• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

হঠাৎ কেন এমন হলো?

প্রকাশ:  ১৯ অক্টোবর ২০১৮, ১১:২৪ | আপডেট : ১৯ অক্টোবর ২০১৮, ১১:৩৮
ফেরদৌস বাপ্পি

একটু আগে ফিরলাম স্কয়ার হাসপাতাল থেকে। এখনো সেখানে হাজার হাজার ভক্ত, দর্শক, সহকর্মী বাচ্চু ভাইকে এক নজর দেখার অপেক্ষায় সকাল থেকেই সেখানে আছেন। সঙ্গীত অঙ্গনের প্রায় সবাই একে অপরকে জড়িয়ে ধরে ভেঙ্গে পড়ছেন কান্নায়।

কেমন ছিল আইয়ুব বাচ্চুর শারীরিক অবস্থা?

বাচ্চু ভাই বেশ কয়েক বছর ধরেই অসুস্থ ছিলেন। তবে অসুস্থতাকে পাত্তা দিতেন না একদম। কারো সাথে অসুস্থতা নিয়ে কথাও বলতেন না। কেউ অসুস্থতার কথা বললে বরং রাগ করতেন। কোনভাবেই মানতে পারতেন না তিনি তাঁর এই অসুস্থতাকে।

২০০৯-এ প্রথম হৃদযন্ত্রে ব্লক ধরা পড়ে তাঁর। অপারেশনের মাধ্যমে ২০০৯ সালেই তার হার্টে রিং পরানো হয়। তখন থেকেই ডাক্তারের নির্দেশ ছিলো বিশ্রামে থাকার। কিন্তু ডাক্তারের কথা মানেন নি। কয়েক বছর পরেই আবারো অসুস্থ হন তিনি। এবার ফুসুফুস। ২০১২ সালের ২৭ নভেম্বর ফুসফুসে পানি জমার কারণে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) ভর্তি হন। সেখানে চিকিৎসা গ্রহণের পর তিনি সুস্থ হন।

২০১৫ সালে আবারো হৃদযন্ত্রের সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। এরপর থেকে নিয়মিত চেক আপেে ছিলেন স্কয়ারে। নিয়মিত ওষুধও খেতেন। এমনকি দুই সপ্তাহ আগেও হার্টের চেকআপ করিয়েছেন তিনি। তখনও দিব্যি সুস্থ ছিলেন। কিন্তু তারপর কয়েকদিনের টানা কাজ তাকে ভেতরে ভেতরে ক্ষয় করে ফেলে।

স্কয়ার হাসপাতালের চিকিৎসক ও মুখপাত্র মির্জা নাজিম উদ্দিন জানান আইয়ুব বাচ্চু দীর্ঘদিন ধরে কার্ডিও-মাইওপ্যাথি নামক হৃদরোগে ভুগছিলেন। তার হৃদযন্ত্র ৩০ শতাংশ পাম্প করে। যেটা সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে ৭০ শতাংশ দরকার। একজন স্বাভাবিক মানুষের চেয়ে কম রক্তচাপ ছিল তাঁর হার্টের।

তিনি বলেন, ‘ড্রাইভার আইয়ুব বাচ্চুকে হাসপাতালে নিয়ে আসেন। তার তথ্যমতে, আইয়ুব বাচ্চুর মুখ থেকে ফেনা বের হচ্ছিল। এর অর্থ তার হার্টের কার্যকারিতা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গিয়ে এই তরল পদার্থ বের হয়েছে। মানে হার্ট ফেল করেছে।’

বাচ্চু ভাইয়ের শেষ ৩ দিন:

গত পরশু ১৬ অক্টোবর রংপুরে উন্নয়ন কনসার্টে অংশ নেন তিনি। কনসার্টে সবাইকে নিয়ে পরিবেশন করেন "উড়াল দেবো আকাশে"। সদ্য প্রয়াত পিয়ানিস্ট তুষারকে নিবেদন করেন গানটি। এই কনসার্টেই বাজানোর কথা ছিল তুষারের। তুষারের কিবোর্ড রংপুরে স্টেজে পৌছে গিয়েছিল কিন্তু তুষারই পৌঁছাতে পারেনি। তাঁর আগেই ঢাকায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তুষার মৃত্যুবরণ করেন।

বাচ্চু ভাই তুষারের মৃত্যু সংবাদে শোকাহত ছিলেন। কনসার্ট শেষে ছিলেন বেশ টায়ার্ড। যদিও কাউকে বুঝতে দেননি। গতকাল ১৭ অক্টোবর দুপুরের ফ্লাইটে রংপুর রওনা দেন ঢাকায় উদ্দেশ্যে। বিমানে উঠেই ঘুমিয়ে পড়েন তিনি। বিমানে কিছু খান নি। হয়ত শরীর খারাপ লাগছিল তখন। কিন্তু নিজের শরীরের ব্যাপারে কাউকে কিছু বুঝতে দিতে চাইতেন না বাচ্চু ভাই।তখনও দেন নি। রাতে বাসায় ফিরে রেস্ট নেন। সকাল ৮টায় তাঁর ধানমন্ডির বাসায় হঠাত করেই ম্যাসিভ হার্ট এটাকের শিকার হন।বাসার লোকজন তাকে দ্রুত নিয়ে আসেন স্কয়ার হাসপাতালে। কিন্তু তাঁর আগেই সব শেষ। সকাল ৯.৫৫ এ ডাক্তাররা তাকে অফিসিয়ালি মৃত ঘোষণা করেন এবং জানান তাঁর হৃদযন্ত্র মাত্র ৩০% কার্যক্ষম ছিল।

পরিবারের কে কোথায়?

আইয়ুব বাচ্চু ভাইয়ের সহধর্মিণী ফেরদৌস আইয়ুব চন্দনা। চন্দনা ভাবী সকাল থেকেই স্কয়ারে। আপনজনেরা তাকে শান্তনা দিচ্ছেন। কিন্তু বাঁধ মানছিল না চন্দনা ভাবীর চোখ। কাঁদতে কাঁদতে চোখ মুখ ফুলে গেছে তাঁর। এমন চরম দুঃসময়ে তাঁদের দুই সন্তান বড় মেয়ে ফাইরুজ সাফরা আইয়ুব এবং ছোট ছেলে আহনাফ তাজোয়ার আইয়ুব দেশের বাইরে। মেয়ে ফাইরুজ থাকে অস্ট্রেলিয়ায় আর ছেলে আহনাফ কানাডার ভ্যাঙ্কুভারে। দুজনকেই জানানো হয়েছে বাবার মৃত্যু সংবাদ। দুজনেই ফোনে মায়ের সাথে, আত্মীয়স্বজনের সাথে কথা বলছেন, কাঁদছেন।

ফাইরুজ ও আহনাফের দেশে ফেরার বিমানের টিকেট কনফার্ম করা হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে আগামীকাল ১৯ অক্টোবর রাত ১১.৩০ এ ঢাকায় এসে পৌঁছাবে ওরা। সন্তানেরা যেন বাবাকে শেষবারের মত দেখতে পারে সে জন্য মরদেহ স্কয়ার হাসপাতালের ফ্রিজিং মরচুয়ারীতে রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

শেষ গোসল, কাফন ও ফ্রিজিং মরচুয়ারী:

নিয়ম না থাকা স্বত্বেও স্কয়ার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বেজমেন্টে বাচ্চু ভাইয়ের গোসলের ব্যবস্থা করে দেয়। হাসপাতালের উল্টোদিকে পান্থপথের মসজিদ থেকে আসেন হুজুরেরা, আসে দুটি খাটিয়া। আর এই পুরো ব্যবস্থা করেন সঙ্গীত জগতের মানুষেরা। বাচ্চু ভাইয়ের ছোট ভাই, এলআরবি -এর সদস্যরা, পরিচালক ইজাজ খান স্বপন, গীতিকার আসিফ ইকবাল, গায়ক তপন চৌধুরী, গায়ক কুমার বিশ্বজিৎ, হানিফ সংকেত, তাপস, এরশাদুল হক টিংকু, ফাহমিদা নবী, সামিনা চৌধুরী, বাম্বার সদস্যরা সহ আরো অনেকে সকাল থেকেই সব ম্যানেজ করছেন।

কাফনের সকল সরঞ্জাম নিয়ে আসেন সাংবাদিইক মইনুল হক রোজ। দুপুর ২.৪৫ মিনিটে শুরু হয় স্কয়ারের বেজমেন্টে বাচ্চু ভাইয়ের গোসল। গোসল করান মসজিদের ইমাম, সাথে যোগ দেন মডেল ফয়সাল সহ আরো কয়েকজন। দুপুর ৩.১৫ এর দিকে কাফনের কাপড়ে ঢেকে সুযোগ দেয়া হয় অপেক্ষমান সঙ্গীত জগতের মানুষদের একনজর বাচ্চুভাইকে দেখার। এরপর তাঁর মরদেহ স্কয়ার হাসপাতালের ফ্রিজিং মরচুয়ারীতে রাখা হয়েছে। আগামীকাল ১৯ অক্টোবর সকাল ৯.৩০ পর্যন্ত তাকে সেখানেই রাখা হবে।

সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদন, জানাজা ও দাফনঃ

১৯ অক্টোবর শুক্রবার সকাল ১০.৩০ মিনিটে তাকে নিয়ে যাওয়া হবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট এটি দেখভাল করবে। এর পর জুম্মার নামাজের পর জানাজা অনুষ্ঠিত হবে জাতীয় ঈদগাহে (হাইকোর্ট সংলগ্ন)। জানাজা শেষে ফিরিয়ে আনা হবে স্কয়ার হাসপাতালের ফ্রিজিং মরচুয়ারীতে। রাতে তাঁর দু সন্তান ফাইরুজ ও আহনাফ দেশে ফিরে এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি আসবেন স্কয়ার হাসপাতালে।

২০ অক্টোবর সকালে তাঁর মরদেহ নেয়া হবে চট্টগ্রামে। সেখানে জানাজার পর তাকে দাফন করা হবে তাঁর ইচ্ছে অনুযায়ী তাঁর মায়ের কবরের পাশে।

সবারই প্রশ্ন কেন হঠাৎ এমন হলো?

যেহেতু কেউই আগে থেকে জানতেন না যে বাচ্চুভাই বেশ অসুস্থ। তাঁর এই অকাল প্রয়াণ তাই সবার কাছেই একটা বিশাল ধাক্কার মত লেগেছে। সব সময়ই তাকে ফিট, তারুণ্যে ভরপুর, ঘন্টার পর ঘন্টা কনসার্টে গাইতে বাজাতে দেখা গেছে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তিনি যে হৃদযন্ত্রে কার্ডিও-মাইওপ্যাথি নামক রোগে দীর্ঘদিন ধরে ভুগছেন তা কাউকেই জানতে বুঝতে দেননি। এদিকে সময়ের সাথে সাথে তাঁর এই রোগ আরও জেঁকে বসেছিল।

ডাক্তার কঠোর ভাবে নিষেধ করেছিলেন কনসার্ট করতে। গান গাইতে। রাত জাগতে। পরিশ্রম করতে। কিন্তু বাচ্চু ভাই কোন নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা করেন নি। গান পাগল, কনসার্ট পাগল, শ্রোতাদের ভালবাসার পাগল মানুষটার পক্ষে সম্ভব ছিল না এই নিষেধাজ্ঞা মেনে চলা। গান যার প্রাণ, শ্রোতারা যার জান তিনি কেমন করে দূরে থাকবেন গানবাজনা থেকে। তাই নিজের অসুস্থতা চেপে রেখে, হৃদযন্ত্রে অমানুষিক চাপ দিয়ে, গান করে গেছেন দিনের পর দিন। ভালবাসার শ্রোতাদের জন্য শেষ পর্যন্ত নিজের জীবনটাকেই উৎসর্গ করে দিলেন।

বেচারা অসুস্থ হৃদযন্ত্র। পাত্তা না পেতে না পেতে। অবশেষে হারিয়ে ফেললো তাঁর কার্যক্ষমতা। আর আমরা হারিয়ে ফেললাম আমাদের আইয়ুব বাচ্চু ভাইকে।

বাচ্চু ভাইয়ের জীবন যেন তাঁর সেই বিখ্যাত গানের মতই হলো-

"হাসতে দেখ গাইতে দেখ

অনেক কথায় মুখর আমায় দেখ

দেখো না কেউ

হাসির শেষে নীরবতা

বোঝে না কেউ তো চিনলো না

বোঝে না আমার কি ব্যাথা"

আসলেই তাই

সারাজীবন তাকে দেখলাম হাসতে গাইতে

উৎফুল্ল, তারুণ্যে মুখর থাকতে

কিন্তু কেউ জানিনি, দেখিনি, বুঝিনি

তাঁর হৃদয়ে দিনের পর দিন

জমাট হয়ে ওঠা ব্যাথা

হৃদযন্ত্রের ক্ষত

দেখা হবে ওপারে বাচ্চু ভাই............

(লেখকের ফেসবুক স্ট্যাটাস)

আইয়ুব বাচ্চু
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close