• সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

উৎপাদন নেই ৪২ মাস, নয় পাটকলের পেছনে সরকারের খরচ ১৮৮ কোটি

প্রকাশ:  ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ২৩:১৫
পূর্বপশ্চিম ডেস্ক

ফটক বন্ধ, তালাবদ্ধ গোডাউন। গেট পেরিয়ে সীমানা প্রাচীরের ভেতরে কেবলই সুনসান নীরবতা। ভেতরে পড়ে আছে মরচে ধরা যন্ত্রপাতি। বাংলাদেশ পাটকল কর্পোরেশনের (বিজেএমসি) আওতাধীন খুলনা-যশোর অঞ্চলের মিলগুলোর বর্তমান চিত্র এমনই। অথচ, একসময় শ্রমিকদের কর্মব্যস্ততা ও যন্ত্রপাতির শব্দে মুখর থাকত এই কারখানাগুলো। সাড়ে তিন বছরে বন্ধ মিল রক্ষণাবেক্ষণে বিজেএমসির সর্বমোট খরচ ১৮৮ কোটি ৪২ লাখ ৪৬ টাকা।

সবশেষ ২০২০ সালের ৩০ জুন এসব পাটকলে ঘণ্টা বেজেছে। সাধারণত পাটকলগুলোতে কাজের শুরু, শেষ ও বিরতির সময় জানান দেওয়া হয় ঘণ্টা বাজিয়ে।

খুলনা-যশোর অঞ্চলের ৯টি সরকারি পাটকল কার্যত বন্ধ সাড়ে তিন বছরের বেশি সময় ধরে। কারখানাগুলোর বর্তমান কর্মী সংখ্যা ৯৬১ জন। কাজ না থাকলেও সরকার তাদের বেতন-ভাতা দিচ্ছে নিয়মিত। সঙ্গে রয়েছে রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়। ফলে এসব খাতে গচ্চা যাচ্ছে রাষ্ট্রের বড় অঙ্কের অর্থ। এভাবে বসিয়ে বসিয়ে বেতন-ভাতা দেওয়াকে অযৌক্তিক মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

মাসে এসব পাটকলের রক্ষণাবেক্ষণে কয়েক কোটি টাকা ব্যয় হয়। তবে, মিলের ভেতর থেকে যন্ত্রপাতি চুরির ঘটনা ঘটছে বলে অভিযোগ রয়েছে। পাশাপাশি পরিত্যক্ত অবস্থায় মূল্যবান যন্ত্রপাতি নষ্ট হচ্ছে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন খুলনার সভাপতি অ্যাডভোকেট কুদরত ই খুদা বলেন, “মিল পাহারার নামে রাষ্ট্রের বিপুল অঙ্কের অর্থ ব্যয় হলেও সুরক্ষা মেলেনি রাষ্ট্রীয় সম্পদের। চোর-পাহারাদার যোগসাজশে মিলের মূল্যবান যন্ত্রপাতি লোপাট হচ্ছে।”

প্লাটিনাম জুবলী জুট মিলের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির খান ও দৌলতপুর জুটমিল শ্রমিক ইউনিয়নের সদস্য আবুল কাশেম খোকন বলেন, “শ্রমিকবিহীন পাটকলগুলোতে বিজেএমসির বিশাল জনবল অলস বসিয়ে বেতন দেওয়া অযৌক্তিক।”

বিজেএমসি সূত্রে জানা গেছে, সবমিলিয়ে গত ৪২ মাসে এসব পাটকল রক্ষণাবেক্ষণে বাংলাদেশ পাটকল কর্পোরেশনের (বিজেএমসি) ব্যয় হয়েছে ১৮৮ কোটি ৪২ লাখ ৪৬ টাকা। যার মধ্যে বেতন-ভাতায় ব্যয় হয়েছে ১৫৫ কোটি টাকা। এছাড়া বিদ্যুৎ ও কর্মকর্তাদের যানবাহনের জ্বালানি ব্যয় ৩২ কোটি ৮২ লাখ টাকা।

কোন মিলে কতজন খুলনা-যশোর অঞ্চলের বন্ধ ৯টি পাটকলে মোট ৩৬০ জন কর্মকর্তা ও ৬০১ জন কর্মচারী রয়েছেন।

এর মধ্যে আলীম জুট মিলে ২০ জন কর্মকর্তা ও ২৪ জন কর্মচারী,

কার্পেটিং জুট মিলে ৪২ কর্মকর্তা ও ২১ জন কর্মচারী,

ক্রিসেন্টে ৭৫ কর্মকর্তা ও ১০২ জন কর্মচারী,

দৌলতপুর জুট মিলে ২১ কর্মকর্তা ও ৪৯ জন কর্মচারী,

ইস্টার্ন জুট মিলে ২৩ কর্মকর্তা ও ৫৫ জন কর্মচারী,

খালিশপুর জুট মিলে ৪৪ কর্মকর্তা ও ১০২ জন কর্মচারী,

যশোর জুট ইন্ডাস্ট্রিজে (জেজেআই) ৩৭ কর্মকর্তা ও ৬৫ জন কর্মচারী,

প্লাটিনাম জুট মিলে ৫৮ কর্মকর্তা ও ১০২ জন কর্মচারী এবং

স্টার জুট মিলে ৪০ কর্মকর্তা ও ৮১ জন কর্মচারী কাগজে-কলমে কর্মরত।

তাদের পেছনে মাসে সরকারের ব্যয় ৪ কোটি ৪৮ লাখ ৬৩ হাজার টাকা। এর মধ্যে বেতন-ভাতায় ৩ কোটি ৭০ লাখ ৪৭ হাজার টাকা, বিদ্যুৎ বিলে ২১ লাখ ৭৬ হাজার টাকা, জ্বালানিতে ১ লাখ ৬২ হাজার টাকা ও অন্যান্য খাতে ৫৪ লাখ ৭৮ হাজার টাকা ব্যয় হয়।

কার ব্যয় কতটুকু আলীম জুট মিলের মাসিক খরচ ২২ লাখ ৬৬ হাজার টাকা। এর মধ্যে বেতন-ভাতায় ১৭ লাখ ৬৬ হাজার টাকা, বিদ্যুৎ বিলে ১ লাখ ৪ হাজার টাকা, জ্বালানিতে ১২,০০০ টাকা ও অন্যান্য খরচ ৩ লাখ ৮৪ হাজার টাকা।

কার্পেটিং জুট মিলের মোট মাসিক ব্যয় ২৮ লাখ ১২ হাজার টাকা। এর মধ্যে বেতন-ভাতায় ২৩ লাখ ১০ হাজার টাকা, বিদ্যুৎ বিলে ৬৫,০০০ টাকা, জ্বালানিতে ১৫,০০০ টাকা ও অন্যান্য খাতে ব্যয় ৪ লাখ ২২ হাজার টাকা।

ক্রিসেন্ট জুট মিলে মোট মাসিক ব্যয় ৮৩ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। এর মধ্যে বেতন-ভাতায় ৭৪ লাখ ৮৩ হাজার টাকা, বিদ্যুৎ বিলে ৪ লাখ ৬০ হাজার টাকা, জ্বালানিতে ২২,০০০ টাকা ও অন্যান্য খাতে ৪ লাখ টাকা।

দৌলতপুর জুট মিলের মোট খরচ ২৮ লাখ ৭ হাজার টাকা। এর মধ্যে বেতন-ভাতায় ২৩ লাখ ২ হাজার টাকা, বিদ্যুৎ বিলে ১ লাখ ৫৮ হাজার টাকা, জ্বালানিতে ১০,০০০ টাকা ও অন্যান্য খাতে ব্যয় ৩ লাখ ৩৭ হাজার টাকা।

ইস্টার্ন জুট মিলের মোট খরচ ৪০ লাখ ৪৮ হাজার টাকা। এর মধ্যে বেতন-ভাতায় ৩০ লাখ ২২ হাজার টাকা, বিদ্যুৎ বিলে ১ লাখ ৪১ হাজার টাকা, জ্বালানিতে ১৬,০০০ টাকা ও অন্যান্য ৮ লাখ ৬৯ হাজার টাকা।

খালিশপুর জুট মিলের মোট খরচ ৭৫ লাখ ৭৭ হাজার টাকা। এর মধ্যে বেতন-ভাতায় ৫৯ লাখ ৬০ হাজার টাকা, বিদ্যুৎ বিলে ৪ লাখ ৫২ হাজার টাকা, জ্বালানিতে ১৭,০০০ টাকা ও অন্যান্য খাতে ১১ লাখ ৪৮ হাজার টাকা।

জেজেআই’র মোট খরচ মাসে ৪৯ লাখ ৯৮ হাজার টাকা। এর মধ্যে বেতন-ভাতায় ৩৯ লাখ ২৬ হাজার টাকা, বিদ্যুৎ বিলে ২ লাখ ১৯ হাজার টাকা, জ্বালানিতে ১৪,০০০ টাকা ও অন্যান্য খাতে ৮ লাখ ৩৯ হাজার টাকা।

প্লাটিনাম জুট মিলের মোট খরচ ৬৯ লাখ ৫৫ হাজার টাকা। এর মধ্যে বেতন-ভাতায় ৬০ লাখ ৫৮ হাজার টাকা, বিদ্যুৎ বিলে ৩ লাখ ৯৬ হাজার টাকা, জ্বালানিতে ২০,০০০ টাকা ও অন্যান্য খাতে ৪ লাখ ৮১ হাজার টাকা।

মাসে স্টার জুট মিলের মোট খরচ ৫০ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। এর মধ্যে বেতন-ভাতায় ৪২ লাখ ২০ হাজার টাকা, বিদ্যুৎ বিলে ১ লাখ ৮১ হাজার টাকা, জ্বালানিতে ৩৬,০০০ টাকা ও অন্যান্য খাতে ৫ লাখ ৯৮ হাজার টাকা।

বকেয়া নেই, স্বাচ্ছন্দ্যে কর্মীরা দৌলতপুর জুট মিলের নিরাপত্তাকর্মী আক্তার হোসেন জানান, তার কোনো বেতন বকেয়া নেই। বেতন নিয়মিত পাওয়ায় সংসার চলছে স্বাচ্ছন্দ্যে।

প্লাটিনাম জুট মিলের নিরাপত্তাকর্মী জোহরা খানম লায়লা জানান, তিনি পরিত্যক্ত ভবনের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত। এখানে পরিত্যক্ত দুটি ভবনে নিরাপত্তাকর্মীরা ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছেন।

উপরন্তু তার অভিযোগ, “আবাসিক ভবনগুলো মেরামত করা হচ্ছে না। ফলে পলেস্তারা ও ইট খসে খসে পড়ছে।”

প্লাটিনামের আরেক নিরাপত্তাকর্মী রফিকুল ইসলাম বলেন, “নিরাপত্তাকর্মীদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করা জরুরি। অন্যথায় মিলের চুরি বন্ধ করা যাবে না। মেশিনরুমগুলো সিলগালা করা রয়েছে। সেখানে যন্ত্রপাতি কী অবস্থায় আছে তা দেখার সুযোগ নেই।”

তবে পাটকলগুলোর পেছনে ব্যয়কে অযৌক্তিক বলে মনে করছেন না বিজেএমসির খুলনা জোনাল সমন্বয়কারী গোলাম রব্বানী।

তিনি বলেন, “বন্ধ মিলের হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ রক্ষায় কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কাজ করছে। তাই তাদের বেতন নিয়মিত রাখছে সরকার। এখানে অযৌক্তিক কোনো খরচ হচ্ছে না।”

যশোর,খুলনা,বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন,পাট

সারাদেশ

অনুসন্ধান করুন
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close