• শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

খুচরা দোকান থেকে আসতে পারে দুই লাখ কোটি টাকার ভ্যাট

প্রকাশ:  ২২ এপ্রিল ২০২৪, ০০:৪৭
পূর্বপশ্চিম ডেস্ক

ঢাকার মানিকনগরের লেডি শপে দিনে লাখ টাকার বেশি লেনদেন হয়। তবে দোকানি ভ্যাট দেন না। একই অবস্থা গোপীবাগ, টিকাটুলীসহ ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভার বিভিন্ন এলাকায়ও। দিনে লাখ টাকার বেশি লেনদেন হলেও ভ্যাট ফাঁকি দেয় বহু দোকানি।

ভ্যাট আইন অনুযায়ী, সিটি কর্পোরেশন এবং পৌর এলাকায় ব্যবসা শুরু করার অন্তত ১৫ দিন আগে এনবিআর থেকে বিআইএন নিয়ে তবেই ব্যবসা পরিচালনায় যেতে হবে। তবে অনেক দোকানদার আইনগত প্রয়োজনীয়তা উপেক্ষা করে ভ্যাট নিবন্ধন ছাড়াই ব্যবসা করে যাচ্ছেন প্রতিদিন।

পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায় আদায়যোগ্য ভ্যাটের ৯০% ফাঁকি হচ্ছে। বর্তমানে খুচরা ব্যবসায় ভ্যাটের হার ৫%। খুচরা ব্যবসা থেকে বছরে মাত্র পাঁচ হাজার কোটি টাকার ভ্যাট আদায় হয়। যেখানে প্রতিবছর অন্তত পৌনে দুই লাখ কোটি টাকা আদায় করা সম্ভব।

মঙ্গলবার (২ এপ্রিল) বিশ্বব্যাংক বলেছে, এক অর্থবছরেই প্রায় দুই লাখ কোটি টাকার ভ্যাট থেকে বঞ্চিত হয়েছে বাংলাদেশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সরকার মাত্র ৮৫ হাজার কোটি টাকা ভ্যাট সংগ্রহ করতে পেরেছিল। অর্থাৎ সে বছর আদায়যোগ্য ভ্যাটের চেয়ে দুই–তৃতীয়াংশ কম ভ্যাট আদায় হয়েছে।

ঢাকা মহানগরসহ সারা দেশে দোকান মালিক আছেন ৭৫ লাখের বেশি। তারা যদি মাসে গড়ে ২০ হাজার টাকা ভ্যাট দেন, তাহলে বছরে এক লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব পায় সরকার। এর সঙ্গে অন্যান্য খাতের বড় বড় দোকানির ভ্যাট যোগ হলে পরিমাণটা দ্বিগুণ হতে পারে।

বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, বিভাগীয় শহরগুলোর মধ্যে ঢাকায় বড় বড় দোকান ব্যবসায়ী আছেন ছয় থেকে সাত লাখ। অধিকাংশেরই দিনে লেনদেন লাখ টাকার বেশি। এই ধরনের ব্যবসায়ী খুলনায় আছেন দুই লাখের বেশি, রাজশাহীতে এক লাখ, চট্টগ্রামে চার লাখের বেশি। এ ছাড়া জেলা শহরগুলোয় ৪০ থেকে ৫০ হাজার দোকান ব্যবসায়ী আছেন। কোনো কোনো উপজেলায় আছেন এক হাজার থেকে ১০ হাজার।

জানা গেছে, দিনে ১০ থেকে ২০ লাখ টাকা লেনদেন হয়, এমন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে কয়েক হাজার। কিন্তু তাদের অধিকাংশই ভ্যাট দেয় না। অথচ এনবিআরের মাঠপর্যায়ের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তারা বড় বড় শিল্প-কলকারখানা থেকে ভ্যাট আদায়ে ব্যস্ত থাকেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একদিকে লাখ লাখ দোকান ব্যবসায়ীকে ভ্যাট ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে আদায় হয়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার ৪২৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১০৯টি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে পাওয়া গেছে ৫৮ হাজার ৫৬৬ টাকা, যা আদায় করা ভ্যাটের ৪৭%। ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট আদায় করা ভ্যাটের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে বড় মাপের ১১০টি প্রতিষ্ঠান থেকেই প্রায় ৫৩% আদায় করেছে এনবিআর।

শুধু তা-ই নয়, নতুন করে এবার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও ভ্যাট আদায় করা হচ্ছে। এ ছাড়া ঢাকার সবচেয়ে জনপ্রিয় গণপরিবহন মেট্রোরেলের যাত্রীদের টিকিটের ওপর ভ্যাট আরোপ করতে যাচ্ছে এনবিআর।

এ বিষয়ে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ বলেন, ‘‘সাধারণত ভ্যাট আদায়ের মোট লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকের বেশি পরিশোধ করে বড় মাপের ১০০ থেকে ১৫০টি প্রতিষ্ঠান। অথচ ব্যবসা করে ভ্যাট ফাঁকি দিচ্ছে কয়েক লাখ প্রতিষ্ঠান। ভ্যাটের লক্ষ্যমাত্রা যত বাড়ানো হয়, হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ওপরই চাপ বাড়ে, যা ভোগান্তির বলে উল্লেখ করেন তিনি।’’

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘‘দেশে ২০ লাখের বেশি ভ্যাটযোগ্য প্রতিষ্ঠান আছে। অথচ তাদের কাছ থেকে ভ্যাট আদায় করা যাচ্ছে না। আগে প্যাকেজ ভ্যাটের আওতায় সরকার তাদের কাছ থেকে কিছু রাজস্ব পেতো। এখন সেটাও পাচ্ছে না।”

তিনি আরও বলেন, ‘‘শহরের সব দোকানমালিকের ভ্যাট নিবন্ধন নিশ্চিত করা সম্ভব হলে যারা নিয়মিত ভ্যাট দেন, তাদের ওপর চাপ কমতো। যদি সিটি করপোরেশন ও পৌর এলাকায় সবাইকে ইলেকট্রনিক ফিসকেল ডিভাইস (ইএফডি) দেওয়া হতো, তবে সরকার অন্তত এক লাখ কোটি টাকা রাজস্ব বেশি পাবে। আর ইউনিয়ন বা গ্রাম পর্যায়ে মেশিন দেওয়া সম্ভব হলে বছরে এর দ্বিগুণ ভ্যাট আদায় করা সম্ভব হবে।”

এ অর্থবছরের বাজেটে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। যার মধ্যে ভ্যাট থেকে এক লাখ ৫৯ হাজার ১০০ কোটি টাকা আদায় করার লক্ষ্য রয়েছে। এর মধ্যে গত আট মাসে (জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি) ভ্যাট আদায় হয়েছে ৮৮ হাজার ৭০১ কোটি টাকা।

এনবিআর সূত্র জানায়, দেশে ভ্যাট নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান মাত্র আট লাখ। এর মধ্যে অনলাইনে নিয়মিত রিটার্ন দাখিল করে ৯৬ হাজার প্রতিষ্ঠান। ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে রিটার্ন দাখিল করে ২০ থেকে ২২ হাজার প্রতিষ্ঠান। সেই হিসাবে প্রায় ৫৯ থেকে ৬০ লাখ দোকানমালিক বছরের পর বছর ভ্যাট ফাঁকি দিয়ে যাচ্ছেন।

যাদের বার্ষিক লেনদেন ৫০ লাখ টাকার কম, তাদের ভ্যাট দিতে হবে না। অর্থাৎ গড়ে দিনে ১৪ হাজার টাকার বেশি লেনদেন হলেই ভ্যাট দেওয়া বাধ্যতামূলক। মূলত ভ্যাট যোগ করেই পণ্যের দাম নির্ধারণ করা হয়। ক্রেতা পণ্য কিনতে গিয়ে নিজের অজান্তে ভ্যাট পরিশোধ করেন। কিন্তু সরকারি কোষাগারে তা জমা না দিয়ে দোকানদার তা নিজের পকেটে ঢোকান।

ঢাকার মানিকনগর বিশ্বরোড এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা করছে রয়েল ভিলেজ রেস্টুরেন্ট। ইএফডি মেশিন থাকা সত্ত্বেও শীতাতপনিয়ন্ত্রিত এই রেস্টুরেন্ট ভোক্তাদের ভ্যাটের চালান দেয় না। তুলনামূলক কম দামে গ্রাহক ধরে রাখতে তারা সরকারকে ভ্যাট ফাঁকি দিচ্ছে প্রকাশ্যে। ভোক্তা স্বপ্রণোদিত হয়ে ভ্যাটের ইসিআর রশিদ চাইলে তখন অতিরিক্ত টাকা আদায় করে রেস্টুরেন্টটি। শুধু রয়েল ভিলেজ নয়, ঢাকায় এমন শত শত রেস্টুরেন্ট এভাবে সরকারকে রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে।

২০২১ সালে একটি জরিপ করে ভ্যাট গোয়েন্দা অধিদপ্তর। তাদের জরিপে দেখা যায়, প্রতি পাঁচটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে চারটিরই ব্যবসায় শনাক্তকরণ সংখ্যা (বিআইএন) নেই। নিবন্ধন ছাড়াই ব্যবসা করে চলেছে তারা। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদীর নামকরা ১৭টি বিপণিবিতানে ওই জরিপ করে ভ্যাট গোয়েন্দা অধিদপ্তর। এই জরিপে উঠে আসে, ৮৮% দোকান ভ্যাটের আওতায় আসেনি। আর বাকি ১২% ব্যবসায়ীর দেওয়া ভ্যাটও বাস্তবতার সঙ্গে ‘‘সঙ্গতিপূর্ণ নয়’’।

খুচরা পর্যায়ে ভ্যাট আদায় বাড়াতে ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) মেশিন স্থাপনের উদ্যোগ থাকলেও কারিগরি ত্রুটির কারণে তা ফলপ্রসূ হচ্ছে না।

২০১৯ সালের আগস্টে পরীক্ষামূলকভাবে ঢাকা ও চট্টগ্রামে পাঁচটি ভ্যাট কমিশনারেটে ইএফডি চালু করা হয়। চার বছর পার হলেও এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নেই।

ভ্যাট অনলাইন প্রকল্প ও ইএফডি মেশিনের মধ্যকার কারিগরি ত্রুটির কারণে মেশিন স্থাপন কালক্ষেপণ হচ্ছে। এ পর্যন্ত সারা দেশে মাত্র ১৮ হাজার পাঁচটি ইএফডি এবং ৫০০টি এসডিসি স্থাপন করা হয়েছে।

তবে ভ্যাট আদায়ে স্বচ্ছতা আনতে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে সারা দেশে পাঁচ লাখ ইএফডি মেশিন স্থাপনের লক্ষ্য রয়েছে বলে জানিয়েছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মু. রহমাতুল মুনিম।

এনবিআরের সদস্য ড. মইনুল খান বলেন, ‘‘খুচরা পর্যায়ে ভ্যাট আদায়ে এনবিআর তৎপর রয়েছে। আগামী জুন নাগাদ ঢাকা ও চট্টগ্রামে আরও ৬০ হাজার ইএফডি মেশিন স্থাপন করা হবে।’’

বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘‘আমাদের সমিতির সদস্যদের মধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠান ভ্যাটযোগ্য নয়। আবার অনেক যোগ্য প্রতিষ্ঠান এখনও দোকান মালিক সমিতির সদস্য হয়নি। দেশে অন্তত ২০ লাখ ভ্যাটযোগ্য প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট দেওয়ার সামর্থ্য রয়েছে।’’

তবে তিনি প্রশ্ন তোলেন, ‘‘ছয় বছর আগে ইএফডি মেশিন চালু করেও কেন এখন পর্যন্ত শেষ করতে পারেনি? দোকানিরা ভ্যাট নিবন্ধন নিতে চান। হিসাব-নিকাশ রাখার জন্য ইএফডি দেওয়া হলে সবাই ভ্যাট দেবেন। তখন ভুল-বোঝাবুঝি আর থাকবে না।’’

১৯৯১ সালে দেশে প্রথম ভ্যাট আইন প্রবর্তন হয়। কিন্তু প্রত্যাশিত শৃঙ্খলা না আসায় সরকার ২০১২ সালে উন্নত ভ্যাট ব্যবস্থাপনা অনুসরণে একটি আইন প্রবর্তন করে, যা ২০১৫ সাল থেকে বাস্তবায়ন হওয়ার কথা ছিল।

তবে ওই আইনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ব্যবসায়ীদের তীব্র আপত্তির মুখে কিছুটা পিছিয়ে এসে ১৯৯১ সালের ভ্যাট আইন ও ২০১২ সালের ভ্যাট আইনের সংমিশ্রণে নতুন একটি আইন দাঁড় করানো হয়। ২০১৯ সাল থেকে এর প্রয়োগ শুরু হয়, তবে কয়েক লাখ দোকান ব্যবসায়ী এখনও নির্ভয়ে ভ্যাট ফাঁকে দিয়ে দিচ্ছেন।

অর্থনীতি,রাজস্ব,জাতীয় রাজস্ব বোর্ড
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close