• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

কৃষ্ণচূড়া

প্রকাশ:  ২৪ আগস্ট ২০১৭, ০০:৪৩ | আপডেট : ২৪ আগস্ট ২০১৭, ০০:৪৫
সুরাইয়া হেনা

ছোট্ট একতলা বাড়ি। শ্যাওলা জমা ছাদ। কিছু লতা ছাদ ছুঁয়ে নেমে গেছে নিচের দিকে। বাড়ির পেছনের দিকটা জংলা মত হয়ে আছে। সারা বাড়ির দেয়ালগুলো ভেঙ্গে গেছে বহুবছর আগেই। অবহেলা খুব স্পষ্ট চোখে পড়ে বাড়িটার সামনে দাঁড়ালে। কত আবেগ ছিলো একেকটা ইট জুড়ে। কত গল্প। কে জানে সেসব?

বাড়ির চারপাশ ঘেরা কৃষ্ণচূড়া গাছগুলোই কেবল সতেজ আজো। বিশালদেহী গাছগুলো তোয়াক্কা করেনা কারো ভাবনা,হেলা-অবহেলার। সূর্যের আলো টেনে,বৃষ্টি টেনে বেশ দম্ভ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এখনো। যদিও দেখলে বয়সটা ঠিকঠাক টের পাওয়া যায়না। কে বলবে বিশ কিংবা বাইশ নয় পঞ্চাশের কোঠাটাও ডিঙ্গিয়ে গেছে!

সম্পর্কিত খবর

    সে তুলনায় বাড়িখানা বেশ বৃদ্ধ হয়ে গেছে। কুঁজো হয়ে হেলে গেছে ডান দিকে। মাঝে মাঝে কিছু দুষ্টু ছেলেপেলের দল দৌড়ে বেড়ায় ভেতরে। আবার পালিয়ে যায়। সাপ আর কিছু পোকা স্থায়ী বসতি গেড়েছে এখানে। আবেগের দেয়াল তুলে বাড়িটাকে দাঁড় করানো দেহ জোড়া কবেই মিশে গেছে সবটায়! পচা গন্ধটাও বিলীন হয়ে গেছে বহুবছর আগে। হারিয়ে গেছে গল্পটাও।

    আশপাশের এলাকার মানুষ গুলো যে যার মতন গল্প বানিয়ে নিয়েছে বাড়িটাকে ঘিরে। ভূতুরে সেসব গল্প খুব আগ্রহ নিয়ে শোনে ছেলে-মেয়েরা। পরে নিজেরা আরো একটু গুছিয়ে বর্ননা করে যে যার নিজের মত। "ওই যে ওই বাড়িটা! কি হইছিলো জানিস? বহুবছর আগে দূর দেশ থেকে এখানে এক ছেলে আর এক মেয়ে পালিয়ে আসছিলো বাড়ি থেকে। ধনী বাড়ির ছেলে-মেয়ে। অনেক টাকা পয়সা নিয়া আসছিলো। তবে ছেলে ছিলো হিন্দু,নাম কৃষ্ণ। আর মেয়ে মুসলমান। নামটা ঠিক জানেনা কেউ। ওরা এইখানে আইসা এই জমিটুকু কিনলো গ্রামের লোকের সাথে কথা বইলা। কয়দিনেই টাকা ঢাইলা বাড়িটা দাঁড় করাইয়া ফালাইলো। তারপর এইখানেই থাকতে শুরু করলো।

    মেয়েটার ছিলো দারুন গানের গলা। সন্ধ্যায় আশপাশের মানুষ মাঝেমাঝে গান শুনতে পাইতো মেয়েটার। কেউ তেমন মিশতো না ওদের সাথে। ওরাই আসলে একা পইড়া থাকতো নিজেদের নিয়া।

    একদিন হঠাৎ ওদের বাড়ির লোকজন খুঁইজা বের করলো ওদের। নিয়া যাইতে চাইলো দুই পরিবারই, কিন্তু আলাদা কইরা। তয় ওরা খুব ভালোবাসতো দুইজন দুইজনরে। কেউ তো কাউরে ছাইড়া যাবে না। অনেক চেষ্টাতেও যখন কাজ হইলো না, তখন বাড়ির লোকজন ওদের হাত পা বাঁইধা আটকাইয়া গেলো ওদের বাড়িতেই। আর যাওয়ার আগে পুরা বাড়িটাতেই আগুন ধরাইয়া দিয়া গেলো। বাড়িটা সব বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে হওয়ায় গ্রামের মানুষের টের পাইতে সময় লাগলো। আর যতক্ষণে টের পাইলো ততক্ষণে অনেক দেরী.... যাইহোক, ওই ঘটনার পর থিকাই আজব আজব ঘটনা ঘটে এই বাড়ির আশেপাশে। ওদের আত্মা ঘুইরা বেড়ায় এই বাড়িটাতে। কৃষ্ণচূড়া ওদের খুব প্রিয় আছিলো হয়তো। সারা বাড়ির আশপাশ জুইরা দেখিস না কেমন কৃষ্ণচূড়া আর কৃষ্ণচূড়া! সন্ধ্যায় বাড়ি থেকে মেয়ে কন্ঠে গানের আওয়াজ ভাইসা আসে। রাইতে চিৎকার শোনা যায় অনেক। ভয়ংকর ভয়ংকর চিৎকার। আর সাথে বিশ্রী পোড়া গন্ধ।"

    চোখেমুখে আতংক ছড়িয়ে দু হাত নেড়ে ভয় ধরানো ভঙ্গিতে গল্পটা শেষ করলো ছোট্ট ছেলেটা। বাকিরা ততোক্ষণে ভয় পেয়ে গেছে বেশ। গল্পের শেষ লাইন শেষ হতেই সবাই উঠে দৌড় লাগালো। শুধু গল্প যে বলছিলো সেই পড়ে রইলো। ছেলেটা আশপাশে আরো একবার চোখ বুলিয়ে নিজেও দৌড় লাগালো জনবসতির দিকে।বসে রইলো দুজন। কিংবা একজোড়া অবয়ব। একজন নারী হয়তো,আরেকজন পুরুষ। বাড়ির সামনের ভাঙ্গা দেয়ালটায় বসে গল্প শুনছিলো ওরা।

    -দেখলে কেমন ভয় পাইয়ে দিলো সবাইকে? নিজেও ভয়ে পালালো।

    -হু। মন খারাপ হয়ে যায় আমার প্রত্যেকবার গল্পটা শুনলেই। গল্পটা কি এমন হওয়ার কথা ছিলো!

    -আসলেই।সুন্দর,মিষ্টি প্রেমের গল্প হওয়ার কথা ছিলো। কেমন ভূতুরে হয়ে গেলো গল্পটা!

    -হু!

    -থাক, মন খারাপ করোনা আর।

    -তোমার মন খারাপ হয়না কৃষ্ণ?

    -নাতো। মন খারাপ হবে কেনো? তোমাকে চেয়েছিলাম। পেয়েছি। দেখো আজো কেমন পাশে আছি তোমার! কাছাকাছি আছি। আলাদা করার কেউ নেই এখন। তোমাকে হারিয়ে ফেলার ভয় নেই আর।

    নারী অবয়ব যেনো মাথা রাখে পুরুষ অবয়বের কাঁধে।

    দুপুর, বিকেলের তপ্ততা,রুক্ষতা শেষে সন্ধ্যাটা অপার্থিব সতেজতা নিয়ে নেমে আসে বাড়িটার চারপাশে। পুরনো ভাঙ্গা জীর্ণ বাড়ির চারপাশে টকটকে লাল কৃষ্ণচূড়া, সবুজ-হলদে পাতার ভিড়ে। কেমন শান্ত চারপাশ! পাখিদের কিচিরমিচির ডাকও আর শোনা যাচ্ছেনা। একটা পাতা টুক করে ঝরে পড়লেও যেনো আওয়াজ উঠবে। পুরুষ কন্ঠ আকুতি নিয়ে বলে "একটা গান শোনাবে চূড়া?"

    নারী কণ্ঠ গান ধরে সঙ্গে সঙ্গেই। ঘোরে ডোবে হয়তো দুজনেই।

    শান্ত, ধোঁয়াটে সন্ধ্যার গম্ভীরতা ছুঁয়ে বিষণ্ণ কণ্ঠের সে গান কি সত্যিই ভেসে যায় লোকালয়ে? সত্যিই শুনতে পায় সবাই?

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close