• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

লাশের আর্তনাদ

প্রকাশ:  ০৪ ডিসেম্বর ২০১৭, ০০:৫৫ | আপডেট : ০৪ ডিসেম্বর ২০১৭, ০৩:০২
লাজ্বাতুল কাওনাইন

তখন আমি মনিপুর স্কুলের ছাত্রী। ঠিক কোন ক্লাসে পড়ি মনে নেই! আমাদের স্কুলের সবাই প্রায় হঠাৎ সেইদিন বলাবলি করছে, এই একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে। যাবি যাবি! স্কুলের কাছেই কারো বাসা সম্ভবত এই স্কুলের কোনো ছাত্র বা ছাত্রীর এক্সিডেন্ট হয়েছে। সবার সাথে সাথে আমিও সেই বাসাতে গেলাম। জানতে পারলাম এই বাসার দুই বোন একজন আমাদের স্কুলের ছাত্রী অন্যজন প্রাক্তন ছাত্রী এইচএসসি পড়ে এক সাথে চট্টগ্রাম থেকে ফিরার পথে সড়ক দূর্ঘটনাতে মারা গিয়েছে। এদের মাকে দেখছিলাম! ভদ্রমহিলা অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন।

আমি তখন লালমাটিয়াতে এইচএসসি পড়ি। মিরপুর থেকে কলেজ বাসে যাতায়াত করি। অস্বাভাবিক সুন্দরী এক আপু আমার সাথে স্ট্যান্ডে এসে অপেক্ষা করে। একদিন কথা প্রসঙ্গে জানতে পারলাম আপুটার নাম লীনা। তার বাবা মা তাকে কোলে নিয়ে প্রাইভেট কারে করে আসছিলো দেশ থেকে। তখন তার আড়াই বছর বয়স। বাবার নিরাপদ বুকের পাঁজরে সে বেঁচে গেলেও বাবা আর মা একসাথে মারা যান।

সম্পর্কিত খবর

    তখন আমি পুরাতন ঢাকার একটা প্রাইভেট স্কুলের শিক্ষক। আমার এক কলিগের মা বোন সবাই এক সাথে মাইক্রোবাস উল্টে কুমিল্লা মহাসড়কে মারা গেলো।

    আমি অন্য একটা প্রাইভেট স্কুলে ইনচার্জ হিসেবে চাকরি নিলাম। প্রচন্ড চঞ্চল এক ছেলে। আমি মহাবিরক্ত তার উপর। কিন্তু সেই বিরক্তি চূড়ান্ত মায়াতে পরিণত হলো যখন জানতে পারলাম সে মাত্র ক'মাস বয়সে তার মামা বাবাকে হারিয়েছে সড়ক দূর্ঘটনাতে।

    আমি গাজীপুরে এক পানের দোকানদারকে কাঁনতে দেখেছি আট বছর আগে তার ডান হাত ট্রেন দূর্ঘটনাতে খুলে পড়ে গিয়েছে, পা কেটে ঝুলে ছিলো। সরকারী নিম্নবেতনভুক্ত কর্মচারী ছিলো কিন্তু এখন সে এক হাতেই ছোট ভ্যান দোকান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। আর তার প্রিয় মানুষেরা তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে। ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক ঘটনা আছে আমাদের আশেপাশে ঠিক এমন বা আরো ভয়াবহ। আর এগুলো প্রতিদিন আমরা পত্রিকাগুলোতে খবর হিসেবে দেখতে দেখতে ক্লান্ত। সমাধানের কোনো পথ আছে কি! আজ হঠাৎ একটা আশাব্যঞ্জক খবর চোখে পড়লো। সড়ক দূর্ঘটনার শিকার ব্যক্তির পরিবার এখন থেকে ক্ষতিপূরণ পাবেন। কোর্ট এটা রায় দিয়েছে। প্রখ্যাত চলচিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ এর পরিবার, পরিবহন সমিতি থেকে এই ক্ষতিপূরণ পাবেন এবং তারা মামলা করে এটা পাবার পক্ষে রায় পেয়েছেন।

    আমার মতে দূর্ঘটনার আসলে কোনো ক্ষতিপূরণ কখনোই সম্ভব না। কথায় আছে যার যায়, সেই বুঝে। ব্যাপারটা ঠিক তাই। কারো আপন জন মারা গেলে ক্ষতিপূরণ তার সেই মানুষকে ফিরাতে পারবে না, যে পঙ্গু হয়ে গেলো, তার পঙ্গুত্ব ঘোচাতে পারবে না। তবু এটা জরুরী।

    ১৯৮৩ সালেই এই সংক্রান্ত আইন পাশ হয়েছে বাংলাদেশে, নাম মোটযান অধ্যাদেশ ১৯৮৩। এখানে ১৩৭নং থেকে ১৫৮ নংপর্যন্ত ধারা আছে। এগুলোর কোনোটাই মানা হয় না ঠিক মতো। আমিই রাজা মনোভাবযুক্ত আমাদের যানবাহন চালক, মালিক, কতৃপক্ষসহ সবাই। এখানে জরিমানার বিষয়টা বিশদভাবে বর্ণিত আছে। অনেকেই এই বিষয়টা জানে না বলে মামলা মোকাদ্দমা করেন না। অথবা আমাদের দেশে মামলা মানে খাজনা থেকে বাজনা বেশি আর সাথে বিপুল হয়রানি। মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত বা গরীব,ঘরহারা মানুষ আর কি বা মামলা করবে, ভেবেই হতাশ হয়ে চিরকাল কষ্ট বুকে চেপে আরো কষ্ট করেন।

    কিন্তু এমনটা হবার কথা না। ক্ষতিপূরণ অত্যন্ত জরুরী উভয় পক্ষের জন্য। যারা পাবেন সেটা দূর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তির পরিবারে বা আক্রান্ত ব্যক্তির জীবনযাপনে বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে আর যারা দায়ী তাদের জন্য এটা জরিমানা হিসেবে তাদের সহ আরো পরবর্তী সকল চালক, মালিকদের সতর্ক হতে সহায়তা করবে।

    আর সচেতক নাগরিক বা স্বার্থক রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের দায়িত্ব হলো, সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া যাতে এই দূর্ঘটনা গুলো যতোটা সম্ভব এড়ানো যায়। আর যাদের জীবনে ঘটেই যায়,তাদের বা তাদের পরিবারের কাছে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব বাধাবিঘ্ন হীনভাবে ক্ষতিপূরণ পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করা। তাহলেই হয়তো কিছু কষ্টে জর্জরিত মানুষের খুব অল্প কিছুটা হলেও কষ্ট লাঘব সম্ভব হবে। আর এটা সুস্থ, কর্মক্ষম,দক্ষ নাগরিক সম্পন্ন একটা রাষ্ট্রের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। একজন কর্মক্ষম মানুষের অভাবে পুরোটা পরিবার অকালে ছিন্নভিন্ন হতে পারে,যেটা হতে দেওয়া যাবে না। আসুন সবাই নিরাপদে থাকার প্রার্থনা করি!

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close