• সোমবার, ০৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

স্বাধীনতার ৫১ বছরেও মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি মেলেনি শহীদ আব্দুল পরিবারের

প্রকাশ:  ২৩ এপ্রিল ২০২২, ১৬:৫৭
শেখ নাদীর শাহ্, খুলনা প্রতিনিধি

স্বাধীনতার ৫১ বছরেও স্বীকৃতি পায়নি ভারত থেকে ট্রেনিং নিয়ে দেশে ফেরার পথে পাক বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে নিহত শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল সরদার ও তার পরিবার। দেশ স্বাধীনের খবরে ভারত থেকে দেশে ফেরার পথে পাকিস্তানি হানাদের হাতে অপহৃত কিশোরী কন্যা ও তাকে উদ্ধারে ব্যার্থ ভাইয়ের গুলিবিদ্ধ হওয়ার বেদনা বয়ে বেড়াচ্ছেন তার বিধবা বয়োবৃদ্ধা স্ত্রী জোহুরা বেগম।

যুদ্ধকালীন নির্মম বিয়োগান্তক ঘটনার স্বাক্ষী জোহুরা বেগমের করুণ আর্তি, জীবনের পড়ন্ত বেলায় স্বামীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি চোখে দেখে যেতে চান।

কান্নাজড়িত কন্ঠে কথা হয় পূর্বপশ্চিমবিডি’র খুলনা জেলা প্রতিনিধি শেখ নাদীর শাহ্’র সাথে। যুদ্ধকালীন বলা না বলা কথা বর্ণনা দিতে গিয়ে বার বার মূর্ছা যাচ্ছিলেন এ শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পত্নী।

১৯৭১ সাল। চারিদিকে শুরু হয়ে গেছে মুক্তিকামী মানুষের সাথে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের দোসরদের তুমুল লড়াই। গোটা দেশ যেন রণক্ষেত্র। সেদিন মুক্তিকামী অন্যদের সাথে বসে থাকতে পারেননি সাতক্ষীরার তালা উপজেলার খলিলনগর ইউনিয়নের মহন্দীর নিভৃত পল্লীর মৃত কাতার আলী সরদার পুত্র আব্দুল সরদার। তিনিও স্বাধীনতাকামী মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে ট্রেনিং নিতে চলে যান ভারতে।

সেখান থেকে ট্রেনিং নিয়ে দেশে ফেরার পথে সাতক্ষীরার বিনেরপোতা এলাকায় পৌছালে পাকিস্তানি সেনারা অন্যদের সাথে তাকেও ধরে নির্মম নির্যাতন শেষে নিয়ে যায় যশোর ক্যান্টনমেন্টে। সেখান থেকে জিজ্ঞাসাবাদ ও অমানবিক নির্যাতন শেষে অন্যদের পাশাপাশি তাকেও খুলনার গল্লামারী নিয়ে হত্যা করা হয়।

এদিকে স্বামীর মুক্তিযোদ্ধা এমন খবরে স্বাধীনতা বিরোধীরা তাদের বাড়িতে হামলাসহ শুরু করে চরম অমানবিক নির্যাতন। অগ্নিসংযোগ করে তাদের বসত-বাড়িতে। এক পর্যায়ে নিরুপায় হয়ে তার স্ত্রী জোহুরা ২ ছেলে আজগর, রহমত ও ৪ মেয়ে আছিয়া, রশিদা, সুফিয়া ও সাহিদাকে নিয়ে ভারতে পাড়ি জমান। সেখানে আশ্রয়নেন শরনার্থী শিবিরে। সেখানে অবস্থানকালীন কিছু দিন পর লোক মারফত শিবিরে থেকেই খবর পান তার স্বামী পাকিস্তানীদের হাতে ধরা পড়েছে।

এরপর সেখান থেকে সন্তানদের নিয়ে বেনাপোল বন্দর হয়ে সাতক্ষীরার উপর দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে তারাও ধরা পড়ে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে। এসময় পাকিস্তানি সেনারা তার কাছ থেকে সুন্দরী কিশোরী মেয়ে সুফিয়াকে ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় তার ছেলে আজগরকে লক্ষ্য করে গুলি করে। এতে একটি গুলি তার হাত ও আরেকটি তার মাজার মাংসপেশী বিদীর্ণ করে চলে যায়। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সে। মূমুর্ষূ অবস্থায় সকলে যখন তাকে নিয়ে ব্যাস্ত ততক্ষণে সুফিয়াকে নিয়ে হায়েনারা চলে যায়। এরপর থেকে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। হয়তো তাদের পাশবিক নির্যাতনে এক সময় সেও মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে।

এরপর দেশ স্বাধীনের বছর খানেক পর জোহুরা ও তার সন্তানরা লোক মারফত নিশ্চিত হয় তাদের বাবা ভারত থেকে ট্রেনিং নিয়ে দেশে ফেরার পথে ধরা পড়ে শহীদ হন। এরপর দেশ স্বাধীনের গত ৫১ বছরেও তাদের খোঁজ রাখেনি কোন সরকার। খবর নেয়নি মুক্তিযোদ্ধা কিংবা সংগঠনের কেউ।

আব্দুল সরদারের নাতনী পাইকগাছার কাশিমনগর এলাকার বাসিন্দা লিলিমা খাতুন পূর্বপশ্চিমবিডি’কে বলেন, শৈশব থেকে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধে তার নানা, খালা-মামাদের উপর ঘটে যাওয়া নির্মম কাহিনী শুনতে শুনতেই বড় হয়েছেন। গল্প শুনে যুদ্ধকালীন ঘটনার বর্ণনাই তার মুখস্ত হয়ে গেছে। নানী, মা, মামা খালাদের পাশাপাশি তারও দাবি মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাঁথায় আঁচড় পড়ুক তার নানা ও খালার নাম দুটিও।

তিনি আরও বলেন, বীরঙ্গনা কাকে বলে ঠিক জানিনা। তবে যুদ্ধকালীন সর্বহারা নারীকে বীরঙ্গনার মুকুট দিলে তার খালা সুফিয়াও যুদ্ধজয়ে এক বুক কষ্ঠ ও রক্ত দিয়ে লিখে গেছেন স্বাধীন বাংলাদেশের নাম।

তিনি বলেন, তার নানী (জোহুরা বেগম) নানার মৃত্যু খবর শোনার পর থেকে কারও সাঙ্গে খুব বেশী কথা বলেননা। তবে মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনলে এখনও আৎকে উঠেন। স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসে দূরপানে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকেন। আর চোখের পানি ফেলেন। হয়তো স্বামীর বীরত্বগাঁথায় নিজেকে গর্বিত অনুভব করে চোখের পানিতেই কষ্ঠ নিবারণ করেন তিনি।

জোহুরা বেগম জানান, স্বাধীনতার অনেক বছর পর্যন্ত স্বামীর পথপানে চেয়ে দিন কাটত তার। বিশ্বাস ছিল, হয়তবা তিনি এখনো বেঁচে রয়েছেন। ফিরে আসবেন স্ত্রী-সন্তানদের কাছে আপন ঠিকানায়। তবে বছরের পর বছর কেটে যাওয়ায় এখন নিজেকে কোন রকম বিশ্বাস করিয়েছেন বেঁচে নেই সে। বলতেই ফের চোখ ভিজে তার।

উচ্চস্বরে তিনি বলে উঠেন, তাদের স্বামীদের মৃত্যু হয়না, মরতে নেই ওদের। নিখোঁজ শহীদ আব্দুল সরদারের প্রথম পক্ষের বড় ছেলে আবুল কাশেমকে স্বাধীনতার পর চায়ের সাথে বিষক্রিয়ায় হত্যা করা হয়। আর জোহুরার ২ ছেলে আজগর ও রহমত সরদারদের জীবিকা নির্বাহ হয় ভ্যান চালিয়ে। পূর্বপশ্চিমবিডি/এসএনএস/জেএস

খুলনা,মুক্তিযোদ্ধা

সারাদেশ

অনুসন্ধান করুন
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close