘাটতি প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক জিয়াউল হক বলেন, কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারের (সিইটিপি) মূল চারটি মডিউল তৈরি হয়েছে। তবে এর আগে-পরে বেশকিছু ইউনিটের কাজ এখনো বাকি রয়ে গেছে। এ কারণেই কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। এগুলোর জন্য চীন থেকে মালামাল আনতে হবে। এ ব্যাপারে আমরা মন্ত্রণালয়ে জানিয়েছি। মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত দিলেই এই মালামাল আমদানির প্রক্রিয়া আমরা শুরু করতে পারব।

    শ্রমিকদের আবাসনসহ অন্যান্য নাগরিক সুবিধা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শিল্পপার্কের দ্বিতীয় ফেজ হলেই এ সমস্যার সমাধান হবে। দ্বিতীয় ফেজের জন্য মন্ত্রণালয় জমি অধিগ্রহণ ও সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এবার জমি অধিগ্রণের পরেই মূল প্রকল্প শুরু হবে। আশা করছি দু’এক সপ্তাহের মধ্যেই জমি অধিগ্রহণ ও সম্ভাব্যতা সমীক্ষা শুরু করতে পারব আমরা। তিনি বলেন, আমরা তো শ্রমিকদের জন্য বাড়ি করে দিতে পারব না। ট্যানারি মালিকদের জন্য প্লট বরাদ্দ দেব। তারাই শ্রমিকদের থাকার বাড়ি তৈরি করবে।

    কথা হয় ট্যানারি শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে। তিনি বলেন, শ্রমিকরা এখন এক মানবেতর জীবনযাপন করছেন। হাজারীবাগ থেকে সাভারে প্রতিদিন অন্তত ৪ ঘণ্টা যাতায়াতে ব্যয় হচ্ছে তাদের। দুপুরের খাওয়াসহ খরচ হচ্ছে অন্তত দেড়শ’ টাকা। কিন্তু এ সময়ে তারা অতিরিক্ত কোনো ভাতা পাচ্ছেন না। আমরা ট্যানারি মালিকদের সাময়িক ভিত্তিতে মাসিক তিন হাজার টাকা করে ভাতা চেয়েছি। কিন্তু তা মালিকরা দিচ্ছেন না। তিনি বলেন, গত ২০ বছর ধরে আমরা বলে আসছি, ট্যানারি স্থানান্তর করা হলে যেন শ্রমিকদের আবাসন, হাসপাতাল, সন্তানদের জন্য স্কুল-কলেজের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু তা করা হয়নি। প্রচুর ধুলা-বালুর মধ্যে তাদের কাজ করতে হচ্ছে। অনেক কারখানা তাদের আইডি কার্ডও দেয়নি। নতুন জায়গায় তারা এটি নিয়ে নানা ঝামেলায় পড়ছে।

    এদিকে হাজারীবাগে ট্যানারি থাকতে জবওয়ার্কের মাধ্যমে স্থানীয় বাজারের জন্য পণ্য তৈরি করতেন এমন ব্যবসায়ীর সংখ্যা প্রায় দেড় হাজার। কিন্তু ট্যানারি স্থানান্তরের পরে এই ব্যবসায়ীর সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে বলে জানালেন বাংলাদেশ লেদার ম্যানুফ্যাকচারার্স কো-অপারেটিভ সোসাইটির মহাসচিব ফখরুল ইসলাম। তিনি বলেন, নতুন জায়গায় গিয়ে জবওয়ার্ক করে পণ্য উৎপাদনে খরচ বেড়েছে অন্তত ২০ শতাংশ। এ ছাড়া নতুন এলাকায় গিয়ে ছোট ব্যবসায়ীরা অনেকেই ব্যবসা চালাতে অনিচ্ছুক কিংবা অপরাগ। এ অবস্থায় দেশীয় চামড়াজাত পণ্যের বাজার সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে। এই জায়গা রেক্সিন ও ফোমের পণ্য দখল করে নিচ্ছে বলে তিনি জানান।

    সূত্র: মানবকন্ঠ

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close