• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

যেভাবে উৎপত্তি বাংলা ভাষার

প্রকাশ:  ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০১:৩৭ | আপডেট : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ২২:৪০
রুদ্র মাহমুদ

জন্মের পর থেকে যে ভাষা আমরা শুনে আসছি, যে ভাষায় নিজেদের মনের ভাব প্রকাশ করে চলেছি- সেই প্রাণের ভাষা বাংলা এলো কোথা থেকে? কিভাবে এর উৎপত্তি? আসলে বাংলাভাষার উৎপত্তি নিয়ে নানা জনের আছে নানা মত। তবে এটা সত্য যে বাংলাভাষা একদিনে আজকের পর্যায়ে আসেনি। শত সহস্র বছরের বিবর্তনে এটি আজকের রূপ পেয়েছে। এখন আমরা যে বাংলা ভাষা বলি এক হাজার বছর আগে তা ঠিক এমন ছিল না। এক হাজার বছর পরও ঠিক এমন থাকবে না। ভাষা এমনই চলমান প্রক্রিয়া, পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এটি সমৃদ্ধ হয় এবং নতুন রূপে বিকশিত হয়।

এই ভূখন্ডে বাংলা ভাষার আগেও অন্য ভাষা ছিল। ওই ভাষায় এদেশের মানুষ কথা বলত, গান গাইত, কবিতা বানাত। মানুষের মুখে মুখে বদলে যায় ভাষার ধ্বনি। রূপ বদলে যায় শব্দের, বদল ঘটে অর্থের। অনেকদিন কেটে গেলে মনে হয় ভাষাটি একটি নতুন ভাষা হয়ে উঠেছে। আর এভাবেই রূপন্তরের মধ্যে দিয়ে উৎপত্তি হয়েছে বাংলাভাষার। তবে এ ধারণা ভেঙে দিয়েছেন ভাষাবিদ ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় আর ড. মুহাম্মদ শহীদউল্লাহসহ আরও বেশ কজন গবেষক ভেঙে দিয়েছেন সেই ধারণা। গবেষণায় তারা প্রমাণ করেছেন, সংস্কৃত ভাষা থেকে উৎপত্তি ঘটেনি বাংলার। ঘটেছে অন্য কোনো ভাষা থেকে। সংস্কৃত ছিল সমাজের উঁচুশ্রেণির মানুষের লেখার ভাষা। তা কথ্য ছিল না। কথা বলত মানুষেরা নানা রকম ‘প্রাকৃত’ ভাষায়। প্রাকৃত ভাষা হচ্ছে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের কথ্য ভাষা। তাঁরা প্রমাণ করেন যে, সংস্কৃত থেকে নয়, প্রাকৃত ভাষা থেকেই উদ্ভব ঘটেছে বাংলা ভাষার।

সম্পর্কিত খবর

    প্রাচীন ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে মনের ভাব প্রকাশের নানা রীতি চালু ছিল। সেখান থেকেই অঞ্চলভেদে উৎপত্তি হয় ভিন্ন ভিন্ন প্রাকৃতভাষা। আমাদের এই নদী বিধৌত পূর্ব অঞ্চলের মানুষেরা যে প্রকৃত ভাষায় কথা বলতে, তা হলো মাগধী। সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা মাগধি রূপান্তরিত হয়ে বাংলাভাষার উদ্ভব হয়।

    বাংলা ভাষার ইতিহাস জানতে হলে একটু পিছিয়ে যেতে হবে। পিছিয়ে যেতে হবে অন্তত কয়েক হাজার বছর। ভারতীয় ভূখণ্ডের প্রাচীন ভাষাগুলোকে বলা হয় প্রাচীন ভাষা আর্য। মূলত মনের ভাব প্রকাশে মাধ্যম ছিল এটি, প্রাচীন আর্যভাষার সঠিক কোনো কাঠামো ছিল। না। পরে এই আর্যভাষা রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় প্রয়োজনে ব্যবহারকালে পন্ডিত এর একটি লিখিত রূপ দাঁড় করানোর চেষ্টা করেন যিশুখ্রিস্টের জন্মেরও এক হাজার বছর আগে, অর্থাৎ ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। আর্য ভাষা রূপান্তরিত হয় বৈদিক ভাষায়, বেদের শ্লোক তারই নজির বহন করছে। সেটি ছিল উচুঁ গোত্রের মধ্যেই প্রচলিত। সাধারণ মানুষের কাছে বেদের ভাষা বা বৈদিক ভাষা দুর্বোধ্য মনে হতো। তাই তারা দৈনন্দিন জীবনে আঞ্চলিকতার প্রভাবে পাল্টে যাওয়া আর্য ভাষাতেই মনের ভাব প্রকাশ করতো। শতাব্দী পর শতাব্দী কাটতে থাকে আর অাঞ্চলিকতার প্রভাবে মূলভাষাটি চাপা পড়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রাকৃতভাষায়র উৎপত্তি হয়।

    যিশুর জন্মের আগেই পাওয়া যায় ভারতীয় আর্যভাষার তিনটি স্তর। প্রথম স্তরটির নাম বৈদিক বা বৈদিক সংস্কৃত। খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৮০০ অব্দ এ ভাষার কাল। তারপর পাওয়া যায় সংস্কৃত। খ্রিস্টপূর্ব ৮০০ অব্দের দিকে এটি সম্ভবত বিধিবদ্ধ হতে থাকে এবং খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ অব্দের দিকে ব্যাকরণবিদ পাণিনির হাতেই এটি চূড়ান্তভাবে বিধিবদ্ধ হয়। বৈদিক ও সংস্কৃতকে বলা হয় প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা। প্রাকৃত ভাষাগুলোকে বলা হয় মধ্যভারতীয় আর্যভাষা। মোটামুটিভাবে খ্রিস্টপূর্ব ৪৫০ অব্দ থেকে ১০০০ খ্রিস্টাব্ধ পর্যন্ত এ ভাষাগুলো কথ্য ও লিখিত ভাষারূপে ভারতের বিভিন্ন স্থানে প্রচলিত থাকে। এ প্রাকৃত ভাষাগুলোর শেষ স্তরের নাম অপভ্রংশ অর্থাৎ যা খুব বিকৃত হয়ে গেছে। বিভিন্ন অপভ্রংশ থেকেই উৎপন্ন হয়েছে নানান আধুনিক ভারতীয় আর্যভাষা- বাংলা, হিন্দি, গুজরাটি, মারাঠি, পাঞ্জাবি প্রভৃতি ভাষা।

    ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় মনে করেন, পূর্ব মাগধী অপভ্রংশ থেকে উদ্ভূত হয়েছে বাংলা; আর আসামি ও ওড়িয়া ভাষা। তাই বাংলার সাথে খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আসামি ও ওড়িয়ার। আর কয়েকটি ভাষার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তা রয়েছে বাংলার সঙ্গে; কেননা সেগুলোও জন্মেছিল মাগধী অপভ্রংশের অন্য দুটি শাখা থেকে। ওই ভাষাগুলো হচ্ছে মৈথিলি, মগহি, ভোজপুরিয়া। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ বাংলা ভাষার উৎপত্তি সম্পর্কে অবশ্য একটু ভিন্ন মত পোষণ করেন। তিনি একটি প্রাকৃতের নাম বলেন গৌড়ী প্রাকৃত। তিনি মনে করেন, গৌড়ী প্রাকৃতেরই পরিণত অবস্থা গৌড় অপভ্রংশ থেকে উৎপত্তি ঘটে বাংলা ভাষার।

    প্রাচীন ভারতবর্ষে সর্বসাধারণের কথ্যভাষা ছিল প্রাকৃত ভাষা। খ্রিষ্টপূর্ব ৪৫০ অব্দ থেকে ১০০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত একাধারে লিখিত ও কথ্য ভাষারূপে ভারতের নানা জায়গায় এ প্রাকৃত ভাষাসমূহ প্রচলিত ছিল। সাধারণ মানুষের কথ্যভাষা প্রাকৃত থেকেই বাংলা ভাষার উৎপত্তি। ধারণা করা হয় প্রাচীন ভারতের প্রাকৃত ভাষাগুলোর মধ্যে পালি অন্যতম, যার জন্ম খ্রিষ্টজন্মেরও কমপক্ষে ছ শ বছর আগে। পালি ছিল মধ্য বিহারের মগধ অধিবাসীদের মুখের ভাষা। পালি মুখ্যত কথ্য ভাষা হলেও তার সুনির্দিষ্ট ব্যাকরণ ছিল এবং তাতে কাব্য, নাটক ইত্যাদি রচিত হয়েছিল। যুগ যুগ ধরে ভারতে (মূল অংশে) যেমন সংস্কৃতের কদর বা ইউরোপে ল্যাটিনের—গঙ্গার এপারে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে পালিও ঠিক তা-ই আছে এখন পর্যন্ত, যেমনটি শত বছর ধরে ছিল। কিন্তু এত যে পুরোনো ভাষা, এত সুদূরব্যাপী যার বিস্তার, এবং এত সব মূল্যবান ঐতিহাসিক নিদর্শন যার রয়েছে সেই পালি তার যথাযথ মর্যাদা পায়নি। তার সম্মানে কোনো রচনা প্রকাশিত হয় না। এমনকি গবেষক ও ভাষাতাত্ত্বিকদের নিকটও পালি যেন অনেকটাই অপরিচিত। এই অসম্মান ও অনাদর পালির পাওনা ছিল না। সংস্কৃতের মতোই পালিরও মৃত্যু ঘটেছে বহু শতাব্দীকাল আগেই। অর্থাৎ এখন আর এ ভাষার কোনো স্থানীয় জাতি নেই, বা সে অর্থে মাতৃভাষা হিসেবে ব্যবহারের মানুষ নেই; কেবল সাহিত্যিক ও ধর্মীয় ভাষা হিসেবেই ব্যবহৃত হয়। গৌতম বুদ্ধ এ ভাষাতেই ধর্ম প্রচার করেছিলেন। মূলত একটি সাধারণ প্রাদেশিক ভাষা হয়েও এটি ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী ভাষা হয়ে উঠেছিল, যা তাকে বসিয়েছে চিরায়ত ভাষার আসনে। সংস্কৃতের সাথে এর সম্পর্ক অনেকটা বোনের মতো। পালি এবং সংস্কৃত, যদিও নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে দুজনের মধ্যে, ছিল হারানো আর্যভাষার সম্পূর্ণ পৃথক ও স্বাধীন দুটি ভাষা-শাখা।

    হারানো আর্যভাষা মূলত ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশেরই সদস্য। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশ বলতে মূল ভাষাগোষ্ঠীকে বোঝায়। যেসব ভাষা ইউরোপের অনেকটা অংশজুড়ে এবং বৃহত্তর দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথমে বিস্তৃতি লাভ করে তাদের সম্মিলিতভাবে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা-পরিবার বলা হয়। অবশ্য এসব ভাষাভাষী গোষ্ঠী বর্তমানে সারা পৃথিবীজুড়েই ছড়িয়ে পড়েছে। পৃথিবীর অর্ধেকের চেয়েও বেশি মানুষ এ পরিবারভুক্ত ভাষায় কথা বলে থাকেন। আমাদের মাতৃভাষা বাংলাসহ গ্রিক, ল্যাটিন, ইংরেজি, হিন্দি, ফারসি, ফরাসি, ডাচ, নেপালি ইত্যাদি ভাষা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা-পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। আনুমানিক পাঁচ হাজার বছর পূর্বে এই মূল ভাষার অস্তিত্ব ছিল। এই ভাষা-পরিবারের ভাষা-শাখাগুলোর মধ্যকার পার্থক্যগুলো সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে আজ থেকে তিন বা চার হাজার বছর আগে।

    মূলত ওই সময়ের মধ্যেই গ্রিক, অ্যান্টোলিন এবং ইন্দো-ইরানীয় প্রভৃতি ভাষা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল। বলা হয়ে থাকে এসব ভাষা এসেছে পূর্ব ইউরোপ এবং পশ্চিম এশীয় অঞ্চলের সমভূমিতে ঘুরে বেড়ানো যাযাবর উপজাতির কাছ থেকে। এ অঞ্চলকে একসময় ‘গোবি’ও বলা হতো। এটি খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ সালের কথা। খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ সাল থেকে ইন্দো-ইউরোপীয় পরিবারের ভাষাভাষী লোকেরা ইউরোপ ছাড়িয়ে আটলান্টিকের উপকূল এবং ভূমধ্যসাগরের উত্তর কূলের দিকে আসতে শুরু করে। পারস্য ও ভারত জয়ের মধ্য দিয়ে তারা ছড়িয়ে যায় এশিয়ার দূর এলাকাসমূহে। সমসাময়িক সময়েই সিন্ধুর অধিবাসীগণও পূর্বদিকে (গাঙ্গেয় সমভূমি) এবং পশ্চিম এবং আফগানিস্তান) ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। খ্রিষ্টপূর্ব ১০০০ অব্দের মধ্যে দুটি ভাষা-শাখা, ভারতীয় আর্যভাষা (ইন্দো-আর্য) এবং ইন্দো-ইরানীয় ভাষা, আলাদা হয়ে যায়। ভারতীয় আর্যভাষার ইতিহাসে তিনটি প্রধান স্তর লক্ষ করা যায়।

    আমাদের দেশের সবচেয়ে পুরোনো ভাষার নাম 'প্রাচীন প্রাকৃত'। কালক্রমে 'প্রাচীন প্রাকৃত' অভিহিত হয় 'আধুনিক প্রাকৃত'রূপে। আধুনিক প্রাকৃত ভাষা থেকে শাখা-প্রশাখা গড়ে উঠে 'গৌড়ী প্রাকৃত', 'মাগধী প্রাকৃত' ইত্যাদি নামে আরো কয়েকটি প্রাকৃত ভাষার জন্ম হয়। কালের বিবর্তনে প্রাকৃত ভাষার আরো পরিবর্তন ঘটে যায় এবং নাম হয় অপভ্রংশ। এই অপভ্রংশ থেকে জন্মলাভ করে আসামের 'অহমিয়া' ভাষা, উড়িষ্যার 'উড়িয়া' ভাষা, ভারতের 'হিন্দী' ভাষা এবং এতদাঞ্চলের 'বাংলা' ভাষা ইত্যাদি। মনে হয় প্রাচীনকালের কোন ভাষার সংস্কার করেই 'সংস্কৃত' নাম রাখা হয়েছে। কেননা, যা সংস্কার করা হয় সেটাই সংস্কৃত। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় প্রাচীন প্রাকৃত বা আধুনিক প্রাকৃত জনগণের মুখের ভাষা। কিন্তু সংস্কৃত ভাষা কখনও জনগণের মুখের ভাষা ছিল না। এখনও জনগণের মুখের ভাষা নয়। এটা হচ্ছে হিন্দুদের ধর্মীয় ভাষা। ব্রাহ্মণ-ভট্টাচার্য ছাড়া এ ভাষায় পণ্ডিত হবার কারও অধিকার ছিল না। হিন্দু-ব্রাহ্মণ্য রাজাদের যুগে বাংলা ভাষার উপর যে অত্যাচার হয়েছে তাতে বাংলা ভাষা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সাধারণ মানুষ বাংলাকে ধরে রেখেছিল, টিকিয়ে রেখেছিল। পরবর্তীকালে ১২০৩ সালে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজী মাত্র ১৭ জন ঘোড়ু-সওয়ার নিয়ে হিন্দু-ব্রাহ্মণ্য রাজা লক্ষণ সেনকে পরাজিত করার পর শুরু হলো বাংলায় মুসলিম শাসন। তাতে মুক্ত হলো সংস্কৃতি, মুক্ত হলো ভাষা। এদেশের কর্মের সাথে, জীবনের সাথে জড়িত হলো বাংলা। বাঙালি মুসলমান বাংলার প্রতি পুরোদমে আকৃষ্ট হলো। বাংলার পাঠান বাদশাগণ, আমীর-ওমরাহ এবং সাধারণ মানুষ বাংলার কদর করতে লাগলো।

    তারপর ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়ে ইংরেজদের হাতে নবাব সিরাজউদ্দৌলার শোচনীয় পরাজয়ের পর কয়েকশত বছরের মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে এবং বাংলার জনগণ ও বাংলা ভাষার উপর নেমে আসে আবার নির্যাতন। ইংরেজ আমলে খৃস্টান মিশনারী ও সংস্কৃত পণ্ডিতগণ বাংলা ভাষা থেকে আরবী, ফার্সি, তুর্কী শব্দ এমনকি আঞ্চলিক শব্দও বিতাড়িত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং বাংলা ভাষাকে বিশুদ্ধ করার অপপ্রচার চালিয়ে সংস্কৃত ভাষার শব্দরাজি চাপিয়ে দেন।

    ইংরেজ আমলেই ১৯১১ সালে সর্বপ্রথম বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব দেন নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী। বাংলাকে শিক্ষার বাহন করার জন্যও তিনি জোর দাবি জানান। এরপর ১৯১৮ সালে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে শান্তিনিকেতনে অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় সম্মেলনে ভাষাতাত্ত্বিক পণ্ডিত ড. মুহম্মদ শহীদউল্লাহ ঘোষণা করেছিলেন:"শুধু ভারত কেন, সমগ্র এশিয়া মহাদেশেই বাংলা ভাষার স্থান হবে সর্বোচ্চ। ভাব-সম্পদ ও সাহিত্যগুণে বাংলা ভাষা এশিয়ার ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে অদ্বিতীয়।"

    যা হোক, ১৯৪৭ সালে ইংরেজ শাসনের অবসান ও স্বাধীনতা লাভে পাকিস্তান নামক একটি স্বাধীন দেশের সৃষ্টির পরও পূর্ব বাংলার মানুষকে নতুন করে সংগ্রাম করতে হলো মাতৃভাষা বাংলা তথা রাষ্ট্রভাষা বাংলার প্রশ্নে। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ এবং তত্পরবর্তী পর্যায়েও কঠোর ভাষা-সংগ্রামের মাধ্যমে, ভাষা শহীদদের রক্তের বিনিময়ে ১৯৫৬ সালে পূর্ব বাংলার জনগণের মাতৃভাষা বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ করে। তারপর এদেশের নির্যাতিত মানুষের মরণজয়ী ভাষা-সংগ্রামের ফলশ্রুতিতে ও কঠিন আন্দোলনের চেতনায় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ায় একমাত্র ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র হিসেবে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে ১৯৭১ সালে।

    বাংলাদেশ হওয়ার পরবর্তী পর্যায়ে ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘের অংগ সংগঠন ইউনেস্কো সংগত কারণে যথোপযুুক্ত বিবেচনায় ঐতিহাসিক মহান ভাষা আন্দোলন দিবস একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। ভাষা আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক বিজয়ের পর এটা বাঙালি জাতির আরেকটি মহত্ বিজয় অর্জিত হলো। মে দিবস, নারী দিবস, মানবাধিকার দিবসের মতো বাঙালির ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে জগদ্বাসীর স্বীকৃতিপ্রাপ্ত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। এটা আমাদের জন্য পরম গৌরবের বিষয়।। সংস্কৃত না পালি—ভারতের সবচেয়ে পুরোনো ভাষা কোনটি তা নিয়ে সুদীর্ঘকাল ধরেই বিতর্ক চলেছে। তবে সে বিতর্ককে পাশ কাটিয়েও বলা যায়, সংস্কৃত গ্রিকের চেয়ে বেশি নিখুঁত, ল্যাটিনের চেয়ে বেশি গভীর, এবং এ দুটো ভাষার তুলনায় অনেক বেশি নিপুণতার সাথে সংস্কারকৃত, যদিও তাদের উভয়ের সাথেই সংস্কৃতের যথেষ্ট পরিমাণে সাদৃশ্য রয়েছে। ক্রিয়াপদের মূল এবং ব্যাকরণগত গঠনপ্রণালীর দিক থেকে এ তিনটি ভাষায় এত বেশি মিল যে, ভাষাগুলোর উৎপত্তি যে একই উৎসমূল থেকে হয়েছে সে বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশই নেই। সেই অজ্ঞাত মূল সূত্রটি অবশ্য চিরতরে কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে।

    লেখক: ব্লগার ও অনলাইন এক্টিভিস্ট

    এনই/ই

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close