• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

পাঠান মুক্তিযোদ্ধা মমতাজ খানের স্ত্রীর মৃত্যু

প্রকাশ:  ২৪ জুলাই ২০১৮, ০১:২৭
বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

অনেক সময় অনেক অভাবনীয় ঘটনা ঘটে যা কারও চিন্তায় থাকে না। আমার জীবনে তেমনই এক ঘটনা ১৭ তারিখ গভীর রাতে। একটু আগেই ঘুমিয়েছিলাম। হঠাৎই বউয়ের মুখ দেখলাম। কুশি-কুঁড়ি দুজনই বাইরে যাওয়ার কাপড় চোপড় পরা। জিজ্ঞাসা করলাম, কী হয়েছে? দীপের মা বললেন, ‘লিলি ভাবী মারা গেছেন।’ মমতাজ খানের স্ত্রী লিলি এক অসাধারণ মহিলা।

স্বাধীনতার পর ওর সঙ্গে আমাদের পরিচয়। আমার রক্তের তিনজন বোন। মায়া-মমতা-সেবা-যত্নে আপন বোনদের সে পিছে ফেলেছিল। আমাদের পরিবারে সবকিছুতে রান্নায় হলুদের মতো সে জড়িয়ে ছিল। মা-বাবা তাকে নিজের সন্তানের মতোই ভাবতেন। বাবার মৃত্যু ছিল আকস্মিক। যে রাতে তিনি মারা যান তার আগের দিনও কোর্ট-কাচারি, মামলা-মোকদ্দমা করেছেন। আমাদের মারধর, রাগারাগি করতেন বলে তিনি যে খুব খারাপ মানুষ ছিলেন তেমন নয়। আল্লাহর প্রিয় বান্দা ছিলেন এটা তার মৃত্যু থেকেই বোঝা যায়। এক দিনও পরের ওপর ভর করে বা অন্যের দয়ায় এমনকি আমাদের ওপর ভরসা করে বাঁচতে হয়নি। চলনশক্তি নিয়ে তিনি আনন্দের সঙ্গেই এপার থেকে ওপারে গেছেন। মৃত্যুর তিন দিন আগে চোখের কষ্ট নিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন। গিয়েছিলেন আমাদের প্রিয় চক্ষু চিকিৎসক অধ্যাপক মোদাচ্ছেরের কাছে।

সম্পর্কিত খবর

    জনাব মোদাচ্ছের সবসময় যেভাবে বলেন সেভাবেই বলেছিলেন, ‘চাচা, আপনার চোখ আরও ভালো হবে বলতে পারছি না।’ মোদাচ্ছেরের কথায় বাবা আঘাত পেয়েছিলেন। সেখান থেকে বাবর রোডে এসে অনেকটাই ভেঙে পড়েছিলেন। আমি ছিলাম সংসদে। সংসদে খবর পাঠিয়ে-ছিলেন। বাবার খবর পেলে আমাদের কারও বসে থাকার উপায় ছিল না। আমরা কেউ বসে থাকতামও না। বাবাকে আমরা ভয় পেতাম, ভালোও বাসতাম। সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এসেছিলাম। এসে দেখি বাবা-মা পাশাপাশি সোফায় বসে আছেন। আমাকে দুজনের মাঝে বসিয়েছিলেন। ওভাবে দুজনের মাঝে কবে বসেছি মনে ছিল না। আমি বসতেই বাবা বললেন, ‘বজ্র, মোদাচ্ছেরকে চোখ দেখাতে গিয়েছিলাম। সে বলল চোখ আর এর থেকে ভালো হবে না। তুই বল, কোনো কিছু দেখতে না পেলে বেঁচে থেকে কী লাভ?’ বলেছিলাম, চিন্তা করছেন কেন। যদি মন চায় চলুন দিল্লি যাই। যে আপনার অপারেশন করেছে তাকে দেখিয়ে আসি।

    টাঙ্গাইল থেকে ঢাকা আসতে যে সময়, ঢাকা থেকে দিল্লি যেতে তার চাইতে বেশি সময় তো নয়। চলেন দিল্লিতে দেখিয়ে আসি। বাবা নিমরাজি হয়ে টাঙ্গাইল যাচ্ছিলেন। আমি যখন গাড়িতে উঠিয়ে দিচ্ছিলাম বড় ভাইয়ের পিকআপ দেখে ভালো লাগেনি। বলেছিলাম, এই খারাপ গাড়িটা আপনাকে দিয়েছে? আপনি আমার গাড়িতে যান। বাবা বললেন, ‘না না, লতিফ দেয়নি। আমি ইচ্ছা করে এনেছি।’ বলেছিলাম, এ গাড়িতে কষ্ট হবে। আপনি আমার গাড়ি নিয়ে যান। বলেছিলেন, ‘কোনো কষ্ট হবে না।’ চলে গিয়েছিলেন। পরের দিনটা ভালোই কেটেছিল। রাত আসতেই সেই আকাশ ভাঙা নির্মম খবর ‘বাবা নেই’। তখনই ছুটেছিলাম টাঙ্গাইলের পথে। মা ছিলেন বাবর রোডে। সকালে বউ-ছেলেমেয়ের সঙ্গে গিয়েছিলেন। বারান্দায় বাবার লাশ ছিল। মাদ্রাসার মাওলানারা কোরআন তিলাওয়াত করছিলেন। আমি সেই যে বাবার পায়ের কাছে বসে ছিলাম কবর হওয়া পর্যন্তই ছিলাম।

    যে রকম সময় বাবার মৃত্যুসংবাদ পেয়েছিলাম প্রায় একই সময় খুব যদি হেরফের হয় ২০-৩০ মিনিটের বেশি হবে না। দীপ-কুঁড়ি-কুশির মা জানালেন লিলি ভাবী নেই। ‘লিলি নেই’ শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। মারা গেলে লিলির স্বামী মমতাজ খান পাঠান মারা যাবে। সে অনেক বছর থেকে অসুস্থ। লিলি কেন মারা যাবে। এক দিন আগেও সে এসেছিল। দীপের আম্মুকে কীসব দিয়ে গেছে। চিরাচরিত নিয়মে তার যা যা দরকার নিয়ে গেছে। অবসরপ্রাপ্ত মেজর মান্নান ফোন করেছিলেন, ‘আগামীকাল বদরুদ্দোজা চৌধুরী, জনাব আ স ম আবদুর রব, মাহমুদুর রহমান মান্নার সঙ্গে আপনাকে নিয়ে বসতে চাই।’ বলেছিলাম, আমার বাসায় বসুন। তা বেগম সাহেবাকে বলতেই তিনি পরদিন লিলিকে রান্নাবান্নার জন্য খবর দিতে চেয়েছিলেন। আমার বাড়িতে কোনো রান্নাবান্না হলে লিলি সেখানে আছেই আছে। কিন্তু যে লিলিকে পরদিন প্রয়োজন তার মৃত্যুর সংবাদ শুনলাম গভীর রাতে। আমার বাসার কাছেই মারকাজুল ইসলাম। তারা শত শত লাশ ধোয়ায়। সে কারণে কতজনকে দেখতে পাই তার হিসাব নেই। দীপ-কুঁড়ি-কুশির মা সবাই গেলাম মারকাজুলে।

    আমি সারা জীবন জীবিত লিলির মুখ দেখেছি। লিলির মৃত মুখ দেখতে চাইনি। তাই দেখিনি। মেয়েদের নিয়ে বেগম লিলির মুখ দেখেছিলেন। পরদিন কাজী নজরুল ইসলাম রোড বায়তুল হারাম মসজিদে জানাজায় গিয়েছিলাম। আমার বাঁ পাশেই চেয়ারে বসে মমতাজ খান জানাজায় শরিক হয়েছিল। আমার মনে হয় সে আমায় চিনতে পারেনি। ডান পাশে ছিল বড় মেয়ে কাকুলীর স্বামী ওমর। লিলির ২ ছেলে ২ মেয়ে। তার মধ্যে ছোট ছেলে মন্টু অনেক আগেই মারা গেছে। এখন ছেলের মধ্যে বাবু, মেয়েদের মধ্যে কাকুলী ও আঁখি বেঁচে আছে। কাকুলীর বাড়ি বিশ্বরোডের কাছে। তাই সে এসেছিল। ছোট মেয়ে আঁখি অস্ট্রেলিয়ায়। সে মায়ের মরা মুখ দেখতে পায়নি। জন্মের পর মৃত্যু এক অবশ্যম্ভাবী সত্য। সবকিছুর পরিবর্তন আছে। কিন্তু মৃত্যুর কোনো পরিবর্তন নেই। জীবের মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। ইদানীং কেন যেন মুহূর্তে মুহূর্তে মৃত্যু খবর শুনতে পাই। সেখানে প্রিয় অপ্রিয় সবাই থাকে। সেই একই দিনে কালিহাতী থানা বর্গার মনিটর কাশেম মারা গেছেন। ভদ্রলোকের সঙ্গে আমাদের পরিচয় দীর্ঘদিনের। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে বংশাই নদীর পাড়ে বর্গার গোলাবাড়ি ফরেস্ট অফিসে দেখা হয়েছিল। খন্দকার বাতেনকে নিয়ে গিয়েছিলেন। খুবই খারাপ লেগেছে তার মৃত্যুর কথা শুনে। কিন্তু হঠাৎ করে লিলির মৃত্যু কেমন যেন একটা নাড়া দিয়ে গেল।

    লিলির স্বামী মমতাজ খান পাঠান এক পাতার ব্যবসায়ী। আমাদের দেশে আগে লোকজন টেন্ডু পাতার বিড়ি খেত। আমার বিড়ি-সিগারেটে কোনো নেশা নেই। তাই ওসব জানি না। মধুপুর থেকে সখীপুর হয়ে গাজীপুর পর্যন্ত এক ধরনের পাতার গাছ ছিল। যেটাকে গাদিলা পাতা বলে। আমাদের এখানে সে পাতার ব্যবহার না থাকলেও পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল। সে পাতা বিক্রি করে মমতাজ খান কোটি কোটি টাকা রোজগার করে। আর মমতাজ খান শুধু পাতার ব্যবসা করেই টাকা রোজগার করেনি। আগে থেকেই তাদের পারিবারিক সম্পত্তি ছিল হাজার কোটির বেশি। আমি কখনোসখনো অবাক হয়ে ভাবী, মমতাজ খান পাতার ব্যবসা করতে পূর্ব পাকিস্তানে এসেছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযুদ্ধের চারণভূমিতে তার পাতার ক্যাম্প ছিল। যুদ্ধের সময় আর ব্যবসা হয়নি। কিন্তু তাদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ হওয়ায় সবসময় খবরাখবর প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র যত রকমের সাহায্য-সহযোগিতার দরকার সবই করেছে। মমতাজ খানের ভাই কর্নেল বশির খান পুরান ঢাকার দায়িত্বে ছিলেন। এসব কারণে মমতাজ খান আমাদের অনেকভাবে সাহায্য করতে পেরেছে। তার সাহায্য-সহযোগিতা আমরা যেভাবেই বলি না কেন, তার ত্যাগ-তিতিক্ষার কথা কোনোভাবেই পুরো বলা যাবে না। স্বাধীনতার পর মমতাজ খান আমাদের পরিবারের একজন হয়ে যায়। এখনো তাই আছে। সেই কারণে বঙ্গবন্ধুর কাছে ছিল তার অবাধ যাতায়াত। একমাত্র পাঠান মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বঙ্গবন্ধু নিজের হাতে লিখে মমতাজ খানকে যেভাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন, সেভাবে আমাকেও দেননি। ’৭৫-এ বঙ্গবন্ধু নিহত হলে আমি যেমন সর্বস্বান্ত হই, শত্রুদের হাতে মমতাজ খান জীবন না হারালেও তার কোথাও দাঁড়াবার ঠাঁই ছিল না।

    এখনো দিন এনে দিন খাওয়ার অবস্থা তার। যার পাকিস্তানে এখনো কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি, সেই মানুষ পাকিস্তানকে স্বীকার না করে শুধু বাংলাদেশের নাগরিক হওয়ায় সমস্ত পৈতৃক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হয়ে পথের কাঙাল। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বাড়িঘর পুড়ে ছারখার হয়েছে। কিন্তু তবু আমরা আমাদের পৈতৃক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হইনি। যুদ্ধ শেষে আমাদের সম্পদ আমরা ফিরে পেয়েছি। কিন্তু কী নিষ্ঠুর পরিণতি মমতাজ খান তা পায়নি। যার জমিদারিতে কলকারখানায় হাজার লোক কাজ করত, এখনো করে সেই মমতাজ এখানে বাঙালি লিলিকে বিয়ে করে সংসার পেতেছিল। তার কোথাও দাঁড়াবারও ঠাঁই ছিল না। সরকার একটা ২- পৌনে ২ কাঠার বাড়ি দিয়েছে। কিন্তু তাও নিষ্কণ্টক নয়। মমতাজ মরার আগে বাড়ি নিষ্কণ্টক হবে তাও জোর দিয়ে বলা যায় না। সত্যিই মমতাজের জন্য দুঃখ হয়! স্বাধীনতাযজ্ঞে কাদেরিয়া বাহিনীতে যোগ দিয়ে সে হয়েছে সর্বহারা। বাংলাদেশকে মনেপ্রাণে নিজের দেশ হিসেবে গ্রহণ করলেও বাংলাদেশের প্রশাসন তাকে বুকে জায়গা দেয়নি। দুঃখ-দুর্দশা আর অসম্মান তার নিত্যদিনের সাথী। তা না হলে তার স্ত্রীর জানাজায় সে আমাকে চিনতে পারে না! যে সারা জীবন আমায় বাবার মতো সম্মান করেছে। তাই মনে হয় আল্লাহ বলেছেন, পরপারে ছেলে বাবাকে, বাবা ছেলেকে চিনতে পারবে না। কেউ কারও কাজে আসবে না। তেমন টাই মমতাজের ক্ষেত্রে মনে হলো। আল্লাহ লিলিকে বেহেশতবাসী করুন, মমতাজ খানের পরিবারকে এই শোক সইবার শক্তি দিন।

    মৃত্যু যেমন সত্য, তেমন মৃত্যু-পরবর্তী জীবন সত্য। রাতের পর দিন, দিনের পর রাত— কেউ কাউকে অতিক্রম করতে পারে না। পাশাপাশি চলে, সঙ্গে সঙ্গে চলে। কদিন আগে ফ্যালকন হলে গিয়েছিলাম সৈয়দ আহমদ ফারুকের ছেলে সৈয়দ নোবেদ নাজিম অঙ্কনের বিয়েতে। সেখানে কত পুরনো মানুষকে দেখলাম। ভালো না লেগে উপায় ছিল না। শেখ শহীদ, রেলমন্ত্রী মজিবুর রহমান, কুমিল্লার পাখি, আফতাব উল ইসলাম কতজনের নাম বলব। সে যেন এক মিলনমেলা। ষাটের দশকের কত জ্ঞানী-গুণী-ত্যাগী মানুষের এক অসাধারণ সমাগম। পবিত্র বিবাহ অনুষ্ঠান সমাজের এক মহামূল্যবান সম্পদ। যে দেশে সামাজিক অনুষ্ঠান যত উন্নত সেই দেশ সভ্যতা-ভব্যতায় তত সমৃদ্ধ। আমাদের দেশে একসময় এর চাইতেও গভীর শক্ত সামাজিক বন্ধন ছিল যা আস্তে আস্তে অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়ছে। ১৭ তারিখ রাত ৮টার দিকে হঠাৎই ফারুক ভাই এসেছিলেন। স্বাস্থ্য গতর আমার অর্ধেক। কিন্তু জ্ঞান-গরিমা-বিদ্যা-বুদ্ধি অর্থ-বিত্তে শতগুণ। ১৯৬৮-৬৯-এ এস এম হলের ভিপি, ছাত্রলীগের কোষাধ্যক্ষ। বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকীও তখন এস এম হলে থাকতেন।

    আমার মতো বড় ভাইয়েরও কোনো দিন কোনো পদ ছিল না। ’৬৯-এর শেষের দিকে আমি টাঙ্গাইল জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। সেই সম্মেলনে যাওয়ার কথা ছিল আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক জননেতা আবদুল মান্নান, শেখ ফজলুল হক মণি, তোফায়েল আহমেদ, শাজাহান সিরাজ, মনিরুল হক চৌধুরী, তাজুল ইসলাম ও সৈয়দ আহমদ ফারুকের। জনাব শাজাহান সিরাজ এবং তার অংশের লোকেরা চাচ্ছিলেন টাঙ্গাইল জেলা ছাত্রলীগের সম্মেলন না হয়। তাই টঙ্গী পর্যন্ত গিয়েও সর্বজনাব আবদুল মান্নান, শেখ ফজলুল হক মণি, তোফায়েল আহমেদ, শাজাহান সিরাজরা ফিরে এসেছিলেন। কিন্তু সম্মেলনে হাজির হয়েছিলেন সাংগঠনিক সম্পাদক মনিরুল হক চৌধুরী, তাজুল ইসলাম, সৈয়দ আহমদ ফারুক ও অন্য নেতৃবৃন্দ।

    শাজাহান সিরাজের পক্ষে তেমন কেউ ছিল না। সম্মেলনে উপস্থিত দু-আড়াই হাজার ছাত্রের মধ্যে তিন-চার শর বেশি হবে না। সাবজেক্ট কমিটি ছিল ৭০-৮০ জনের। তার মধ্যে ১৮-২০ জন শাজাহান সিরাজের, বাকি সবাই আমাদের। ১৮-২০ জনের সবাই ছিল জেলা কমিটির সদস্য। ১০টি উপজেলা, ৮-১০টি কলেজ কমিটি যাদের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ছিল সাবজেক্ট কমিটির সদস্য। তারা কেউ শাজাহান সিরাজের পক্ষে ছিল না। কারণ তারা বাইরে যেত না, বক্তব্য দিত না, মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করত না। আমরা ছিলাম তার উল্টো। রাতদিন ছোটাছুটি করতাম, স্কুল-কলেজে ঘুরতাম। হাট-ঘাট-মাঠে মিছিল-মিটিং করতাম। নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোই ছিল আমাদের কাজ। তাই মাঠে কখনো ষড়যন্ত্রকারীরা আমাদের সঙ্গে পেরে ওঠেনি। সেটা এমনিতেও না, মুক্তিযুদ্ধেও না, বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদেও না।

    কিন্তু অন্যখানে তারাই জিতেছে, আমরা হেরেছি সর্বত্র। আচমকা সৈয়দ আহমদ ফারুক এসে ছেলে সৈয়দ নোবেদ নাজিম অঙ্কন ও মুমু বেনজির আলমের বিয়েতে দাওয়াত করেছিলেন। জিজ্ঞাসা করেছিলাম, বড় ভাই আসবেন? বলেছিলেন, আসবেন। না এলে কঠিন শাস্তি হবে। আমার বিশ্বাস ছিল না। কিন্তু তিনি এসেছিলেন। খেতে বসেছিলাম পাশাপাশি। আমার পাশে ভাবি, ভাবির পাশে শাহরুখ চৌধুরী। শাহরুখ চৌধুরীর বাবা এম এ চৌধুরী। আগে ওয়ারীতে ছিল তাদের বাসা। ছাত্রলীগের কর্মীদের নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা হলেই তার বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিতেন। বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যার প্রতিবাদ-প্রতিরোধে আমি যখন ঘর থেকে বেরিয়েছিলাম অনেক দুঃখ-কষ্ট করে লতিফ ভাইও গিয়েছিলেন।

    দীর্ঘ ছয় বছর অমানুষিক নির্যাতন-অবহেলা সহ্য করে দেশে ফিরে শাহরুখ চৌধুরীর বাড়িতে ছেলেমেয়ে-স্ত্রী নিয়ে উঠেছিলেন। তারপর শাহরুখ চৌধুরীর বাড়ি থেকে ফজলুল হকের বাড়ি। সেখান থেকে জিগাতলা। জেলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত এভাবেই চলেছিল। সৈয়দ আহমদ ফারুক এক অসাধারণ লোক। তিনি আমায় জীবনে প্রথম ২৬০-৬৫ টাকা দিয়ে কোট বানিয়ে দিয়েছিলেন যা আজও আমায় দোলা দেয়, অনুপ্রাণিত করে। সারা জীবন তিনি একইভাবে চলেছেন। তার মধ্যে খুব একটা জোয়ার-ভাটা দেখিনি। তাই গিয়েছিলাম ফ্যালকন হলে। একসময় সৈয়দ রেজাউর রহমানকে দেখলাম। ষাট-সত্তরের দশকে আমরা খুব কাছাকাছি ছিলাম। স্বাস্থ্যটা নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু ফৌজদারি মোকদ্দমায় সৈয়দ রেজাউর রহমান এখন সবার ওপরে। সৈয়দ রেজাউর রহমানের স্ত্রী মমতা ভাবিকে আমরা খুবই পছন্দ করতাম, এখনো করি। টাঙ্গাইলের শাড়ি আর চমচম ছিল তাদের জন্য নিয়মিত বরাদ্দ। বিয়েতে খুবই ভালো লেগেছে। আল্লাহর কাছে দোয়া করি, আল্লাহ যেন এই দম্পতিকে সুখী করেন।

    জনতা ব্যাংকের সিবিএ সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. রফিকুল ইসলামের মেয়ের বিয়ের এই অসাধারণ অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। চার-পাঁচ হাজার লোকের ব্যবস্থা। বড় যত্ন করেছে। তার চাইতে ছবি তুলেছে বেশি। টাঙ্গাইলের গোপালপুরে রফিকের বাড়ি। মনে হয় ওর চাইতে বেশি কেউ একনাগাড়ে কোনো সিবিএর সভাপতি থাকেনি। সেই স্বাধীনতার পর কবে সভাপতি হয়েছে, অবসরে গিয়ে এখনো সভাপতি। বিয়ের আসরে গিয়েই সাজুকে খুঁজেছিলাম। কিন্তু পাইনি। খাবার খেয়ে সে নাকি আগেই চলে গেছে। গোপালপুরের লোক ছিল বেশুমার। মনে হলো পুরো গোপালপুরই হাজির। জনতা ব্যাংকের কোনো শাখা বাদ নেই। সে এক এলাহি কারবার। খেতে বসে দেখি ভাবিকে নিয়ে বড় ভাই এসেছেন। সৈয়দ আহমদ ফারুকের ছেলের বউভাতের অনুষ্ঠানের মতো এখানেও দুই ভাই পাশাপাশি বসেছিলাম। আর কবে বসা হবে তা আল্লাহই জানেন।

    রফিকের বন্ধু যেমন আছে, শত্রুও কম নেই। রফিক মুক্তিযুদ্ধে একজন যোদ্ধা ছিল। সে একজন মুক্তিযোদ্ধা এটাই যদি শেষ কথা হতো তাহলে হয়তো স্বাধীনতার এত বছর পরও তেমন যোগাযোগ থাকত না। ’৭৪-এর দিকে কী কারণে ময়মনসিংহের কিছু গুণ্ডা তাকে অপহরণ করে হত্যার চেষ্টা করেছিল। আমার পরম স্নেহের আশরাফ গিরানীর কাছে খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে তাকে উদ্ধার করে ঢাকায় এনে চিকিৎসা করিয়েছিলাম। আল্লাহতায়ালা হায়াত রেখেছেন তাই বেঁচে আছে। এখানে আমার কৃতিত্ব কী। আল্লাহ তো মানুষের জন্য কাজ করতেই বলেছেন আমি তাই করেছি। কিন্তু ওর মনে হয় আমিই নাকি ওকে বাঁচিয়েছি। অনেকবার বলেছি অমনভাবে বলো না। রফিকের ছেলে নেই সব মেয়ে। এটাই ছিল তার শেষ মেয়ে রোশনী ইসলামের বিয়ে। ছবি তোলার হুড়োহুড়িতে সেও ছবি তুলেছিল। কিন্তু কোনোমতেই আমার পাশে সোফায় বসেনি। সবকটি ছবি ফ্লোরে বসে তুলেছে। দোয়া করি রোশনী ইসলাম এবং মো. আশিকুর রহমান চৌধুরীর বৈবাহিক জীবন যেন নিরাপদ শান্তিময় হয়। সূত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন

    লেখক : রাজনীতিক।

    www.ksjleague.com

    বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম
    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close