• শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

নান্দনিক স্বজ্জায় খুলনায় দূর্গাপূজা পালিত হচ্ছে

প্রকাশ:  ২২ অক্টোবর ২০২৩, ২০:২৪
শেখ নাদীর শাহ্,খুলনা প্রতিনিধি

সুন্দরবন উপকূলীয় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জনপদে প্রসিদ্ধ ইতিহাস আর ঐতিহ্যের লীলাভূমি খুলনার পাইকগাছা উপজেলার কপিলমুনিতে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব দূর্গাপূজা বরাবরের মত এবারও সার্বজনীন দূর্গোৎসবে পরিণত হয়েছে। দূর্গোৎসব মূলত সনাতনীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব হলেও সম্প্রীতির জনপদে বরাবরই পর্বনপ্রিয় বাঙালির উৎসব হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।

আর এ-উৎসবে বরাবরের মত সনাতনীরা মন্ডপে মন্ডপে দল বেঁধে প্রতীমা পরিদর্শন ও ধর্মীয় রীতি-নীতি অনুসরণ করলেও ভিন্ন ধর্মালম্বীরাও মেতেছে সম্প্রীতির উৎসবে। ভিন্ন ধর্মাবলম্বী মেয়েরাও দূর্গোৎসবে পূজার আনন্দ ভাগাভাগি করতে আসেন পিত্রালয়ে। জনপদের এ রেওয়াজ দীর্ঘ দিনের। এ যেন ধর্ম যার যার উৎসব সবার মত অবস্থা। আর দূর্গোৎসবকে কেন্দ্র করে কপিলমুনিও সেজেছে ভিন্নরুপে।

উপজেলার ১০ টি ইউনিয়ন ও ১ টি পৌরসভায় মোট ১৫৫টি মন্ডপে দূর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হলেও শুধুমাত্র কপিলমুনিতে ১৯ টি মন্ডপে পূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এরমধ্যে সদরের মন্ডপগুলোকে সাজানো হয়েছে নানন্দনিক সাজে। ব্যাতিক্রমী তোরণের পাশাপাশি মূল পূজার সাথে আয়োজনেও রয়েছে ভিন্নতা। এরমধ্যে প্রায় শত বছরের ঐতিহহ্যবাহী কপিলমুনি পূর্বপাড়া হরিসভা পূজা মন্দিরের প্যান্ডেল সাজানো হয়েছে ভারতের বেলুর মঠের আদলে। অন্যদিকে কপিলমুনি মিলন মন্দির সার্বজনীন কেন্দ্রীয় পূজা মন্ডপটিতে আধুনিক সাজস্বজ্জার পাশাপাশি আয়োজন করা হয়েছে আধুনিক কপিলমুনির রুপকার স্বর্গীয় রায় সাহেব বিনোদ বিহারী সাধুর জীবন চিত্রের উপর ভস্কর্য নিয়ে।

মিলন মন্দির সার্বজনীন প্রগতি সংঘের পক্ষে এবারও সেখানে বর্ণাঢ্য আয়োজন রয়েছে। যার মধ্যে শারদীয় মায়ের নান্দনিক প্রতীমা নির্মাণের পাশাপাশি দর্শনার্থীরে কাছে বিশেষভাবে মন ছুঁয়েছে রায় সাহেবের ভাস্কর্যের সমাহার। ধারণা করা হচ্ছে, এবার জেলার শ্রেষ্ট প্রতীমার মর্যাদা প্রাপ্তির পাশাপাশি ভাষ্কর্যগুলি দেখে সাধারণের মধ্যে রায় সাহেব বিনোদ বিহারী সাধু সম্পর্কে জানতে ও কৌতুহলী করতে আরও বেশি অনুপ্রাণিত করবে।

মূল আরাধ্য প্রতীমার পাশাপাশি ভাস্কর্যের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে, রায় সাহেবের গোটা জীবন চক্র। যেখানে রায় সাহেব বিনোদ বিহারী সাধু ছিলেন, জনপদের অন্যতম শিক্ষানুরাগী। জন্মস্থান কপিলমুনি থেকে প্রতিদিন পায়ে হেঁটে প্রায় ৭কি:মি: দূরে কপোতাক্ষ নদ পেরিয়ে বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানী স্যার আচার্য পিসি রায় প্রতিষ্ঠিত রাড়ুলী আর.কে.বি.কে হরিশচন্দ্র ইনস্টিটিউটে অধ্যায়নে যেতেন। তিনি স্যার পিসির রায়ের আশীর্বাদপুষ্ট শিক্ষার্থী ছিলেন।

ভাস্কর্যের মাধ্যমে বিনোদের শিক্ষাজীবনের একটি খন্ড চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। যেখানে স্যার পিসি রায়কে প্রণাম করতে দেখা যাচ্ছে শৈশবের ক্ষুদে শিক্ষার্থী বিনোদকে।

শৈশবে স্কুলের পাঠ শেষ না করেই বিনোদ তার বাবার হাত ধরে ব্যবসা জীবনে পদার্পণ করেন। ব্যবসায়ীক দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে গিয়ে ক্রেতা সন্তুষ্টি অর্জনে তিনি বিভিন্ন সময় নানা কৌশলের আশ্রয় নিতেন। কেরোসিনের ব্যবসায় তৎকালীণ ক্রেতাদের হারিকেন ও কুপি (টেমি বা লম্প) জন্য বিনামূল্যে সলতে বিতরণ করতেন। ব্যবসা জীবনে এমন নানা ঘটনার জন্ম দিয়ে সফলতার স্বাক্ষর রাখেন। ভাস্কর্যে বিনোদের ব্যবসা জীবনের চিত্র তুলে ধরতে দু’জন ক্রেতাসহ তাকে দেখা যাচ্ছে কেরোসিন বিক্রি করতে।

রায় সাহেব বিনোদ বিহারী সাধু ছিলেন, কপিলেশ্বরী মায়ের আশীর্বাদপুষ্ট। আধুনিক কপিলমুনির রুপকার ছিলেন তিনি। জনপদের ব্যবসা-বা্িয সম্প্রসারণে নিজ নামে প্রতিষ্ঠা করেন বিনোদগঞ্জ। জনশ্রুতি রয়েছে, একবার বারুণী মেলায় আগত শাঁখারি হতে বিনোদের কণ্যার রুপ ধরে বাকিতে শাঁখা পরে বাবা বিনোদের কাছ থেকে টাকা নিতে বলেন। বিনোদকে পেয়ে মেয়ের বাকিতে কেনা শাঁখার টাকা চাইতেই বিনোদ কিঞ্চিত বিলম্ব করে টাকা পরিশোধ করে চলে যান কপিলেশ্বরী কালী মন্দিরে। সেখানে গিয়ে দেখেন মায়ের হাতে শাঁখা। তখন তার বুঝতে বাকি ছিলনা, শাখা নিতে সেই গিয়েছিল শাঁখারির কাছে। ভাস্কর্যে তাই শাঁখারির হাত থেকে কপিলেশ্বরী মায়ের শাঁখা পরা ও পিতা রূপে বিনোদকে তুলে ধরা হয়েছে।

এভাবে ক্ষণজন্মা বিনোদ ক্রমান্বয়ে একদিন হয়ে ওঠেন, রায় সাহেব বিনোদ বিহারী সাধু হিসেবে। নানা কীর্তিগাঁথায় ব্রিটিশ সরকার তাকে এ উপাধিতে ভূষিত করে সম্মাননা প্রদান করেন।

পূজায় মূল ধর্মীয় আচার ও রীতি ছাড়াও আয়োজন করা হয়েছে, উপমহাদেশের ক্ষাতিমান যাদুশিল্পী যাদুসূর্য পিসি সাহার নিয়মিত যাদু প্রদর্শনী ও মনোজ্ঞ সঙ্গীতানুষ্ঠান।

এব্যাপারে মিলন মন্দির, মিলন মন্দির প্রগতি সংঘ তথা আজকের আয়োজনের অন্যতম ছাঁয়া সূতিকাগার তরুণ ব্যবসায়ী বিপ্লব সাধু বলছিলেন, জনপদে কবে কখন থেকে সনাতনীদের বসবাস শুরু তার সঠিক ইতিহাস জানা না গেলেও দ্বাপর যুগে কপিলদেবের তপধ্যানে সিদ্ধিলাভের সময়ও জনপদে সনাতনীদের বসবাস ও ধর্মীয় পূজা-অর্চনার স্বাক্ষরবহন করে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জনপদে এবারও কোন প্রকার অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই দূর্গোৎসব সার্বজনীন বাঙালির উৎসব হিসেবে উদযাপিত হচ্ছে। মূল পূজার পাশাপাশি রায় সাহেব বিনোদ বিহারী সাধুর ভাস্কর্য দর্শনার্থীদের ভিন্নভাবে নাড়া দিয়েছে। আগামীতে আরও ভাল ও উৎসব মূখর আয়োজনের প্রত্যয় ব্যক্ত করে তিনি দর্শনার্থী-পূজারীদের পাশাপাশি সকলকে উৎসবে শান্তিপূর্ণ সামিল হওয়ার আহ্বান জানিয়ে মিলন মন্দির, মিলন মন্দির প্রগতি সংঘ, শিল্পী, কলা-কূশলীসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে কৃতজ্ঞতা, শুভকামনাসহ দীর্ঘায়ু কামনা করেন।

এব্যাপারে কাশিমনগর ওয়ার্ড সদস্য শেখ রবিউল ইসলামও কোন প্রকার অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই শান্তিপূর্ণ দূর্গোৎসব উদযাপনের কথা বলেন।

কপিলমুনি পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পুলিশ পরিদর্শক মো: জাহাঙ্গীর আলম বলেন, তার কপিলমুনি এলাকায় মোট ১৯ টি মন্ডপে এবার উৎসবমূখর পরিবেশে শারদীয় দূগাপূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এখন পর্যন্ত কোন প্রকার অপ্রীতিকর ঘটনার খবর নেই। আশা করছেন, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে বরাবরের ন্যায় কপিলমুনিতে দূর্গাপূজা সম্পন্ন হবে।

দূর্গাপূজা

সারাদেশ

অনুসন্ধান করুন
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close