• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

চকবাজার ট্রাজেডি, এখনও ২০ কোটি টাকার কেমিক্যাল সেই ভবনে

প্রকাশ:  ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০১:৪৫
নিজস্ব প্রতিবেদক

রাজধানী পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টার ‘হাজী ওয়াহেদ ম্যানশন’ ধ্বংসাবশেষে পরিণত হলেও ভবনের বেজমেন্টটি এখনও অক্ষত, আর সেখানে অন্তত ২০ কোটি টাকার কেমিক্যাল মজুদ আছে। বেজমেন্টে বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যালের সন্ধান পেয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। সেখানে শত শত বস্তা, প্লাস্টিকের ড্রাম আর টিনের মাঝারি সাইজের ড্রাম দেখতে পান তারা। এখানে আগুন লাগলে ভবনটি একেবারে উড়ে যেত বলে মন্তব্য করেন তারা।

শুক্রবার (২২ ফেব্রুয়ারি) সকাল ১১টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা মরদেহের সন্ধান করতে গিয়ে ওয়াহেদ ম্যানসনের বেজমেন্টে এই দৃশ্য দেখতে পান তারা

বুধবার রাতে চকবাজারের নন্দকুমার দত্ত রোডের শেষ মাথায় চুড়িহাট্টা শাহী মসজিদের পাশে ৬৪ নম্বর হোল্ডিংয়ের ওয়াহিদ ম্যানশনে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়। আবাসিক ভবনটিতে কেমিক্যাল গোডাউন থাকায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৬৭ জন পুড়ে মারা যায় ও অগ্নিদগ্ধ হয়ে চিকিৎসাধীন আছে ৪১ জন। ফায়ার সার্ভিসের তিন’শ কর্মীর সমন্বয়ে ১৩টি স্টেশনের ৩৭টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।

শুক্রবার দুপুরে ভবনের বেজমেন্টে প্রবেশ করলে দেখা যায় জায়গাটি গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য হলেও, আসলে সেটি বিশাল কেমিক্যাল গোডাউন।

গোডাউনটির ভেতরে চারপাশে সারিবদ্ধভাবে সাজানো কেমিক্যালের ড্রাম।এছাড়া রয়েছে বিভিন্ন ধরনের রং ও পাউডারের বস্তা। এছাড়াও দানা প্লাস্টিক, পারফিউম ও কসমেটিকস তৈরির সরঞ্জামসহ মারাত্মক দাহ্য পদার্থ।

ভবনটির নিচতলায় পুড়ে যাওয়া তিনটি দোকানের ভেতরে ঢুকে ধ্বংসস্তুপের মধ্যেও কেমিক্যালের সন্ধান মিলেছে। ওয়াহেদ ম্যানশনের নিচতলার তিনটি দোকানের একটিতে পাওয়া গেছে দানা প্লাস্টিক, যা কেমিক্যাল মিশ্রিত এবং প্লাস্টিকের সরঞ্জাম তৈরি করতে ব্যবহার করা হয়। মিলেছে কসমেটিকস তৈরির সরঞ্জামও।

স্থানীয় বাসিন্দারা বলছে, আগুন লাগার দুদিন আগেও ভবনের মালিক প্রায় সাত ট্রাক কেমিক্যাল আন্ডারগ্রাউন্ডে মজুদ করে। রহমতগঞ্জের হান্নান আলী নামের এক বাসিন্দা বলেন, ভবনের মালিক কোটি কোটি টাকার কেমিক্যালের ব্যবসা করতেন, কিছুদিন আগে প্রায় ২০ কোটি টাকার কেমিক্যাল তিনি মজুদ করেছিলেন।

ওয়াহেদ ম্যানশনের বেজমেন্টে কেমিক্যাল গোডাউন নিয়ে জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র স্টেশন অফিসার শাজাহান শিকদার বলেন, গ্রাউন্ড ফ্লোরে এ ধরনের ইন্ডাস্ট্রিয়াল কেমিক্যাল রাখা অপরাধ। আবাসিক এলাকায় এই ধরনের কেমিক্যাল রাখা উচিত নয়।

অথচ এখানে দুই পাশের পার্কিংয়ের জায়গায় বোঝাই করে এসব কেমিক্যাল গুদামজাত করে রাখা হয়েছিল। তাই আগুন নেভানোর কাজ করার সময় আমরা গ্রাউন্ডে তিনটি ইউনিট দিয়ে পানি দিয়েছি, যাতে আগুন গ্রাউন্ড ফ্লোরে না যায়। আগুন যদি কোনোভাবে গ্রাউন্ড ফ্লোরে চলে যেত ভবনটি বিস্ফোরিত হয়ে সঙ্গে সঙ্গে ধসে পড়তো।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এস এম জুলফিকার রহমান বলেন, ওয়াহেদ ম্যানশনে কেমিক্যালের উপস্থিতি ছিল। ভবনের ভেতরে গ্যাস লাইটার রিফিলের পদার্থ ছিল। এটা নিজেই একটা দাহ্য পদার্থ। এছাড়া আরও অন্যান্য কেমিক্যাল ছিল। প্রত্যেকটা জিনিসই আগুন দ্রুত ছড়িয়ে দিতে সহায়তা করেছে। পারফিউমের বোতলে রিফিল করা হতো এখানে। সেই বোতলগুলো ব্লাস্ট হয়ে বোমের মতো কাজ করেছে। এসবই কিন্তু এক ধরনের কেমিক্যাল। আর এই কেমিক্যালের জন্যই আগুন নিয়ন্ত্রণে এত বেশি সময় লেগেছে।

বাংলাদেশ বিস্ফোরক পরিদফতরের প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক শামসুল আলম জানান, নিমতলী অগ্নিকাণ্ডের পর থেকে ওই এলাকায় কেমিক্যাল ব্যবসার জন্য একটি লাইসেন্সও দেওয়া হয়নি। ওই এলাকায় বিস্ফোরক পরিদফতরের লাইসেন্সধারী কোনো গুদামও নেই। যে ভবনটিতে আগুন লেগেছিল সেটিতেও রাসায়নিক দ্রব্য ও দাহ্য পদার্থ রাখার অনুমতি ছিল না।

ক্ষতিগ্রস্ত ও পুড়ে যাওয়া পাঁচটি ভবনে সতর্কবার্তাসহ সাইনবোর্ড টাঙিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। লাল ফিতা দিয়ে ভবনগুলো কর্ডন করে রাখা হয়েছে। ব্যানারে লেখা রয়েছে, ‘ঝুকিপূর্ণ ভবন। ভবনটি ব্যবহার না করার জন্য সকলকে বিশেষভাবে অনুরোধ করা হলো’। চুড়িহাট্টার নন্দ কুমার দত্ত রোডের ১৮, ৬৩/২,৬৩/৩ ৬৪ এবং ৬৫ নম্বর ভবনগুলোতে ব্যানারগুলো টাঙানো হয়েছে।

নিমতলীর ট্র্যাজেডির পর চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর কী বলছে স্থানীয়রা ? জানতে চাইলে কাজী মান্নান নামের এক বাসিন্দা জানান, ঘটনাস্থলে একটু দূরেই ছিলাম, অগ্নিকাণ্ডে বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার ব্লাস্টের পর সিলিন্ডার বিস্ফোরণের মাধ্যমে হলেও ওয়াহেদ ম্যানশনের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় কেমিক্যালের গোডাউন ছিল। যার কারণে আগুন ছড়িয়েছে। সরকার ও স্থানীয়রা যদি এক হয়ে এসব মুনাফালোভী বাড়িওয়ালাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় তবে আর এমন মর্মান্তিক ঘটনা ঘটবে না। আমরা নিজেরাও চাই এলাকার আবাসিক ভবনে কোন কেমিক্যালের গোডাউন না থাকুক। তবে এসব রুখতে হলে আমাদের নিজেদেরও সচেতন হতে হবে।

এলাকার স্থানীয়দের আড্ডাস্থল হিসেবে সুখ্যাতি ছিল পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টা। দিনের কাজকর্ম শেষে এলাকাবাসী এক হতেন এখানেই। সেই চুড়িহাট্টায় এখন আর আড্ডা নেই, আছে বাতাসে পোড়া গন্ধ আর প্রিয়জনকে হারানোর মাতম।

সেলিম হোসেন নামের এক বাসিন্দা জানান, কাউকে ফোন দিয়ে কোথায় আছে জানতে চাইলেই বলতো, চুড়িহাট্টা মোড়ে আছি। সবাই সারাদিন কাজ-কর্ম শেষ করে এখানে এসে মিলিত হতেন। এখানে হোটেল-চা দোকানগুলো ছিল একেকটা আড্ডাখানা। আর মুহূর্তের মধ্যেই পুরো এলাকাটা মৃত্যুপুরী হয়ে গেলো।

বুয়েটের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত পাঁচটি ভবনগুলোর মধ্যে আগুনের সূত্রপাত হওয়া ওয়াহিদ ম্যানশনের গ্রাউন্ড ফ্লোর ও ২ য় তলা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। বিম ও কলামগুলো বিশেষ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। ৩-৪ তলার বিম ও কলাম তেমন ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি। তবে কতোটা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে এ বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে।

তিনি বলেন, এক সপ্তাহ পর জানা যাবে, ভবনটি ব্যবহারের উপযোগী কি না। আগুন লাগা অন্যান্য ভবনগুলোও আমরা পরিদর্শন করেছি। তবে ভবনগুলো টিকে থাকার জন্য বিম ও কলাম প্রাথমিকভাবে ভালো মনে হয়েছে। তবে এগুলো ব্যবহারের উপযোগী কি না পরীক্ষা শেষে এক সপ্তাহ পর নিশ্চিত হওয়া যাবে। ওয়াহিদ ম্যানশনের দ্বিতীয় তলার পুরোটাতেই গোডাউন ছিল। এটি বেশ বড় ভবন হওয়া স্বত্ত্বেও আগুনের কোন ইক্যুপমেন্ট নাই। পর্যাপ্ত সিঁড়ি নাই। ভবনগুলো বিল্ডিং কোড মেনে তৈরি হয়নি।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ও সুরক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে বলেন অবশ্যই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গঠিত কমিটির তদন্ত আলোর মুখ দেখবে। এ ঘটনায় এরইমধ্যে মামলা হয়েছে, সে মামলায় তদন্ত শুরু হয়েছে। অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধানের জন্য গঠন করা এ কমিটিকে আগামী সাত কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো চিহ্নিত করে পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে সুপারিশ পেশ করা হবে।

অতিরিক্ত সচিব বলেন, ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর থেকে কাভারেজে মিডিয়ার ভালো উদ্যোগ ছিলো। আমাদের তদন্তে এসব ফুটেজ ও নিউজ নেওয়া হবে। তাছাড়া সবার সঙ্গে কথা বলে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হবে।

অগ্নিকাণ্ডে হতাহতের ঘটনায় অবহেলার অভিযোগ এনে অজ্ঞাত ১০/১২ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেছে পুলিশ।বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর চকবাজার থানায় পুলিশ বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) লালবাগ বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) ইব্রাহিম খান বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় অজ্ঞাত কয়েকজনের বিরুদ্ধে অবহেলার অভিযোগ এনে মামলা দায়ের করা হয়েছে। তদন্ত সাপেক্ষে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বেজমেন্টে কেমিক্যাল গোডাউন আছে তা এলাকার কেউই জানেন না বলে মত দেন এলাকাবাসী। ওপরে বোতলে গ্যাস ভরানো হয় সেটাই সবাই জানে। পুরান ঢাকায় গোপনে এরকম কত কেমিক্যাল গোডাউন আছে তা হয়ত কেউ জানেনই না বলে মন্তব্য করেন এলাকাবাসী।

বুয়েটের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান সৈয়দা রাজিয়া সুলতানা বলেন, আয়রণ অক্সাইড তেমন শক্তিশালী কেমিক্যাল না। বাকি তিনটি আয়রনিক ইয়ালো, ইঞ্জিনিয়ার কার্বন, অক্সাইড রেড বার ও এসিড গ্রিন মোটামুটি শক্তিশালী। তবে সবগুলো যদি একত্রিত হয় এবং আগুনের সংস্পর্শে আসে, তাহলে বড় ধরনের বিস্ফোরণ হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

প্রসঙ্গত ২০১০ সালে পুরান ঢাকার নিমতলীতে কেমিক্যাল গোডাউনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১২৪ জন মানুষের প্রাণহানির ৯ বছর পর সেই পুরান ঢাকাতেই ঠিক একই কারণে অগ্নিকাণ্ডে ৭০ জন মানুষ প্রাণ হারালেন।

পিবিডি/জিএম

ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টার হাজী ওয়াহেদ ম্যানশন,চকবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড,কেমিক্যাল গোডাউন,ঝুঁকি
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close