• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলেছে আমাদের বই মেলার

প্রকাশ:  ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০৬ | আপডেট : ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:৪২
নিজস্ব প্রতিবেদক

যতদূর জানা যায়, ১৯৭২ সনের ৮ ফেব্রুয়ারি তারিখে মুক্তধারা প্রকাশনীর সত্ত্বাধিকারী চিত্তরঞ্জন সাহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বর্ধমান হাউজ প্রাঙ্গণে বটতলায় এক টুকরো চটের ওপর কলকাতা থেকে আনা ৩২টি বই সাজিয়ে বইমেলার গোড়াপত্তন করেন। এই বইগুলো স্বাধীন বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের প্রথম অবদান। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি একাই বইমেলা চালিয়ে যান। ১৯৭৮ সনে বাংলা একাডেমীর তৎকালীন মহাপরিচালক আশরাফ সিদ্দিকী বাংলা একাডেমীকে মেলার সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত করেন। পরের বছর ১৯৭৯ সনে মেলার সাথে যুক্ত হয় বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি; এই সংস্থাটিও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন চিত্তরঞ্জন সাহা। ১৯৮৩ সালে কাজী মনজুরে মওলা বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে বাংলা একাডেমিতে প্রথম "অমর একুশে গ্রন্থমেলা"র আয়োজন সম্পন্ন করেন। কিন্তু স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে শিক্ষা ভবনের সামনে ছাত্রদের বিক্ষোভ মিছিলে ট্রাক তুলে দিলে দুজন ছাত্র নিহত হয়। ওই মর্মান্তিক ঘটনার পর সেই বছর আর বইমেলা করা সম্ভব হয়নি। ১৯৮৪ সালে সাড়ম্বরে বর্তমানের অমর একুশে গ্রন্থমেলার সূচনা হয়।

সেই থেকে বইমেলার সাথে আমার পরিচয়। সেই ৩২টি বইয়ের ক্ষুদ্র মেলা কালানুক্রমে বাঙালির সবচেয়ে স্বনামধন্য বইমেলায় পরিণত হয়ে ওঠে। আগে যেখানে দেশের মানুষ গল্প, সাহিত্য, উপন্যাস আর কবিতা বলতে পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের ওপর নির্ভরশীল ছিল, সেখানে এই বইমেলার সুবাদে আমাদের দেশীয় লেখকদের লেখা পাঠকদের কাছে জনপ্রিয় হতে শুরু করে। বিশেষ করে আশির দশকের শেষে ও পুরো নব্বই দশক জুড়ে আমাদের পাঠকদেরকে নিজেদের বই এর প্রতি অনুরাগী হিসেবে গড়ে তুলতে যাদের অবদান গুরুত্বপূর্ণ তাদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক ছিলেন প্রয়াত হুমায়ুন আহমেদ। এক নিমিষে নিঃশেষ হয়ে যেতো তার লেখার যাবতীয় সংস্করণ। এ সময় তরুণদের কাছে আরেক জনপ্রিয় নাম ছিল কথা সাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন। উপন্যাসিক হিসেবে আরও জনপ্রিয় ছিলেন শওকত ওসমান, হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শওকত আলী, রাহাত খান, মইনুল হোসেন সাবের, আবুল খায়ের মুসলেহ উদ্দীন, রাবেয়া খাতুন, সেলিনা হোসেন, আলাউদ্দিন আল আজাদ, হুমায়ুন আজাদ, আহমদ ছফা, রাজীব হুমায়ুন, নাসরীন জাহান প্রমুখ। শাহাদুজ্জামান, আনিসুল হক, দীপু মাহমুদ, সুমন্ত আসলাম, গোলাম মোস্তফা এরাও পরবর্তী প্রজন্মের ভালো লেখক হিসেবে নিজেদেরকে উপস্থাপন করতে সমর্থ হয়। এ সময় বিজ্ঞানমনস্ক লেখক হিসেবে হুমায়ুন আহমেদের অনুজ মুহম্মদ জাফর ইকবাল শিশু-কিশোরদের কাছে খুবই জনপ্রিয় একজন লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান।

এ সময়টা ছিল প্রেম, বিরহ ও বিদ্রোহ নিয়ে নিয়ে রচিত কবিদের শ্রেষ্ঠ যুগ। শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, আল মাহমুদ, রফিক আজাদ, হুমায়ুন আজাদ, আসাদ চৌধুরী, নির্মলেন্দু গুণ, নুরুল হুদা, খন্দকার আশরাফ হোসেন, সিকদার আমিনুল হক, হেলাল হাফিজ, মহাদেব সাহা, তসলিমা নাসরীন, ত্রিদিব দস্তিদার, আবুল হুসেন, মোহন রায়হান, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, অসীম সাহা, সমুদ্র সেন গুপ্ত, রেজাউদ্দিন স্ট্যালিন প্রমুখ কবিগণের কবিতার বই এর যেমন খুব কদর ছিল, আবার ছড়াকার হিসেবে অন্নদাশঙ্কর রায়, রোকনুজ্জামান খান, শামসুর রাহমান, সুকুমার বড়ুয়া, লুৎফর রহমান রিটন, আমীরুল ইসলাম, সারওয়ার উল আলম, সেজান মাহমুদ, ওবায়দুল গণি চন্দন প্রমুখ ছড়াকাররাও তাদের ছন্দময় লেখা লিখে লাইমলাইটে চলে আসে।

এ সময় একুশের বইমেলা উপলক্ষে উল্লেখিত কবিদের কবিতা আবৃত্তির অডিও ক্যাসেট বের করে বিখ্যাত আবৃত্তি শিল্পীর মর্যাদা লাভ করেছিলেন জয়ন্ত চট্রপাধ্যায়, মৈত্রীয় চট্রপাধ্যায়, আসাদুজ্জামান নূর, আশরাফুল আলম, ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, কামরুল হাসান মঞ্জু, পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়, কেয়া চৌধুরী, শফি কামাল, কামরুল হাসান মঞ্জু, প্রজ্ঞা লাবনী, কাজী আরিফ, ইস্তেকবাল হোসেন, রুপা চক্রবর্তী, শিমুল মুস্তফা, টনি ডায়াস, হাসান আরিফ, মেহেদী হাসান, মাহিদুল ইসলাম মাহি, শারমিন লাকী, আহকাম উল্লাহ প্রমুখ। তবে বইমেলায় গবেষণাধর্মী, বিশ্বসেরা বইগুলোর অনুদিত বা রুপান্তরিত সংস্করণ, বিদেশী ভাষা-ভাষীর বই এর অনুপস্থিতি এই মেলাকে কখনোই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীত করতে পারেনি!

একুশের বইমেলা ক্রমশ জনপ্রিয় ও জাতীয় একটি উৎসবে পরিণত হওয়ায় প্রতি বছর মেলায় ভিড় বাড়তেই থাকে। তাই বাংলা একাডেমী চত্বরে স্থান সংকুলান না-হওয়ায় ২০১৪ সন থেকে বইমেলা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্প্রসারিত করা হয়। এরপর থেকে লেখক, প্রকাশক ও দর্শনার্থীর সংখ্যা বাড়তে থাকলেও বইমেলা যেন তার ইতিপূর্বেকার সুখ্যাতি ক্রমাগত হারাতে থাকে। কারণটা অবশ্য বহুবিধ।

বইমেলাকে গণমাধ্যমে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে অবদান রাখা একজন প্রবাসী সাংবাদিক সম্প্রতি তার একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন - "আমাদের যাবতীয় বাঙালিয়ানা, চেতনা, প্রাণ, সংস্কৃতি ঐতিহ্যের দায় হঠাৎ করেই বইয়ের ঘাড়ে ফেলে দেয়া হয়েছে। শুধুমাত্র বইকে ঘিরে যে মেলা হতে পারতো সেখানে আরো নানান অনুষঙ্গ যুক্ত করে বইকে তার নিজের ঘরেই দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক করে রাখা হয়েছে। বই পাঠে উৎসাহের চেয়ে বর্ণমালা প্রেমই যেখানে মুখ্য, একটি ভাল বইয়ের চেয়ে একটি দলবাজি মার্কা বই-ই যেখানে প্রণিধানযোগ্য, ভিন্নমতের লেখক ও প্রকাশকদের যখন মেলায় নিষিদ্ধ করা হয় তখন বইমেলা আর বইমেলা থাকেনা। হয়ে যায় ক্ষমতাধরদেরই একটি সাংস্কৃতিক শাখা। শাসক দলের কিংবা আরো ব্যাপকভাবে যদি বলি, আমাদের সংস্কৃতি, কৃষ্টি, চেতনা কেন বইমেলার ঘাড়ে চেপে বসবে? কেন আবাসন মেলার ক্ষেত্রে নয়? কিংবা বাণিজ্য মেলা, পোশাক মেলা, প্রযুক্তি মেলা, কৃষি মেলার ক্ষেত্রে এসব দায় চাপিয়ে দেয়া হয়না? বই থেকে যখন মুখ্য হয়ে ওঠে অন্য প্রসঙ্গ, অন্য আবেগ, অন্য অহং তখন বইমেলা চরিত্র হারায়। বইমেলায় সবাই ঘুরতে যায়, বই কিনতে খুব কমই মানুষ যায়। যে কারণে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বিশাল জায়গাজুড়ে, এবং মাসব্যাপী আয়োজিত এই বিশাল মেলায় বই বিক্রির পরিমাণ একশো কোটি টাকারও কম। অথচ নতুন বই নাকি বের হয় পাঁচ সহস্রাধিক। পুরানো বই তো রয়েছেই। প্রকাশকও ছয়শোর বেশি অংশ নেয় বইমেলায়।

প্রকাশক হয়ে স্টল পাবার জন্য একটি ট্রেড লাইসেন্সই যথেষ্ট। এই এতো প্রকাশকের ভিড়ে মানের প্রকাশক কয়জন? কয়টি প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব মনোনয়ন বোর্ড রয়েছে? সম্পাদনা করার কমিটি রয়েছে? আসল-নকল বিচার করার মতো দক্ষ লোকবল রয়েছে? কারোরই নেই। লেখক যা সাপ্লাই করে তা-ই বই আকারে বের হয়। ভুলভাল ছাপা, তথ্যে বিভ্রাট, গুগল অনুবাদিত, বাক্যবিন্যাসে ভুল, বানান ভুল, দুর্বল ভাষা, ভুল ছন্দের কবিতা ও কবিতা নামে অখাদ্য একত্রিত করে বই ছাপিয়ে বিক্রির কসরত চলে। কেউ দেখার নেই।'

অমর একুশে গ্রন্থমেলাকে বাঙালি সংস্কৃতির জাগরণ ও রুচি নির্মাণের উৎসবে রূপ নিয়েছে বলা হলেও এখন আমরা যা দেখতে পাই তা হল মেলায় সবাই বেড়াতে আসে, সেলফি তুলতে আসে, ফাস্টফুড খেতে আসে আর আসে বন্ধুবান্ধব নিয়ে হৈ-হুল্লোড় করতে বা আড্ডা দিতে। বইমেলা দখলে নিয়েছে ভাইরাল মানুষজন কিংবা সোস্যাল মিডিয়ার সেলেব্রেটিরা। বইমেলা মানে মুশতাক-তিশা, বইমেলা মানে টিপু সুলতান, ডাক্তার সাবরিনা, হিরো আলম, জায়েদ খান, ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও তার পিছনে বিশাল কর্মী বাহিনী নিয়ে মেলায় শোডাউন ইত্যাদি। সংবাদ এগুলোই। একটা ভাল বই বা নতুন কোন ভাল লেখক এবং তার কোন লেখা কিন্তু ভাইরাল হয়নি, আলোচনায় আসেনি। এ কেমন বইমেলা?

এই যখন আমাদের কথিত চেতনা ও সংস্কৃতির নামে আয়োজিত উৎসবের মর্মকথা, তখন বইমেলার অর্জন ও প্রাপ্তি নিয়ে ইতিবাচক কিছু ভাবার অবকাশ কোথায়? উচ্ছ্বাস আর প্রাপ্তি দুটি দুই জিনিস। বইমেলা নিয়ে আমাদের অনেক উচ্ছ্বাস, কিন্তু প্রাপ্তিতে ভরাডুবি। আয়োজক বাংলা একাডেমি গতানুগতিক এই মেলা আয়োজন করা ছাড়া বছর জুড়ে আর কি করে এটাও একটি বড় প্রশ্ন!

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ এই লেখাটি বইমেলা নিয়ে লেখা কোন ইতিহাস নয়। বিভিন্ন বছর দেখা বইমেলায় যে সকল কবি, উপন্যাসিক, গল্পকার, ছড়াকারদের লেখা পড়েছি ও যাদের নাম মনে আছে তাদের কথা উল্লেখ করেছি। এক্ষেত্রে জনপ্রিয় কোন নাম বাদ গেলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো।

মনজুর রশীদ লেখক, গবেষক ও উন্নয়নকর্মী

বইমেলা,মনজুর রশীদ,ঐতিহ্য

সারাদেশ

অনুসন্ধান করুন
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close