• সোমবার, ০৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

‌‌‌‌‌‌‌‌‌‘জীবনে মনে হয় কোনো বড় পাপ করেছি, না হলে ছেলেটা এভাবে মারা গেলো কেনো’

প্রকাশ:  ০৬ জানুয়ারি ২০২৪, ১৮:১৮
পূর্বপশ্চিম ডেস্ক

‘জীবনে মনে হয় কোনো বড় পাপ করেছি, না হলে আমার নিষ্পাপ ছেলে কেনো এতো কষ্ট পেয়ে মারা গেলো।’ ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলার সময় ফরিদপুরের আবদুল হক ঠিক নিজের নিয়ন্ত্রণে ছিলেন না। ছেলে আবু তালহার বিষয়ে কথা বলার সময় একটু পরপর খেই হারিয়ে ফেলছিলেন তিনি।

ছেলের ছোটকালের গল্প, তার পছন্দের খাবার, বাবা-মা’র সাথে খুনসুটির কথা বলতে বলতে কখনো মুখে স্মিত হাসি চলে আসছিলো, আবার পর মুহুর্তেই ডুকরে কেঁদে উঠছিলেন।

শুক্রবার (৫ জানুয়ারি) রাতে বেনাপোল থেকে ঢাকাগামী বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনে আগুনের ঘটনায় যে চারজন মারা গেছেন, তাদের একজন আবদুল হকের ২৪ বছর বয়সী ছেলে আবু তালহা।

আবদুল হকের তিন সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয় আবু তালহা সৈয়দপুরের আর্মি ইউনিভার্সিটি অব সাইন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টে তৃতীয় বর্ষে পড়তেন।

দুপুর বারোটার কিছুক্ষণ পর যখন আবদুল হকের সাথে কথা হচ্ছিলো, তখনো তিনি তার স্ত্রীকে জানাননি যে তার ছেলে মারা গেছে। দুর্ঘটনার খবর পেয়েই ফরিদপুর থেকে ঢাকায় চলে এসেছে তার পুরো পরিবার।

যদিও আবু তালহাসহ কয়েকজন এখনো নিখোঁজ রয়েছেন। তাদের মরদেহও পাওয়া যায়নি, পরিবারও তাদের সাথে গতকাল রাতের পর থেকে যোগাযোগ করতে পারেনি।তবে আবু তালহা’র বাবা আবদুল হক বলছেন ‘আমি অন্তর থেকে বুঝতে পারছি যে আমার ছেলে জান্নাতের পাখি হয়ে গেছে।’

ঢাকা মেডিকেলের কাছে একটি হোটেলে ছোট ছেলের সাথে স্ত্রীকে রেখে তিনি হাসপাতাল প্রাঙ্গণে অপেক্ষা করছিলেন আনুষ্ঠানিকভাবে ছেলের মৃত্যুর খবর পাওয়ার জন্য।

আনুষ্ঠানিক খবরের অপেক্ষা করা ছাড়া আসলে উপায়ও ছিলো না। আগুনে পুড়ে যাওয়া যে চারটি মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে, তাদের পরিচয় খালি চোখে নিশ্চিত করা আসলে অসম্ভব। সবকটি মরদেহই ‘পুড়ে কয়লা’ হয়ে গিয়েছে বলে বলছিলেন মর্গের কর্মীরা।

‘পুড়ে কয়লা’ হয়ে গেছে ট্রেনের কামরা

পুড়ে যাওয়া ট্রেনের কামরাগুলোও ‘পুড়ে কয়লা’ হয়ে গেছে বললে বেশি বলা হয় না।

কামরাগুলোর ভেতরে সিলিং ফ্যান, ভেতরের কাঠের অবকাঠামো, এমনকি কোথাও কোথাও চেয়ারের লোহার তৈরি গঠনও কিছুটা পুড়ে যেতে দেখা গেছে।

আগুনে পুড়ে যাওয়া চারটি কামরার মধ্যে একটির অবস্থা ছিলো ভয়াবহ। ঐ কামরার সাথে লাগোয়া টয়লেটের দরজা, ভেতরের ইস্পাতের কমোডও পুড়ে বিকৃত হয়ে গেছে।

ট্রেনে আগুন লাগার ঘটনা প্রথম নজরে আসে গোলাপবাগ সিগনাল এলাকার আশেপাশে থাকা মানুষজন। ঢাকার অন্যান্য রেল সিগনালের মতোই এই সিগনাল সংলগ্ন রেললাইন ধরে বেশ কিছু দোকানপাট ও বাসাবাড়ি রয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দা আসাদ হোসেন আর মোহাম্মদ তারা মিয়া নয়টার কিছুক্ষণ আগে দেখতে পান যে গোলাপবাগের দিকে আসতে থাকা ট্রেনের একটি কামরায় আগুন জ্বলছে। তারা তখন রেললাইনের পাশে ফাঁকা জায়গায় বসে লুডো খেলছিলেন।

‘কয়েকটা ছেলে ট্রেনের পাশে দৌড়াতে দৌড়াতে আসছিলো আর ‘আগুন, আগুন’ বলে চিৎকার করছিলো। তখন আমরা তাকিয়ে দেখি ট্রেন ধীরগতিতে আসছে, তখন একটা কামরায় আগুন জ্বলছিলো’, বলছিলেন আসাদ হোসেন।

ট্রেন গোলাপবাগ সিগনাল পার করে কিছুদূর গিয়ে গোলাপবাগ আর গোপীবাগের মাঝামাঝি গিয়ে থামে। ট্রেন থামার পরও শুরুর কিছুক্ষণ একটি কামরাতেই আগুন জ্বলছিলো বলে জানান তারা। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, মিনিট খানেকের মধ্যে আরো অন্তত দুইটি কামরায় আগুন ছড়িয়ে পড়ে।

আগুন ছড়িয়ে যাওয়ার পর রেললাইনের আশেপাশের বাসাবাড়ি আর দোকান থেকে মানুষ ছুটে আসেন। বাড়ির মালিকদের অনেকে নিজের বাড়ির পানির ট্যাংক থেকে পাইপ দিয়ে পানি দেয়ার ব্যবস্থা করেন, দোকানপাট থেকেও যে যতোটুকু সম্ভব পানি নিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করতে থাকেন।

একইসাথে চেষ্টা চলতে থাকা আগুন লাগা কামরার ভেতর থেকে মানুষ উদ্ধারের চেষ্টা। দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনের কামরার ভেতরে গিয়ে স্থানীয়দের অনেকেই মানুষ বের হতে সাহায্য করতে থাকে।

পরে যে দুটো বগিতে আগুন লাগে, সেগুলো থেকে মানুষ দ্রুত বের হয়ে যেতে পারলেও শুরুতে আগুন লাগা শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কামরা থেকে মানুষ বের হতে পারছিলেন না, বলছিলেন তারা মিয়া।

‘এসি বগি হওয়ায় জানালা খোলা যাচ্ছিলো না। আমরা বাইরে থেকে ইট মেরে, লাঠি দিয়ে বাড়ি দিয়ে জানালা ভাঙার চেষ্টা করেছি। কিন্তু কাজ হয় নাই। একটাই জানালা ভাঙতে পেরেছি।’

যে জানালা তারা ভাঙতে পেরেছিলেন, সেই জানালা দিয়ে দুই হাত বের করে অসহায়ভাবে বসে থাকা একজন ব্যক্তির ছবি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

স্থানীয়রা জানান, ভাঙা জানালা দিয়ে ঐ ব্যক্তিকে বের করার চেষ্টা করেন তারা। কিন্তু ততোক্ষণে শরীরের বড় অংশ পুড়ে যাওয়ায় তিনি কিছুই করতে পারছিলেন না।

ঐ ব্যক্তিকে যারা জানালা দিয়ে বের করতে চেষ্টা করছিলেন, স্থানীয় বাসিন্দা প্রিন্স সোহাগ তাদের মধ্যে একজন।

তিনি বলছিলেন, জানালা ভাঙার পর যখন ঐ লোক হাত বের করে, তখন আমি তার হাত ধরে টান দেই। কিন্তু তিনি ততোক্ষণে সম্পূর্ণ নিস্তেজ হয়ে পড়েছিলেন। একেবারেই নাড়াচাড়া করতে পারছিলেন না। তিনি শুধু বলছিলেন ‘আমার বউ, আমার বাচ্চা।’

পরে ঐ ব্যক্তির স্ত্রী আর সন্তানের পুড়ে যাওয়া মরদেহও স্থানীয়রা উদ্ধার করেন বলে বলছিলেন সোহাগ।

আগুনের ঘটনায় আহত আটজনকে শেখ হাসিনা বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এদের কারো শরীর ৯ শতাংশের বেশি না পুড়লেও প্রত্যেকের শ্বাসনালীর কিছু অংশ পুড়ে যাওয়ায় তাদের কেউই শঙ্কামুক্ত না বলে জানান হাসপাতালের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন।

স্থানীয়রা বলছিলেন রেললাইন থেকে ট্রেনের দরজার উচ্চতা বেশি হওয়ার কারণেও উদ্ধারকাজ ধীরে চালাতে হয়েছে। পুরুষ যাত্রীদের অধিকাংশ কামরা থেকে লাফ দিয়ে নামতে পারলেও নারী ও শিশুদের নামতে বেশি সময় লাগছিলো বলে বলছিলেন তারা।

ট্রেন গোলাপবাগের পরে থামার বিশ মিনিটেরও বেশি সময় পর ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঘটনাস্থলে পৌঁছায় বলে জানা যায় স্থানীয়দের কাছ থেকে।

ততোক্ষণে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে চারটি কামরায়। ফায়ার সার্ভিসের আটটি ইউনিট প্রায় এক ঘণ্টা চেষ্টার পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়।

এই আগুনের ঘটনা স্থানীয়দের মধ্যে কতোটা গভীর দাগ ফেলেছে, তা বুঝতে পারা যায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার বারো ঘণ্টার বেশি সময় পর ঘটনাস্থলে গিয়ে। তখনো রেললাইনে অন্তত দুই-তিনশো মানুষের জটলা। সবার কথার বিষয় একটাই, আগের দিন রাতের আগুন।

তাদের আলোচনায় ঘুরে ফিরে আসছিলো জানালা দিয়ে দু’হাত বের করে বসে থাকা ব্যক্তির কথা। ষাটোর্ধ এক নারীর স্বগতোক্তি কানে ভেসে আসে; ‘আল্লাহ যেন আমার শত্রুকেও এমন মৃত্যু না দেয়।’ খবর: বিবিসি বাংলা।

পূর্বপশ্চিমবিডি/এসএম

ছেলে,পাপ,‌‌‌‌‌‌‌‌‌জীবন,জরুরি বিভাগ,ঢাকা মেডিকেল
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close