• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

হঠাৎ তৎপর ড. কামাল

প্রকাশ:  ২১ আগস্ট ২০১৮, ০৫:৫৯ | আপডেট : ২১ আগস্ট ২০১৮, ১৯:১০
বিশেষ প্রতিনিধি

দীর্ঘদিন ধরে দেশের রাজনীতিতে ব্যাক-বেঞ্চে থাকা ড. কামাল হোসেন ইদানিং প্রায়ই সংবাদ শিরোনাম হচ্ছেন। গত এপ্রিলে একাশি বছর পূণ করা আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই আইনজীবীর সাম্প্রতিক রাজনৈতিক তৎপরতা চোখে পড়ার মতোই। বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে রাজনীতিতে আসা ড. কামাল হোসেন এ মুহূর্তে হয়ে ওঠেছেন গদিনশীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার প্রধান কান্ডারি।

গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন সম্পর্কে এতদিন প্রচলিত ছিল, আইনি বিষয়ে তিনি যতোটা সক্রিয় রাজনীতিতে ততোটা নয়। হালে উল্টে গেছে এই চিত্র। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেই তিনি এখন বেশি সময় দিচ্ছেন। জাতীয় নির্বাচনের আগে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যপ্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিতে চান তিনি। আর তাই সমমনা দলগুলোর সংগে নিয়মিত মিটিংয়ে বসছেন, ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার অংশ হিসেবে ভিন্ন মতাদর্শের দলগুলোর সঙ্গেও মতবিনিময় করছেন। সামাজিক সংগঠনগুলোর বিভিন্ন সভা-সেমিনারেও তিনি যোগ দিচ্ছেন। হয়ে ওঠেছেন বর্তমান সরকারের কট্টর সমালোচক।

রাজনীতিতে তৃতীয় শক্তি হয়ে ওঠার মিশনে নামা দলগুলোর কাছেও এখন ড. কামাল হোসেন হয়ে ওঠেছেন গুরুত্বপূর্ণ। বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন বিকল্পধারা, , কাদের সিদ্দিকীর কৃষক-শ্রমিক-জনতা লীগ, মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্য. আ স ম আবদুর রবের জেএসডির সঙ্গে ড. কামাল হোসেনেরে নের্তৃত্বাধীন গণফোরামের ঐক্যজোট গঠন এখন কেবল সময়ের ব্যাপার। সংবিধানের অন্যতম এই প্রণেতা চান, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের বাইরে একটি বৃহৎ রাজনৈতিক ঐক্য। জাতীয় স্বার্থে বিএনপির সঙ্গে সরকারবিরোধী বৃহত্তর ঐক্যজোট গড়ে তুলতে তিনি রাজি আছেন। তকে ঐক্য প্রক্রিয়ার আগে বিএনপিকে তিনটি শর্ত পূরণ করতে হবে। প্রথম শর্তই হলো, জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বিএনপি কোনো জোট গঠন করতে পারবে না। দ্বিতীয় শর্ত হলো, বিএনপিকে তাদের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলন দলীয়ভাবেই এগিয়ে নিতে হবে। তৃতীয় শর্তটি হলো, লন্ডনে অবস্থানরত দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনার দাবিতে জোটগতভাবে কোনো কর্মসূচি দেওয়ার দাবি তোলা যাবে না।

ড. কামালের দেওয়া তিনটি শর্ত নিয়ে আলোচনার চলছে বিএনপির নীতি নির্ধারণ পর্যায়ে। তবে এখন পর্যন্ত কোনো ইতিবাচক সিদ্ধান্ত জানায়নি সংসদের বাইরে থাকা দেশের অন্যতম বৃহত্তম দলটি। বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গঠনের উদ্দেশ্যে এরই মধ্যে বিএনপি নেতাদের সঙ্গে ড. কামাল অনানুষ্ঠানিক বৈঠকও করেছেন বলে জানা গেছে। পাশাপাশি জাতীয় ঐক্য গঠনের জন্য বিকল্প ধারা সভাপতি অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল- জেএসডি আ স ম রবের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছেন ড. কামাল।

এদিকে ঐক্যপ্রক্রিয়ায় ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্ব দেওয়াটা সাদা চোখে দেখছেন না ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। বিএনপিকে আক্রমণের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ নেতারা এখন ড. কামালকে প্রতিপক্ষ করে তার তীব্র সমালোচনায় মেতে ওঠেছেন। গত এক সপ্তাহে আওয়ামী লীগ নেতারা বিএনপিকে আক্রমণ করে যত না বক্তব্য দিয়েছেন; তার চেয়ে বেশি কথা বলছেন গণফোরাম নেতা ড. কামাল হোসেনকে কটাক্ষ করে।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক অভিযোগ করে বলেছেন, ড. কামাল হোসেনরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতকে সঙ্গে নিয়ে সরকার পতনের ষড়যন্ত্র করছেন। ড. কামাল সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহাকে নিয়ে জুডিশিয়াল ক্যু’র চেষ্টাও করেছিল’।

বর্ষিয়ান আইনজীবী কামাল হোসেনের কঠোর সমালোচনা করছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, প্রচার সম্পাদক হাছান মাহমুদ এমনকি ছাত্রলীগ নেতারা। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, দেশে যখন শান্তিময় রাজনৈতিক পরিবেশ বিরাজ করছিল, ঠিক সে সময় ১/১১-এর কুশীলবেরা আবার রাজনৈতিক অঙ্গনে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের অসম্ভব খেলায় মেতে উঠেছে। সবিনয়ে ড. কামাল হোসেনের কাছে আমি জিজ্ঞেস করতে চাই, গুন্ডাতন্ত্র কাকে বলে?

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, যখন দেশে একটা অস্থিতিশীল পরিবেশ হয়, তখনই হঠাৎ তাঁর নড়াছড়া শুরু হয়। উনি (কামাল হোসেন) তখনই সরকারকে আক্রমণ করে বিভিন্ন কথা বলেন। এই শ্রেণির মানুষরাই সুযোগ সন্ধানী। তারা ভাবে যে যেকোন অস্থিতিশীল পরিবেশের মাধ্যমে তাঁরা ক্ষমতায় যাওয়ার রাস্তা পেতে পারে। সেই স্বপ্ন থেকেই তারা ষড়যন্ত্রের পথে হাঁটে।

ক্ষমতাসীন দলের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক হাছান মাহমুদ বলেছেন, ড. কামাল হোসেনের ভাষা আর গুন্ডাদের অ্যাকশনের ভাষার মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখছি না। এটি অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক। কারণ, ড. কামাল হোসেনকে এতদিন একজন ভদ্র ব্যক্তি হিসেবেই জানতাম। সম্প্রতি ওয়ার্কার্স পার্টির অফিসে অনুষ্ঠিত ১৪ দলীয় জোটের বৈঠকে ড. কামাল হোসেনের তীব্র সমালোচনা করা হয় এবং তার সাম্প্রতিক আচরণকে সন্দেহজনক উল্লেখ করে সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বানও জানানো হয়।

নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাজপথে নামা স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের ওপর হামলার ঘটনার সমালোচনা করে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করতে যে দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দীন আহমদকে জীবন দিতে হয়েছে, সেই বাংলাদেশে গুন্ডাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে- এটা মেনে নেয়া যায় না। তিনি আরও বলেন, আমার জীবনের বিনিময়ে হলেও গুন্ডাতন্ত্র মুক্ত হোক। আমি এই গুন্ডাতন্ত্রের মধ্যে বেঁচে থাকতে চাই না। আমি চাই যে আমাকে গুলি করে মারা হোক। দেশে অসুস্থ শাসনব্যবস্থা চলছে দাবি করে তিনি বলেন, অসুস্থ শাসনব্যবস্থা বলব কারণ এই তরুণ ছাত্রদের সাহায্য না করে তাদের ওপর গুন্ডা লেলিয়ে দিয়েছে। তরুণ ছাত্ররা যা দেখাল তা হলো জাগ্রত বিবেক। তা এখনও আমাদের মধ্যে আছে, যা প্রবলভাবে গোটা দেশকে কাঁপিয়ে দিয়েছে।

এই বক্তব্য রাখায় ড. কামালকে ক্ষমতাসীন দলের তোপের মধ্যে পড়তে হয়। যদিও আওয়ামী লীগের এক সময়ের গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন ড. কামাল হোসেন । বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে তারই ছেড়ে দেওয়া আসনে ১৯৭০ সালের পাকিস্থানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী হিসেবে জয়ী হওয়ার মধ্য দিয়ে ড. কামাল হোসেন রাজনীতিতে আসেন। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান রচনা কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭২ সালে আইনমন্ত্রী এবং ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

কেবল তাই নয়, ১৯৮১ সালে নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন ড. কামাল হোসেন। ১৯৯১ সালে ‘নির্বাচন নিরপেক্ষ হয়েছে’ বক্তব্য রাখায় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের সঙ্গে তার বিরোধ বাঁধে। মুল নেতৃত্ব ওই নির্বাচনে ‘সুক্ষ্ন কারচুপির’ অভিযোগ তোলেন। এ সময় কামাল হোসেন আওয়ামী লীগ ছেড়ে গঠন করেন গণফোরাম।

গণফোরাম গঠনের পর থেকেই কামাল হোসেন পরিচ্ছন্ন রাজনীতির কথা বলে আসছেন। সাম্প্রতিক সময়ে তার রাজনৈতিক তৎপরতা উল্লেখ করার মতোই। এর আগে তাকে কখনোই এতটা তৎপর হতে দেখা যায়নি। হঠাৎ তৎপরতা বেড়ে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে গণফোরামের সভাপতি বলেন, যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করছে তারা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। নাগরিকদের কথার কোনো মূল্য তাদের কাছে নেই। জনগণের কথা শোনার ক্ষমতা তারা হারিয়ে ফেলেছে।

ড. কামাল বলেন, আশা করছি দেশে দ্রুত পরিবর্তন হবে। খারাপ কাজ যারা করছে, তাদের কাছ থেকে দেশকে অবশ্যই মুক্ত করতে হবে। আমরা যদি সবাই ঐক্যবদ্ধ হই, মুক্ত হওয়া কোনো কঠিন ব্যাপার না। একবার না বহুবার অতীতে হয়েছে। আবার হবে, দ্রুতই হবে।

কামাল হোসেন
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close