• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

‘বিবাহ বিচ্ছেদ’ ও প্রাসঙ্গিক কথকতা

প্রকাশ:  ১৩ অক্টোবর ২০১৭, ১১:৪৯ | আপডেট : ১৩ অক্টোবর ২০১৭, ২৩:১৮
মনিরুল ইসলাম মনি

কথায় আছে ‘বিশ্বাসে মেলায় বস্তু আর তর্কে বহুদূর’। কিন্ত বর্তমানে বিশ্বাসকেই বিশ্বাস করা দায় হয়ে পড়েছে! ভঙ্গুর বিশ্বাসের ফলে ক্রমেই জেঁকে বসছে সন্দেহ। আর সন্দেহের প্রসব বেদনার ফসল ‘বিচ্ছেদ’। আমরা কিন্তু আজ থেকে ১০/১৫ বছর আগেও ডিভোর্স কিংবা বিচ্ছেদের সাথে পরিচিত ছিলাম না। এর পরে কমবেশি বিচ্ছেদ হয়েছে এবং হচ্ছে।

‘বিচ্ছেদ’ কখনোই সুখকর সমাধান হতে পারে না। কিছুদিন আগেও চ্যানেল আই লাক্স সুপারস্টার বাঁধনের বিচ্ছেদ হয়েছে। বিচ্ছেদ হয়েছে জনপ্রিয় গায়িকা মিলারও। বাংলাদেশের সবচেয়ে আকৃষ্টময় জুটি তাহসান-মিথিলার বিচ্ছেদ হয়ে গেল মাসদেড়েক আগে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারী প্রায় প্রতিটি মানুষই তাদের বিচ্ছেদের সমালোচনা করেছে খুব মর্মাহত হৃদয়ে। অনেকে তাদেরকে ফিরে আসার আহ্বানও জানিয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ তাহসান-মিথিলাকে হৃদয়ের যেখানে জায়গা দিয়েছিল; সে জায়গাটি তারা ধরে রাখতে পারেনি। এর একটিই কারণ ‘বিচ্ছেদ’। বিচ্ছেদকে কেউ’ই ভালো চোখে দেখে না। তবে এই ব্যর্থতা শুধু তাহসান-মিথিলারই নয়- ব্যর্থতা রাষ্ট্রের, সমাজের, আমাদের সবার।

সম্পর্কিত খবর

    বিচ্ছেদ প্রবণতা সবচেয়ে বেশি নারীদের মধ্যে। দুই-তৃতীয়াংশই বিচ্ছেদ হয়ে থাকে নারীর দ্বারা। আর এদের অধিকাংশ নারীর বয়স’ই ৩০-৪০ এর মধ্যে। বিবাহ বিচ্ছেদের একটি গল্প বলি। আমার পরিচিত এক বড় ভাই ১৫ বছর সংসার করেছেন। তাদের ঘরে দুইটি সন্তানও হয়েছিল। কর্মব্যস্তমুখর বড়ভাই ও তার স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্কটা হঠাৎ করে খারাপ হয়ে যায়। এরই মাঝে পাল্টে যায় তাদের ঘর। বাচ্চা দুইটিরও কোন যত্ন নেই। অবহেলা আর সংকোচেই বেড়ে উঠছিল তারা। কিছুদিন যাওয়ার পরে দুই বাচ্চাকে নিয়ে ভাবী চলে যায় তার বাবার বাড়ি। বাবার বাড়িতে গিয়েই সে শক্ত হয়ে পড়ে। স্বামীর বাড়িতে আর আসবে না। ঘটনা এ পর্যন্তই। সে ভাইটি পরে সন্তানদের পাওয়ার জন্য মামলাও করেছিল।

    কিছুদিন আগে রেডিও ধ্বনিতে ‘মায়ের গল্প’ অনুষ্ঠানে শুনেছিলাম ‘রিজুর মায়ের গল্প’। ঘটনাগুলো কিন্তু সবই আপেক্ষিক। রিজু স্কুলে খুব ভালো ছাত্র ছিলো। ভালো ফুটবলও খেলতো। কিন্তু প্রাইমারীর গন্ডি পেরোতেই অনিশ্চিত হয়ে যায় রিজুর পড়াশোনা। তার বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। মধ্যবিত্ত পরিবারের এই দম্পত্তি সুখের সংসারে সন্দেহের দানা বেধে দেয় প্রতিবেশী এক যুবক। রিজুর বাবা ঐ যুবকের সাথে তার স্ত্রীর সম্পর্ক থাকতে পারে বলে সন্দেহ করতো। পরে রিজুর মা রিজুকে নিয়ে বাবার বাড়িতে চলে যায়। ঘটনা ঠিক আগেরটার মতই। রিজুর নানা-নানী ওর মাকে শ^সুর বাড়ি আসতে দেয়নি। এভাবে একবছর পার হওয়ার পর রিজু ওর নানা বাড়ির এলাকার একটি স্কুলে ভর্তি হয়। কিন্তু নানা-নানী কিছুদিন পড়াশোনা করার খরচ দিলেও পরবর্তীতে খরচ দেওয়া বন্ধ করে দেয়। গভীর সমুদ্রে নিমজ্জিত রিজুর মা বাধ্য হয়ে গাজীপুরে একটি পোশাক কারখানায় চাকরি নেয়। কিন্তু রিজুর পড়াশোনা আর হয়ে ওঠেনি। এর মাঝে ঘটে গেছে অনেক মর্ম বিদারক ঘটনা।

    এই ঘটনাটি পর্যালোচনা করলে কিন্তু অনেক কিছু পাওয়া যাবে। আসলে সমাধানের কিন্তু কিছুই আসেনি। উল্টো তিনটি জীবন নষ্ট হয়ে গেছে।

    সিটি কর্পোরেশনের হিসাবমতে, রাজধানীর ২ সিটি করপোরেশনের ১০ অঞ্চলে ২০১১ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত সময়ে রাজধানীতে ৩৬ হাজার ৩৭১টি বিবাহ বিচ্ছেদের নোটিশ দেওয়া হয়েছে। কার্যকর হয়েছে ৩০ হাজার ৮৫৫টি। এই হিসাবে প্রতিদিন গড়ে ১৫টি, মাসে ৪২৯টি এবং বছরে পাঁচ হাজার ১৪৩টি সংসার বিচ্ছেদ ঘটছে। এর মধ্যে স্ত্রীর পক্ষ থেকে স্বামীকে তালাকের নোটিশ দেওয়ার পরিমাণ ৬৮ দশমিক ১৯ শতাংশ এবং স্বামীর পক্ষ থেকে স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার পরিমাণ ৩৩ দশমিক ০৪ শতাংশ।

    একই সময়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৫টি অঞ্চলে বিবাহ বিচ্ছেদের নোটিশ দেওয়া হয়েছে ১৫ হাজার ৭৮৭টি। এর মধ্যে পুরুষের পক্ষ থেকে ৪ হাজার ৯৯৯টি, আর স্ত্রীর পক্ষ থেকে নোটিশ দেওয়া হয়েছে ১০ হাজার ৮০৩টি। নোটিশ প্রত্যাহার হয়েছে ৩৪৮টি এবং কার্যকর হয়েছে ১৪ হাজার ২৩৪টি।

    একই সময়ে উত্তর সিটির ৫টি অঞ্চলে ২০ হাজার ৫৮৪টি তালাকের নোটিশ পড়েছে। এর মধ্যে পুরুষের পক্ষ থেকে ৭ হাজার ১৯টি এবং নারীর পক্ষ থেকে ১৩ হাজার ৪৬৫টি নোটিশ পড়েছে। নোটিশ প্রত্যাহার হয়েছে ৪৬৫টি এবং কার্যকর হয়েছে ১৬ হাজার ৬২১টি।

    একটি জাতীয় দৈনিকের অতি সা¤প্রতিক এক প্রতিবেদনে গত ছয় বছরের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ সাপেক্ষে প্রতিদিন গড়ে ১৪টি, মাসে ৪২৯টি এবং বছরে ৫ হাজার ১৪৩ টি বিচ্ছেদের ঘটনার পরিসংখ্যান এসেছে। দেখা গেছে নোটিশ পাঠানোর ক্ষেত্রে নারীর সংখ্যা পুরুষের প্রায় দ্বিগুণ।

    আসলে বিচ্ছেদ কি কারণে ঘটে? আমরা কিন্তু উপরের ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করলে বুঝতে পারি বিচ্ছেদের প্রধান কারণ বিশ^াসের অভাব অর্থাৎ সন্দেহপ্রবণতা। এছাড়াও যৌতুকের চাহিদা, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, নেশাগ্রস্থ, অবাধ স্বাধীনতা, সমঝোতার অভাব, ধর্মীয় অনুশাসন অমান্য, স্বাবলম্বী, সঙ্গ না পাওয়া, প্রযুক্তির অবাধ ব্যবহার, সামাজিক অবক্ষয়, পরকীয়া, আধুনিকতা, পরসংস্কৃতি চর্চা। আবার সংস্কৃতিসহ অর্থনৈতিক ও জৈবিক কিছু কারণও আছে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে ‘তিনটি কারণে তালাক প্রবণতা বাড়ছে। প্রথমত: নারীদের স্বাধীনতা, দ্বিতীয়ত: সচেতনতা এবং তৃতীয়ত: উপার্জন ক্ষমতা বৃদ্ধি। যে কারণে নারীরা খুব সহজেই তার সিদ্ধান্ত নিজেরাই নিতে পারছে।’ যদিও ব্যপারগুলো ইতিবাচক হিসেবে গ্রহণ করার সুযোগ রয়েছে। তথাপি: এটাও সত্য যে এসবের জন্যই বিচ্ছেদ প্রবণতা ক্রমবর্ধমান!

    প্রত্যেক মানুষের মনের মধ্যে বাস করে হাজারো আবেগ। কোনটা সুপ্ত আর কোনটা গুপ্ত। তবে নারীরা মাত্রাতিরিক্ত আবেগপ্রবণ। যার ফলে কারণ ছাড়াই কান্না শুরু করে দেয়। যদিও এগুলো মায়াময় আবেগেরই বহি:প্রকাশ। পক্ষান্তরে পুরুষরা উগ্র-রাগী, অধিকারপ্রবণ ও খামখেয়ালীপনা স্বভাবের হয়ে থাকে। অতিশয় খুঁতখুঁতে স্বভাবের নারীরা সবকিছুতেই ভুল ধরে আর পুরুষরা সচরাচর কাঁদে না।

    মনস্তত্ত্ববিদদের মতে, একজন পুরুষের জীবনে আবেগ সরাসরি কাজ করে না। আর নারীদের মাঝে আবেগ আগাগোড়াই কাজ করে। পুরুষের আবেগ অপ্রকাশিত আর নারীদেরটা প্রকাশিত। তবে তার মানে এই নয় যে পুরুষেরা কোনো কিছু প্রকাশ করতে পারে না।

    নারীদের আরও কিছু বদঅভ্যাস আছে। মেয়েদের বদঅভ্যাসগুলো হচ্ছে বেশি বোঝা, কান্না, রাগ, একঘেয়েমি বা একরোখা, সন্দেহ, নেতিবাচক চিন্তাভাবনা, হিংসা, অসহিঞ্চু ইত্যাদি। যেগুলো বধ করতে শুধুমাত্র পুরুষরাই পারে। ওষুধ পুরুষদের কাছেই আছে। আর এই ওষুধটির নাম ‘ভালোবাসা’। ভালোবাসা পেলে নারীদের এই অভ্যাসগুলো বদে পরিণত হতে পারে না।

    বলা যায় দাম্পত্য জীবনটি সুখের করতে স্বামীর ভূমিকা অনেক। স্বামীই পারে নানা ঝামেলা, দুর্দশা ভালোভাবে মোকাবিলা করতে ও অনেক চাপ নিতে। কিরণ নায়ার নামের একজন মনস্বত্ত্ববিদ ধারণা দেন, ‘মানুষের মস্তিষ্কের বাম অংশে থাকে যুক্তি আর আবেগ থাকে ডানে। পুরুষের চেয়ে নারীরা তাদের মস্তিষ্কের বাম ও ডান অংশের সাথে খুব ভালো যোগাযোগ রাখতে পারে।’ বিখ্যাত লেখক খুশবন্ত শিং তাঁর ‘ওম্যান, সেক্স, লাভ অ্যান্ড লাস্ট’ গ্রন্থে চিরকাল ধরে চলমান নারী-পুরুষের এই দ্বন্দ্বের গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন।

    ‘ম্যান আর ফ্রম মার্স অ্যান্ড উইম্যান আর ফ্রম ভেনাস’ গ্রন্থে যুক্তরাষ্ট্রের লেখক জন গ্রে নারী-পুরুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে নানা করণীয় ও বর্জনীয় সম্পর্কে নির্দেশনা দিয়েছেন। ‘তুমি কখনো আমার কথা শোন না’, ‘তুমি কখনও আমাকে সময় দাও না’ এগুলো একজন নারীর সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় সংলাপ। অন্যদিকে একজন পুরুষকে প্রায়ই বলতে শোনা যায়, ‘আমি এ ব্যাপারে কথা বলতে চাই না’, ‘আচ্ছা আমরা কি এই বিষয়টা বাদ দিতে পারি না?’ এত অমিলের মাঝে আবার অসংখ্য জায়গায় মিলও রয়েছে নারী-পুরুষের মাঝে। প্রকৃতপক্ষে সবার মাঝেই কিছু না কিছু মুদ্রাদোষ থাকে। তাই বলে এই ঠুনকো কারণে প্রিয় মানুষটিকে ত্যাগ করাটা কি বুদ্ধিমানের কাজ?

    আমরা জানি পৃথিবীজুড়ে লিঙ্গ বৈষম্য নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। গবেষণা হচ্ছে আমাদের দেশেও। নরওয়ের সমাজবিদ অয়েটিন গলভ্যাগ হন্টারের ‘হোয়াটস ইন ইট ফর মেন? ওল্ড কোশ্চেন, নিউ ডেটা’ শীর্ষক গবেষণাটি প্রকাশিত হয় ২০১৫ সালে। এ গবেষণায় আমেরিকার ৫০টি অঙ্গরাজ্য এবং ৩১টি ইউরোপিয়ান দেশ থেকে তথ্য নিয়েছেন তিনি। বেছে নিয়েছেন সবচেয়ে কম জেন্ডার সমতার দেশগুলিকে। গবেষণাটি বলছে, সমাজে উচ্চ জেন্ডার সমতা শুধু নারীদের নয়, পুরুষদের জীবনেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। জেন্ডার সমতা যেখানে কম সেখানে সূচকে পুরুষদের ভালো থাকার মাত্রা যখন ৩০ তখন উচ্চ জেন্ডার সমতা বিরাজমান জায়গাগুলোতে এই মাত্রা ৭০।

    অনুরূপ একটি গবেষণা কর্ম আইসিডিডিআরবি’র পক্ষ থেকে ‘মেনস কোয়ারসিভ কন্ট্রোল, পার্টনার ভায়োলেন্স পারপিট্রেশন অ্যান্ড লাইফ স্যাটিসফেকশন ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামে করা হয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত বৈষম্যহীন সমাজকেই স্বাগত জানাতে হবে সবাইকে। বিবাহ-বিচ্ছেদ সে সমাজের জন্য অনাহূত আগন্তুক হতে বাধ্য।

    ৬০ দশকের দিকে আমেরিকায় বিচ্ছেদের প্রবণতা ভয়ংকরভাবে বেড়ে গিয়েছিল। আমেরিকার জন্য রীতিমত এটা হুমকিস্বরুপ হয়ে গিয়েছিল। বিশেষ করে সামাজিক আচার ও পরিবার বিলুপ্ত হয়ে পড়ার আশংকায় তারা আবারও ঘুরে দাঁড়িয়েছিল বিশে^র বুকে। ঝড় কাটিয়ে কিন্তু বনে ঠিকই ফুল ফোটে, ঘরহারা মানুষ ঠিকই কিন্তু তাদের ঘর বাধে, বৃক্ষরা তাদের যৌবন ঠিকই ফিরিয়ে আনে। তাহলে আমরা কেন ঘুরে দাঁড়াতে পারবো না। আমরা আমাদের স্বাধীনতাকে খারাপ ভাবে যেন ব্যবহার না করি, প্রযুক্তিকে সঠিকভাবে পরিচালনা করি, দেশ ও সংসারকে ভালোবাসতে শিখি আবারো নতুন করে, হারানো বিশ্বাসকে জাগড়িত করি। তাহলে ‘বিবাহ বিচ্ছেদ’ এর মত একটি সামাজিক ব্যাধি অবশ্যই আমাদের সমাজ থেকে আমরা বিতাড়িত করতে পারবো।

    লেখক: ছড়াকার ও সাংবাদিক

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close