• শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

"কৃষ্ণ : অ্যা ট্রু কিং মেকার অব ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি"

প্রকাশ:  ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১১:৫১
পূর্বপশ্চিম ডেস্ক

কৃষ্ণ সম্পর্কে আমার জানাশোনা মহাভারতেই সীমাবদ্ধ। তবে কৃষ্ণ সম্পর্কে আরো অনেক লোকজ সাহিত্য আছে। কিন্তু সেসব পড়ার আগ্রহ পাইনি। তাছাড়া আমি দর্শনগত ভাবেও বস্তুবাদী দর্শনে আস্থা রাখি। তাই আমার কাছে ঐতিহাসিক ঘটনা হিসেবে মহাভারত যতটা গ্রহণযোগ্য, অন্য সকল সাহিত্য তেমনটা নয়। তাই যাঁরা মহাভারত বিবেচনায় না নিয়ে কৃষ্ণ স্তুতি করেন, কিংবা কৃষ্ণকে দেবতাজ্ঞানে স্মরণ করেন। তাঁদের সাথে আমার স্বাভাবিক ভাবেই চিন্তার পার্থক্য থাকবে। সেখানে দুঃখজনকভাবে কোনরকম চিন্তার ঐক্যের সুযোগ নেই।

মহাভারতের কৃষ্ণতেই ফিরে আসি। যেখানে কৃষ্ণ একজন রাজনীতিবিদ, কূটনীতিক এবং একজন সফল স্টেট ম্যানের ভূমিকায়। কর্তব্য পরায়ণ, বিবেকবান, মেধাবী এবং সাহসী মানুষ। ক্ষত্রিয় (রাজ বংশে) হিসেবে জন্মগ্রহণ করলেও বেড়ে উঠেছেন বৈশ্য (ব্যবসায়ী) পরিবারে। কৃষ্ণ নিজের জীবন দান পেয়েছিলেন নিজের পালিত মা যশোদা'র মেয়ের বিনিময়ে। অনার্য সমাজে কণ্যা হত্যা মহাপাপ। তাই কংস সেই কণ্যাকে প্রচলিত রীতি অনুযায়ী মহামায়া বা দুর্গামন্দিরে রেখে আসেন। কিন্তু খবর রটে যায় বা রটানো হয় যে, স্বয়ং মহামায়া এসে তাকে নিয়ে গেছে।

কারও মতে এই বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়া মেয়েটাই পরবর্তীকালের দ্রৌপদী। কারণ দ্রৌপদীকে রাজা ধ্রুপদ দুর্গা মন্দির থেকেই কণ্যারূপে গ্রহণ করেছিলেন। দ্রৌপদীর প্রতি পরবর্তী সময়ে কৃষ্ণের যে কর্তব্য পরায়ণতা এবং গভীর সংবেদনশীলতা আমরা দেখেছি। সেটা ভাই-বোনের মধ্যেই সাধারণত দেখতে পাওয়া যায়।

মাত্র ১৬ বছর বয়সে মাতামহ উগ্রসেন এবং কাকা সমুদ্রবিজয়ের সহায়তায় কৃষ্ণ এবং বলরাম ক্ষমতায় বসেন, রাজা উপাধি লাভ করেন। যাদব বা অনার্যরা এক রাজার অধীনে শাসিত হতো না। বিভিন্ন গোত্র প্রধানদের সমন্বয়ে গঠিত পার্লামেন্টের মাধ্যমেই শাসন কার্য পরিচালিত হতো। গোত্র প্রধানদের রাজা উপাধি প্রদান করা হতো। ক্ষমতায় বসেই নানা শক্তিশালী প্রতিপক্ষের সম্মুখীন হতে হয়। অনার্য যাদবরা কংসের নেতৃত্বে আর্যদের বিরুদ্ধে সংগঠিত হচ্ছিল। সেখানে কৃষ্ণের পিতা বাসুদেব সহ আরেকপক্ষ ছিলেন আর্যদের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপনের পক্ষে। উভয়পক্ষের শক্তিশালী গোত্রের রাজনৈতিক চালাচালিতে একপর্যায়ে পর্যুদস্ত হয়ে বলরাম ও কৃষ্ণ সমস্ত প্রজা সমেত নিজের মাতামহ উগ্রসেনের পরামর্শে দ্বারকা নগরীতে পাড়ি জমান। দ্বারকাকে একটি শক্তিশালী নগর রাষ্ট্রে পরিণত করেন। দ্বারকার সমুদ্র বন্দরকে কেন্দ্র করে আরব সাগর উপকূলবর্তী সমস্ত রাজ্যের সাথে বাণিজ্য গড়ে তুলেন। কৃষ্ণের জীবনে রাজা উগ্রসেনের ভূমিকা অসামান্য। রাজা উগ্রসেন ছিলেন "আভিরা" গোত্রের এবং কৃষ্ণের পিতামহ রাজা সৌরসেন ছিলেন "ভিষ্ণি" গোত্রের। উভয় গোত্রের পূর্ণাঙ্গ এবং শক্তিশালী সামরিক বাহিনী এবং প্রচুর সম্পদ ছিলো। উগ্রসেন এবং সৌরসেন উভয়ই পরম বন্ধু ছিলেন এবং উভয়ই ছিলেন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ, কূটনীতিক, সমরবিদ এককথায় স্টেটম্যান। পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড অনেক মজবুত থাকায় একটা মস্তবড় সুবিধা কৃষ্ণ লাভ করেছেন। সেটাকে নিজ মেধা ও শ্রমে কাজেও লাগিয়েছেন।

এরমধ্যেই কৃষ্ণ সারা ভারতবর্ষ চষে বেড়িয়েছেন। যাদবকূল সহ যাদবকূলের বাইরে থাকা অন্যান্য অনার্যদের ঐক্যবদ্ধ করেছেন। পাশাপাশি গড়ে তুলেছেন বিশাল এবং শক্তিশালী গুপ্তচর কাঠামো।

অর্থাৎ ৩০ বছর বয়সে কৃষ্ণ যখন হস্তিনাপুরে প্রথমবার পা রাখতে যাবেন তখন ইতিমধ্যেই কৃষ্ণ সমগ্র ভূ-ভারতের একজন শক্তিশালী চরিত্র হয়ে গেছেন। যার কারণে কৃষ্ণ অনার্য হলেও কৌরব রাজসভায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মর্যাদা লাভ করেন।

এরও প্রায় ২০ বছর পর কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সময় কৃষ্ণ তখন আরও বিকশিত এবং দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী নগর রাষ্ট্রের পাশাপাশি সামরিক ভাবে শক্তিশালী সেনাবাহিনীরও অধিপতি। ব্যাবিলন, মিশর সহ নানা রাজ্যের সাথে তাদের গভীর সম্পর্ক। তাদের অনেকেই লৌহ যুগে পা রেখেছে। ভারত তখনো ব্রোঞ্জ যুগের একদম শেষ পর্যায়ে। যাদবদের মধ্যবর্তী সকল দ্বন্দ্ব মিটিয়ে তাদের ঐক্যবদ্ধ করেছেন। কিন্তু অস্ত্র চালনা এবং যুদ্ধ বিদ্যায় তিনি তেমন পারদর্শী নন। বড় ভাই বলরাম, বিশ্বস্ত সেনাপতি সাত্যকী এবং কৃতবর্মা সহ হাজার হাজার নারায়নী সেনা দিয়ে সেই শূণ্যস্থান পূরণ করেছেন।

পুরো মহাভারত জুড়েই কৃষ্ণ একটু একটু করে কখনো ঐক্য, কখনো বৈরী দ্বন্দ্ব, কখনো বা অবৈরী দ্বন্দ্বের মাধ্যমে অগ্রসর হয়েছেন। কিন্তু কৃষ্ণের প্রতিটা পদক্ষেপ এতটাই মজবুত ছিলো যে যতটুকুই তিনি অগ্রসর হয়েছেন সেখান থেকে কোনোভাবেই পিছিয়ে আসতে হয়নি, কৌশলগত কারণেও না।

সমগ্র যুদ্ধেই কৃষ্ণ আগাগোড়া দূরদর্শিতার পরিচয় রেখে গেছেন। যুদ্ধে পান্ডবদের জয়ের সম্ভাবনা না থাকায় রাষ্ট্র হিসেবে দ্বারকা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি। কিন্তু কৃষ্ণ নিজ অনুগত অসংখ্য যাদব শ্রেষ্ঠ সেনাপতিকে উভয়পক্ষে অংশগ্রহণ করিয়েছেন। যার কারণে যুদ্ধে যে পক্ষই জিতুক না কেন দ্বারকা এবং যাদবদের কোন দুর্যোগের সম্মুখীন হতে হতো না। নিজ জাতি এবং রাষ্ট্রের সবরকমের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেই কৃষ্ণ কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধে পা রেখেছেন। সাথে সেসময়ের সেরা গুপ্তচর বাহিনী তো ছিলোই।

যুদ্ধে কৌরব পক্ষের শক্তি পান্ডবদের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি ছিলো। কৃষ্ণ বেশ বুদ্ধিমত্তার জোড়ে যুদ্ধের বেশ আগে থেকেই এক এক করে কৌরবদের শক্তি ভেঙে দিয়েছিলেন। বহু আগে থেকেই কৃষ্ণ জানতেন যে কর্ণ পান্ডবদের বড় ভাই। সত্যটা জানলেও আগে বলেননি। ঠিক যুদ্ধের আগমুহূর্তে সেটা বলে দিয়ে কর্ণকে মানসিক ভাবে অস্থির করে দেন। অস্থিরতা নিয়ে কর্ণ সেনাপতি ভীষ্মের সাথে বাদানুবাদে জড়িয়ে পরেন, অপমানিত হন। এরপর কর্ণ নিজেকে যুদ্ধ হতে বিরত রাখেন। কর্ণের সাথে পুন্ড্ররাজ (বৃহত্তর রংপুর) মহাবীর ভাগদত্ত সহ অনেকেই বিরত থাকেন। বঙ্গরাজ ১০ হাজার হাতি পাঠিয়েছিলেন। সেই হাতিগুলো একসাথে আর যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ করতে পারেনি। এখানেই কৌরবদের শক্তি ভাগ হয়ে যায়। যুদ্ধে পান্ডবরা জিতে যায়।

মহাভারত জুড়েই কৃষ্ণের এরকম বহু ঘটনা রয়েছে। দফায় দফায় বিভিন্ন জনকে রাজা বানিয়েছেন। প্রয়োজনে অনেককেই সিংহাসন থেকে উৎখাত করেছেন।

আবার যুদ্ধ জয়ের পর দীর্ঘকালের আর্য-অনার্যের দ্বন্দ্ব মিটিয়ে দিয়েছেন। বিভিন্ন সমাজ সংস্কার করেছেন। আর্যদের বেদ, উপনিষদ এবং অনার্যদের লোকজ ধর্মের সমন্বয়ে পূরাণ রচনা করিয়েছেন। আবার সময় পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে সেগুলো যাতে সংস্কার করা যায় সেজন্য মহাভারতে আবার নিজের দর্শন প্রকাশ করেছেন শ্রীমদভগবদগীতা'র মাধ্যমে। এরকম "চেক এন্ড ব্যালেন্স" নীতির প্রয়োগ অন্য কোনো ধর্মের বেলায় ঘটেছে কিনা জানিনা। ভারতবর্ষের রাষ্ট্র, দর্শন, সংস্কৃতি, ধর্ম এমনকি খাদ্যাভ্যাসেও কৃষ্ণের গভীর প্রভাব আছে। সব মিলিয়ে কৃষ্ণ হয়ে উঠেছেন এই ভূমির একদম গভীরে প্রোথিত এক অপরিহার্য রাজনৈতিক চরিত্র।

এই চরিত্রকে লোকজ কিংবা কল্পিত বলতে পারেন।

কিন্তু তিন হাজারেরও বেশি সময় ধরে এই চরিত্র এই ভূখন্ডে পূজিত হচ্ছে। চর্চিত হচ্ছে "এজ অ্যা গ্রেট কিং মেকার, পলিটিক্যাল এন্ড ফিলোসোফিক্যাল মাস্টারমাইন্ড" হিসেবে।

বৈচিত্র্যময় ভারতবর্ষকে এক জায়গায় আনতে পেরেছে এরকম চরিত্র খুবই কম। কৃষ্ণ সেখানে অনবদ্য।

এই ভূখন্ডে রাজনীতি, দর্শন, সমাজ ব্যাবস্থা নিয়ে চর্চা করতে হলে এরকম এক চরিত্রকে আমলে নিতেই হবে।

কৃষ্ণ,জন্মাষ্টমী
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close