কুষ্টিয়ায় লালনের আখড়াবাড়ী বসেছে সাধুর হাট
ফকির ইদ্রিস সাঁই। প্রবীণ লালন ভক্ত। এসেছেন রাজশাহীর বাঘা উপজেলার চকরাজাপুর গ্রাম থেকে। একাগ্রচিত্তে গেয়ে চলেছেন. ‘আর কি হবে এমন জনম বসবো সাধুর মেলে। হেলায় হেলায় দিন বয়ে যায় ঘিরে নিল কালে।’ ফকির ইদ্রিস সাঁই’র মত অসংখ্য বাউল, সাধু, গুরু, বৈষ্ণবের আগমনে এখন মুখরিত কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ার আখড়া বাড়ি, লালনধাম। অনুষ্ঠানের প্রথম দিনেই একতারা-দোতারা, ঢোল-খোল, বাঁশি, আর প্রেমজুড়ির তালে মাতোয়ার হয়ে উঠছেন বাউলরা। ফালগুনের পূর্ণিমা তিথি তথা দোল পূর্ণিমায় শত বছর ধরে এভাবেই বাউল সাধকরা জড়ো হন বাউলতীর্থে।
এবার ২০ মার্চ এ পূর্ণিমা তিথি হওয়ায় এর কদিন আগে থেকে ভক্তরা আসতে শুরু করেন আখড়া ছেউড়িতে। তিনদিনব্যাপী লালন স্মরনোৎসব চলবে শুক্রবার পর্যন্ত।
সম্পর্কিত খবর
কোন দাওয়াত নেই, পত্র নেই, তবুও এক উদাসি টানে মানুষ ছুটে এসেছেন দলে দলে, হাজারে হাজারে। যেখানে মিলন ঘটেছে নানা ধর্ম, নানা বর্ণের মানুষের। কেউ এসেছেন ধবধবে সাদা পোশাকে, আবার কেউ গেরুয়া বসনে। সাঁইজির টানে এ ধামে বাউল ছাড়াও সাধারণ দর্শনার্থীদের ভিড় লেগেছে।
‘বাড়ির পাশে আরশী নগর, মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপা রে তুই কুল হারাবি, মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি, সত্য বল সুপথে চল, এলাহি আলামিন গো আলা বাদশা আলমপনা তুমি’ এ রকম অসংখ্য লালনসংগীতের সুরের ম‚র্ছনায় তারা মাতিয়ে তুলেছেন বাউলধাম। লালন মাজারের আশপাশে ও মরা কালী নদীর তীর ধরে বাউলেরা ছোট ছোট আস্তানা গেড়ে সাঁইজিকে স্মরণ করেছেন গানে গানে। বাউল-ফকিরদের সঙ্গে সুর মেলাতে ভুল করছেন না ভক্তরাও।
লালন সাঁইজি জীবিত থাকাকালে ফাল্গুন মাসের শেষে দোল পূর্ণিমা তিথিতে কালী নদীর তীরে শিষ্যদের নিয়ে রাতভর গান-বাজনা ও তত্ব আলোচনা করতেন, যা কালক্রমে পরিণত হয়েছে লালন স্মরণোৎসবে।
দূর-দূরান্ত থেকে সাদা বসনে বাউল সাধকরা এসেছেন দলে দলে একতারা-দোতারা, ঢোল-খোল, বাঁশি, প্রেমজুড়ি, চাকতি, খমক হাতে। ক্ষণে ক্ষণেই খন্ড খন্ড মজমা থেকে নৃত্যসঙ্গীতের তালে তালে ছলকে উঠছে যেন উত্তাল ভাববাদী ঢেউ। কেউ শুধু লুঙ্গি পরে নাচছেন, গাইছেন। কারও উদোম গা। গলায় বিচিত্র বর্ণ ও আকারের পাথরের মালা।
হাতে বিশেষ ধরনের লাঠি ও বাদ্যযন্ত্র। লালন ধামের ভেতর ও বাইরে নিজেদের পছন্দমতো জায়গা করে নিয়ে গান-বাজনা করছেন তারা। বিচিত্র সব বাদ্যযন্ত্রে তুলছেন হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া লালনগীতি। আখড়ার একটি দল থামছে তো অন্যটি জমিয়ে রাখছে চারপাশ।
লালন ধামের ভেতর পঞ্চাশোর্ধ্ব নারী বাউল কামিরন তার সহযোগীদের নিয়ে একতারা হাতে নেচে-গেয়ে সাঁইজির বন্দনা করছিলেন। কথার পিঠে কথা আর মনের ভেতর আধাত্ম্যবাদ নিয়ে গাইছিলেন তিনি। কামিরন বলেন, লালন নিজেও এভাবে গান করতেন। তার কাছে ধর্ম, বর্ণ, জাত-পাতের বিচার ছিল না। পুরুষের পাশাপাশি আশ্রয়হীন নারীদের তিনি বাঁচার সুযোগ করে দিতেন। তাদের সঙ্গে নিয়ে গাইতেন। নাচতেন।
কোনো এক অচিন গাঁয়ের অচেনা মানুষ ফকির লালন এখানে বসেই জীবনভর সন্ধান করেছেন, অচিন পাখির সহজ কথায় বেঁধেছেন জীবনের গভীরতম গান। আধ্যাত্মিক দর্শন লাভের আশায় দূর-দূরান্ত থেকে ভক্ত-অনুসারীরা এখন এখানে আরও বেশি সুবিধা পাচ্ছেন। নিরাপদ আশ্রয়সহ কোনো সমস্যা হয় কি-না দেখার জন্য লালন একাডেমীর সদস্যরা সদা সতর্ক। তবে লালন একাডেমীর পক্ষ থেকে বাউলদের অধিবাস সেবা, বাল্যসেবা বা বালক সেবা ও পূর্ণসেবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাউলরা একসঙ্গে বসে গ্রহণ করেন সেবা। সমাধিতে গাঁদা ফুল, আতর, গোলাপ ছড়িয়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন হাজারো শিষ্য-ভক্ত।
উৎসবে শামিল হতে খুলনা থেকে ছুটে এসেছেন নববিবাহিত দম্পতি। সৌদি প্রবাসী স্বামী আব্দুল গাফ্ফার বলেন, 'লালনের গানে মানবতা বোধ, অহিংস ভাব ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার কারণে দিন দিন তার গানের ভক্ত ও অনুসারীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। স্ত্রী নারগিস পারভিন বলেন, লালন সাঁইজির এ আদর্শ অনুসরণ করলে দেশে বর্তমান হানাহানি বন্ধ হয়ে যেত। তিনি লালনের গান কবিতা আকারে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করারও দাবী জানান।
পিবিডি/এআইএস