• শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||

সুশীল সমাজ কেন বাঁকা পথে হাঁটছেন?

প্রকাশ:  ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০২:৪৬
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

আমাদের সুশীল সমাজের সম্ভবত একটা ধারণা, দেশে যদি কেবল তাদের কল্পিত একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়, তাহলে সেই নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদ হবে একটি ভালো এবং সৎ সংসদ। এই সংসদ দেশে গুড গভর্ন্যান্স বা সুশাসন প্রতিষ্ঠা করবে। এটা একটা আংশিক সত্য। সর্বাংশে সত্য নয়। এই সংসদের নির্বাচিত সদস্যরা যদি সৎ ও ভালো লোক না হন, তাহলে সুশাসন ও আইনের শাসন কোনোটা প্রতিষ্ঠাতেই তারা সক্ষম হন না। বিশ্বে এর ভূরি ভূরি প্রমাণ আছে।

এ জন্য সুষ্ঠু নির্বাচনের একট পূর্বশর্ত- নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলোকে শিক্ষিত, সৎ ও জনগণের কাছে দায়বদ্ধ মানুষকে প্রার্থী হিসেবে দিতে হবে এবং রাজনৈতিক দলগুলো তা দিল কিনা তা দেখার নির্দেশ দেবেন সর্বোচ্চ আদালত ও তা কার্যকর করবে নির্বাচন কমিশন। বাংলাদেশে এ ধরনের কোনো ব্যবস্থা আছে কিনা জানি না। থাকলেও তা পর্যাপ্ত বা কার্যকর নয়। কার্যকর থাকলে একশ্রেণির অসৎ ব্যক্তি ও অসাধু ব্যবসায়ী অবাধে সংসদে ঢুকে এই সংসদীয় ব্যবস্থাটিকে ব্যর্থ করে দিতে পারতেন না।

এ বছরেও দেশে একটি সাধারণ নির্বাচন আসন্ন। অমনি সুশীল সমাজের মুখ চেনা ব্যক্তিরা তৎপর হয়ে উঠেছেন, নির্বাচনটি যেন তাদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়। এই অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলেই দেশে সুশাসন বা ফেরেশতাদের শাসন কায়েম হবে। দেশে মোটামুটি অবাধ নির্বাচন যে হয়নি বা হচ্ছে না, তা নয়। কিন্তু ফেরেশতা নির্বাচিত হতে দেখা যায়নি। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ দুই আমলেই দেখা গেছে, একশ্রেণির মন্ত্রী ও এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যানের দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও ক্ষমতার অপব্যবহারে জনজীবন অতিষ্ঠ।

আমাদের সুশীল সমাজ এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটাবেন কী করে? কেবল হাসিনা সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে কিছু তথাকথিত নিরপেক্ষ লোক দ্বারা নির্বাচন অনুষ্ঠান করে? সেই এক্সপেরিমেন্ট তো কয়েকবার হয়ে গেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনেও কি নির্বাচিতদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ফেরেশতা ছিল? দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল? সুশীল সমাজ সমাধানের আসল ব্যবস্থার দিকে না তাকিয়ে বিটিং দ্য বুশ করে বেড়াচ্ছেন। তাদের মূল উদ্দেশ্য, দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা নয়। তাদের অপছন্দের সরকারকে কৌশলে (যেহেতু আন্দোলন দ্বারা তারা পারছেন না) ক্ষমতা থেকে সরিয়ে নিজেদের পছন্দের লোকের শাসন প্রতিষ্ঠা করা।

তা না হলে তাদের উচিত ছিল, ছোট-বড় সব দলের কাছে আবেদন জানানো, তারা যেন নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে জনগণের কাছে দায়বদ্ধতার প্রমাণ দেন। এই দায়বদ্ধতা হলো মনোনয়ন বাণিজ্য না করা, অর্থশালী নয় এই অজুহাতে কোনো যোগ্য প্রার্থীকে বাদ দিয়ে মাসল ও মানির অধিকারী কোনো নব্য ধনীকে মনোনয়ন না দেওয়া, তাদের অর্থবিত্ত, চরিত্র সম্পর্কিত অতীত যাচাই করা এবং এলাকার জনগণ তাকে পছন্দ করে কিনা, তা যাচাই করা।

তারপর আসবে সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা। সেটা যেমন নির্বাচনকালীন সরকার তদারক করবে, তেমনি করবেন সর্বোচ্চ আদালত এবং নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশনের নির্বাচনকালীন ক্ষমতা আরও বাড়াতে হবে। সর্বোচ্চ আদালত এ সম্পর্কিত নির্দেশ দেবেন এবং নির্বাচন কমিশন তা পালন করবে। সরকার তাতে সহযোগিতা করবে, তদারক করবে- এ ধরনের ব্যবস্থায় অনুষ্ঠিত নির্বাচন সম্পর্কে অভিযোগ তোলার সুযোগ কম থাকবে। আর রাস্তায় নেমে ক্ষমতাসীন সরকারকে নির্বাচনের আগে পদত্যাগ করা, নইলে রাজপথে হাঙ্গামা করা ইত্যাদি হুমকি-ধমকি দিয়ে দেশে অরাজতা সৃষ্টির আশঙ্কা বাড়াতে হবে না।

দেশে যদি এ ধরনের নির্বাচন হয় এবং যে কোনো দলেরই সৎ ও শিক্ষিত প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করুন, সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য ফেরেশতাদের অভিভাবকত্বের আশা করতে হবে না, সরকারই তা পারবে। কেবল হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে ছলে-বলে-কৌশলে হটাতেই হবে- এই জেদ নিয়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠার ভেক ধরলে চলবে না। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সুশীল সমাজ যদি আন্তরিক হন, তাহলে তাদের আশপাশেই একবার চোখ তুলে তাকান, তাহলে বহু দৃষ্টান্ত খুঁজে পাবেন।

সম্প্রতি আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্যে স্থানীয় নির্বাচন আইনে বেশ বড় রকমের পরিবর্তন ঘটানো হয়েছে। শীর্ষ আদালতের নির্দেশে এই আইনে বেশ কিছু রদবদল এনেছে নির্বাচন কমিশন- স্থানীয় নির্বাচনে প্রার্থীদের এখন থেকে তাদের আয়ের উৎস ঘোষণা করতে হবে। রাজ্যের নির্বাচন কমিশনার জানিয়েছেন, পৌরসভা, পৌর পরিষদ ও জেলা পরিষদের নির্বাচনের সময় যাবতীয় আয়ের সূত্র জানাতে হবে প্রার্থীদের। তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, সম্পত্তির নথি ও নিজেদের অপরাধমূলক কাজের নথি প্রদান বাধ্যতামূলক। আদালতের নির্দেশে এখন থেকে প্রার্থীদের উপার্জনের উৎসের বিস্তারিত বয়ান লিখিতভাবে পেশ করতে হবে। দিতে হবে কৃষি কাজ, চাকরি, ব্যবসা ও মূলধনী মুনাফা থেকে আয়ের লিখিত হিসাব এবং স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির পরিমাণের হিসাবও। ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে এই আইন কার্যকর হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, জাতীয় পর্যায়েও এ ধরনের আইন সম্প্রসারণ করা হবে।

আগেই বলেছি, বাংলাদেশে স্থানীয় পর্যায়ে কেন, জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচনেও এ জাতীয় আইন আছে কিনা জানি না। যদি থাকে, তাহলে তা যে আদৌ কার্যকর নয়, তা আমাদের স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচনগুলো পর্যবেক্ষণ করলেই বোঝা যায়। এ ধরনের আইন বলবৎ থাকলে সম্ভবত এক বিশাল সংখ্যক অসৎ ব্যক্তি নির্বাচিত হয়ে আইনের শাসনকে বুড়ো আঙুল দেখাতে পারত না।

কেউ কেউ হয়তো যুক্তি দেখাতে পারেন, রাজনৈতিক দলগুলো যদি অসৎ ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেয়ও, তাহলে জনগণ কেন তাদের ভোট দেয়! এ ক্ষেত্রে জনগণ বা ভোটারদের অসহায়ত্বের কথাটা মনে রাখতে হবে। নির্বাচনকালে প্রভাবশালী মহল থেকে ভোটারদের ভয়-ভীতি, প্রলোভন দেখানো এখন একটি রীতি হয়েছে। আবার তাদের কাছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রার্থী বাছাইয়েরও অবকাশ থাকে না। অনেক সময় দেখা যায়, দুটি বড় দলই একই চরিত্রের প্রার্থীকে মনোনয়ন দিয়েছে। তাদের অর্থবল, প্রভাব ও প্ররোচনা ভোটারদের প্রভাবিত করে।

এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্বই বেশি। নির্বাচনকালীন সময়ে সব দলের মধ্যেই যদি একটি চুক্তি হয় যে, তারা কোনো অবস্থাতেই শিক্ষিত যোগ্য প্রার্থী ছাড়া কোনো চরিত্রভ্রষ্ট নব্য ধনীকে মনোনয়ন দেবে না, তখন সাধারণ ভোটাররাও তাদের পছন্দের প্রার্থী বাছাইয়ের সুযোগ বেশি পাবেন। তার বদলে যদি উভয় দলই একই চরিত্রের অযোগ্য প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয়, তাহলে ভোটারদের কিছু করার থাকে না। তারা ভোটদানে বিরত থাকতে পারেন; কিন্তু তা স্বাভাবিক কারণেই তাদের দ্বারা হয় না। অর্থ, প্রভাব ও প্রচারণার দ্বারা তারা চালিত হন। নির্বাচিত ব্যক্তিরা যে দলেরই হোন, তাদের আখের গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।

ফলে যে দলই সরকার গঠন করুক, দেখা যায় একশ্রেণির অসৎ ও দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তি তাতে ঢুকে পড়ে আরও অনাচারী হয়ে উঠেছেন। ভবিষ্যতে মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলবেন- এমন জামায়াতি নেতারাও খালেদা জিয়ার মন্ত্রিসভায় প্রভাবশালী মন্ত্রী হয়ে বসেছিলেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে আদর্শের বালাই এখন খুব কম। আজ যিনি পরম গণতান্ত্রিক ও সেক্যুলারিস্ট, কাল তিনি রাতারাতি কী করে সাম্প্রদায়িক ও জিহাদিস্টদের দলে ভেড়েন, তা আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে বোঝা মুশকিল। ২০০১ সালের নির্বাচনের সময় দেখা গেছে, বিএনপির যে নেতা 'শহীদ জিয়া' বলতে মূর্ছা যান, বক্তৃতায় আওয়ামী লীগের চৌদ্দপুরুষ উদ্ধার করেন, তিনি নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন না পেয়ে আওয়ামী লীগের দ্বারে দণ্ডায়মান এবং আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন। বাংলাদেশের রাজনীতিকে তাই অতীতের পঙ্কিলতা থেকে এখনও মুক্ত করা যায়নি।

এই পঙ্কিলতা থেকে দেশের রাজনীতিকে মুক্ত করা এবং কেবল সুষ্ঠু নির্বাচনের ধুয়া তুলে নয়, শিক্ষিত ও যোগ্য ব্যক্তিদের সংসদে আসার সুযোগ করে দিয়ে দেশে একটি শক্তিশালী সংসদীয় প্রথা স্থিতিশীল করার যেসব সোজা পথ সুশীল সমাজের সামনে রয়েছে, সে পথে না এগিয়ে তারা কেন বাঁকা পথে ঘুরছেন এবং দেশের পরিস্থিতি জটিল করে তুলছেন, তা কেবল তারাই জানেন। এখনও সময় আছে। তারা দেশের মঙ্গল চাইলে নির্বাচন কারা পরিচালনা করবেন, সে জন্য অযথা মাথা না ঘামিয়ে নির্বাচন কীভাবে নব্য ধনী ও দুর্নীতিবাজদের প্রভাবমুক্ত হয়ে অনুষ্ঠিত হবে এবং দেশের মানুষের জীবনে স্থায়ীভাবে শান্তি ও স্বস্তি ফিরে আসবে, সে চেষ্টায় তারা ব্রতী হবেন কি? [সূত্র:সমকাল]

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী : প্রবাসী লেখক, কলামিস্ট ও সাংবাদিক

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close