• বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশের ‘নীতি’ আবার প্রশ্নের মুখে

প্রকাশ:  ২৭ জানুয়ারি ২০২৪, ২২:৪৭
পূর্বপশ্চিম ডেস্ক

আচমকাই আরও একবার নিজেকে আলোচনার কেন্দ্রে টেনে আনলেন ভারতের বিহার রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার। প্রবল জল্পনা, দু-এক দিনের মধ্যেই তিনি আবার ধরতে চলেছেন বিজেপির হাত। আরও একবার সঙ্গী পাল্টে কেন্দ্র ও রাজ্যে নতুন রাজনৈতিক সমীকরণ গড়তে চলেছেন। জল্পনা সত্যি হলে রবি কি সোমবারের মধ্যেই ঘটতে চলেছে পালাবদল।

এই পরিস্থিতিতে বিহারের বিজেপি, রাষ্ট্রীয় জনতা দল (আরজেডি) ও জেডি(ইউ)-এর মধ্যে তৎপরতা বেড়েছে। তিন দলই নিজেদের বিধায়কদের নিয়ে আজ শনিবার বৈঠকে বসেছে। ‘অপারেশন পদ্ম’র মুখ্য কারিগর কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের কাল রোববার পশ্চিমবঙ্গ সফরে আসার কথা ছিল। সেটা বাতিল করা হয়েছে। মনে করা হচ্ছে, রবি কি সোমবারের মধ্যেই মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার ‘মহাজোট’ ছেড়ে নতুন সরকার গড়ার লক্ষ্যে রাজ্যপালের কাছে ইস্তফাপত্র জমা দেবেন। বিজেপি তাঁকে সমর্থনের চিঠি তৈরি রাখছে।

বিজেপি ও জেডি (ইউ) দুই দলই মনে করছে, নীতীশের এই পদক্ষেপের ফলে বিহারে লোকসভা নির্বাচনে তাদের ফল আশাতীতভাবে ভালো হবে। ২০১৯ সালে এই দুদল একসঙ্গে ভোটে লড়েছিল। তাতে বিহারের মোট ৪০ আসনের মধ্যে ৩৯টি পেয়েছিল এনডিএ। বিহার বিধানসভার ভোট অবশ্য আগামী বছর।

কেন্দ্রে তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতা ধরে রাখতে গেলে বিহারের ৪০টি আসনের সিংহভাগ বিজেপির প্রয়োজন। নীতীশের সাহচর্য ছাড়া তা সম্ভব নয়। সেই কারণে কয়েক মাস ধরে বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব নিতীশের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছেন।

নীতীশ আরও একবার সঙ্গী বদল করতে পারেন—সেই সম্ভাবনার বিষয়টি কিছুদিন ধরেই আলোচনায় ছিল। এর একটা কারণ নীতীশ নিজে। বারবার ভোটের আগে নিকট ভবিষ্যতের কথা ভেবে তিনি সঙ্গী বদল করে এসেছেন। সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় দল ও নিজের স্বার্থকেই (মুখ্যমন্ত্রিত্ব ধরে রাখা) তিনি প্রাধান্য দিয়েছেন। এবারও সেটাই প্রধান বিবেচ্য।

তবে এবার নীতীশকে পাশে পেতে বিজেপিও মরিয়া। কেন্দ্রে তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতা ধরে রাখতে গেলে বিহারের ৪০টি আসনের সিংহভাগ বিজেপির প্রয়োজন। নীতীশের সাহচর্য ছাড়া তা সম্ভব নয়। সেই কারণে কয়েক মাস ধরে বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব নিতীশের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছেন। এখন মনে করা হচ্ছে, সেই মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত।

অথচ এই নীতীশই লোকসভা ভোটে বিজেপিকে হারাতে জোট বাঁধার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কংগ্রেসকে সামনে রেখে বিজেপিবিরোধী জোট গড়ে তুলতে রাজ্যে রাজ্যে গিয়ে তিনিই প্রথম বৈঠক শুরু করেন। কথা বলেন ওডিশার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়ক, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, উত্তর প্রদেশের সমাজবাদী পার্টির নেতা অখিলেশ যাদবদের সঙ্গে। ক্রমেই দানা বাঁধতে থাকে ‘ইন্ডিয়া’ জোট। গত বছর পাঁচ রাজ্য বিধানসভার নির্বাচনে বিজেপি হিন্দি বলয়ের রাজস্থান, ছত্তিশগড় ও মধ্যপ্রদেশ দখল করে নেওয়ার পর ‘ইন্ডিয়া’ জোট নিয়ে নীতীশের আগ্রহ কমে যায়। তিনি উপলব্ধি করেন, অযোধ্যায় রামমন্দির উদ্বোধনের পর লোকসভার ভোট জেতা বিজেপির পক্ষে সময়ের প্রতীক্ষা ছাড়া আর কিছু নয়। তখন থেকেই ‘ইন্ডিয়া’র সঙ্গে তাঁর দূরত্ব সৃষ্টি। বিজেপিও তার সদ্ব্যবহার করতে চাইছে।

বিহার বিধানসভার মোট আসন ২৪৩। সরকার গড়তে দরকার ১২২ জনের সমর্থন। জেডির (ইউ)-এর আছে ৪৫, বিজেপির ৭৮। আর জোটে আছে জিতেন মাঝির দল ‘হাম’-এর ৫ ও একজন স্বতন্ত্র। মোট ১২৯ জনের সমর্থন। অন্যদিকে আরজেডি (৭৯) ও কংগ্রেস ১৯ ও বামপন্থীদের ১৬ মিলে রয়েছে ১১৪ জন বিধায়ক।

আজ শনিবার পর্যন্ত নীতীশ নিজে এই উদ্যোগ নিয়ে কিছু বলেননি। কিন্তু তাঁর ঘনিষ্ঠ নেতারা সরাসরি দায়ী করেছেন কংগ্রেসকে। বলেছেন, ‘ইন্ডিয়া’ জোটে যোগ্য সম্মান না পাওয়ায় তিনি বিকল্প রাস্তায় হাঁটার কথা ভাবতে বাধ্য হচ্ছেন। কংগ্রেসকে দোষারোপ করলেও নীতীশ নিজেই নিজের রাজনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতা তলানিতে নিয়ে গেছেন। কংগ্রেসের নেতারা নিভৃত আলোচনায় বলছেন, বিজেপিবিরোধী জোট গড়ার উদ্যোগ যিনি নিয়েছিলেন, তিনি নিজেই যদি ছয় মাসের মধ্যে বিজেপির সঙ্গে হাত মেলানোর সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে বুঝতে হবে তাঁর উদ্দেশ্যই ছিল অসৎ।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এআইসিসির এক নেতা আজ শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, নীতীশ কুমার নিজে এখনো মুখ খোলেননি। কিন্তু অন্যান্যবারের মতো এবারও তাঁর সঙ্গী বদলের জল্পনা সত্য হলে বুঝতে হবে নামে ‘নীতি’ থাকলেও তাঁর চরিত্রে নীতি ও আদর্শের বিন্দুমাত্র বালাই নেই।

নীতীশের বিজেপিকে ধরা-ছাড়ার কাহিনি পুরোনো। পূর্বতন জনতা দল ভেঙে জর্জ ফার্নান্দেজকে নিয়ে তিনি ১৯৯৪ সালে গড়ে তুলেছিলেন ‘সমতা পার্টি’। ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ীর সঙ্গে তিনি হাত মেলান। কেন্দ্রে মন্ত্রী হন। ২০০০ সালে প্রথমবার মুখ্যমন্ত্রী হন লালু প্রসাদের দল আরজেডির সঙ্গে হাত মিলিয়ে। কিন্তু সাত দিনের মাথায় তাঁকে সরে যেতে হয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণে ব্যর্থ হওয়ায়। কংগ্রেসের সমর্থনে মুখ্যমন্ত্রী হন লালুর স্ত্রী রাবড়ি দেবী।

২০০৩ সালে সমতা পার্টি ভেঙে শারদ যাদবকে সঙ্গে নিয়ে নীতীশ গড়ে তোলেন ‘জনতা দল (ইউনাইটেড)। ২০০৫ সালে বিজেপির সমর্থন নিয়ে দ্বিতীয়বার মুখ্যমন্ত্রী হন নিতীশ। ২০১০ সালে তৃতীয়বার। বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটের শরিক হওয়া সত্ত্বেও ২০১২ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তাঁর দল ভোট দেয় ইউপিএ প্রার্থী প্রণব মুখার্জিকে। ২০১৩ সালে নরেন্দ্র মোদিকে বিজেপি প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী ঘোষণা করায় নীতীশ বিজেপির সঙ্গে দীর্ঘ ১৭ বছরের গাঁটছড়া ভেঙে দেন।

সেই সিদ্ধান্ত বুমেরাং হয়ে দাঁড়ায় ২০১৪ সালে লোকসভা ভোটে। রাজ্যে জেডি (ইউ)-এর আসন ২০ থেকে কমে হয় ২, বিজেপির আসন ১২ থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ২২-এ। লোকসভা ভোটে দলের বিপর্যয়ের দায় ঘাড়ে নিয়ে তিনি মুখ্যমন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেন সতীর্থ জিতেন রাম মাঝিকে। পরের বছরেই ২০১৫ সালে জিতেন রাম মাঝিকে সরিয়ে চতুর্থবারের মতো বিহারের মুখ্যমন্ত্রিত্ব লাভ করেন নীতীশ। সেই বছরেই আরজেডি ও কংগ্রেসের সঙ্গে গড়ে তোলেন মহাজোট। নভেম্বরে ভোটের পর পঞ্চমবারের জন্য মুখ্যমন্ত্রী হন।

কিন্তু জোট সঙ্গী বদল যাঁর রক্তে, তিনি কী করে থিতু হবেন? ২০১৭ সালে আরজেডি নেতা তেজস্বী যাদবের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে বিজেপির সঙ্গে হাত মেলান। বিজেপির সাহায্যে ষষ্ঠবারের মতো মুখ্যমন্ত্রী হন ২০১৭ সালে। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে রাজ্যে ৩৯টি আসন জেতেন নীতীশ ও বিজেপি। সেই জোয়ারে ভর দিয়ে ২০২০ সালের বিধানসভা ভোট জয়।

সপ্তমবারের মতো মুখ্যমন্ত্রী হয়েও ২ বছর পর ২০২২ সালে বিজেপিকে ছেড়ে আরও একবার হাত মেলান আরজেডি ও কংগ্রেসের সঙ্গে। গড়ে তোলেন মহাজোট। সেই জোট ভেঙে সম্ভবত আবার বিজেপি শিবিরে তিনি ঢুকতে চলেছেন বলে জল্পনা বেড়ে চলেছে।

বিহার বিধানসভার মোট আসন ২৪৩। সরকার গড়তে দরকার ১২২ জনের সমর্থন। জেডি (ইউ)-এর আছে ৪৫, বিজেপির ৭৮। আর জোটে আছে জিতেন মাঝির দল ‘হাম’-এর ৫ ও একজন স্বতন্ত্র। মোট ১২৯ জনের সমর্থন। অন্যদিকে আরজেডি (৭৯) ও কংগ্রেস ১৯ ও বামপন্থীদের ১৬ মিলে রয়েছে ১১৪ জন বিধায়ক। অর্থাৎ কয়েকজনের দলত্যাগ দুই পক্ষকেই সুবিধা-অসুবিধার মধ্যে ফেলে দিতে পারে।

এই অবস্থায় সবার নজর বিধানসভার স্পিকার অবধ বিহারি চৌধুরীর দিকে। তিনি লালু প্রসাদের দল আরজেডির সদস্য। বিধানসভায় স্পিকারই সর্বেসর্বা। তাঁর রায়ই চূড়ান্ত। নীতীশকে ঘিরে রাজনৈতিক পালাবদলের জল্পনার মধ্যে স্পিকারই তাই হয়ে উঠেছেন মধ্যমণি। নীতীশের স্বপ্ন সফল হবে কি না, তা নির্ভর করছে অবধ বিহারি চৌধুরীর ওপর।

মুখ্যমন্ত্রী,বিজেপি,কংগ্রেস
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close