• বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

অজানা মা হয়েই থাকলাম...!

প্রকাশ:  ১০ মার্চ ২০১৮, ১৫:২১ | আপডেট : ১০ মার্চ ২০১৮, ১৫:৪০
পূর্বপশ্চিম ডেস্ক
ইফতেখায়রুল ইসলাম, সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার।

পরনে তার লম্বা ঢিলেঢালা একটি জামা! মাথা নীচু করে আমার রুমে প্রবেশ, সাথে তাকে আশ্রয়দানকারী আরও একজন মহিলা এলেন। মেয়েটির মাথা আর উঠছেইনা। আমি অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলাম। একটু পর মাথা উঠিয়ে বললো "স্যার গেরাম থেইকা চইলা আইছি, এই আফায় আমারে থাকতে দিছে। বাবা মা আমারে নিতেও চায়না আবার আফারেও ডিস্টাব (ডিস্টার্ব) করে"

মেয়েটির বয়স ১৯, দক্ষিণাঞ্চলের সহজ সরল মেয়েটির চেহারায় পুরোপুরি সারল্যের ছাপ! এরই মাঝে একটু আধটু করে বলতে শুরু করে মেয়েটি জানায় "স্যার আমি আট মাসের গর্ভবতী! আমার দুই গ্রাম পরের এক পোলার লগে প্রেম হয় আমার, ০২ মাসের মাথায় হুজুরের কাছে গিয়ে বিয়ে করি আমরা। হ্যায় যখন আমারে ছাইড়া যায়গা তখন বুজি ওইটা বিয়া হয় নাই"!!

সম্পর্কিত খবর

    ছেলের সঠিক নাম, ঠিকানা কিছুই জানেনা মেয়েটি। এমনকি যোগাযোগের কোনো নম্বরও নাই! হায়রে সরলতা, পড়াশুনা না জানা গ্রামের এক সহজ সরল মেয়ে ভালবেসে বিয়েই করলো। বিয়ে পরবর্তী এক কুলাঙ্গারের প্রতারণার মাশুল গুনছে আজ মেয়েটি।

    মেয়েটির পরিবার বাচ্চা নষ্ট করার জন্য বলে তাকে। মুখে হ্যা বললেও তাঁর মনে ছিল অন্য চিন্তা! কাউকে না জানিয়ে এক কাপড়ে চলে আসে ঢাকায়। ১৯ বছরের এই ছোট্ট মেয়ে মা হতে চায়; কী এক দুর্বোধ্য শক্তি খেলা করছে তার চেহারায়। দৃঢ়চেতা মনোভাব নিয়ে বললো "বাচ্চা আমি নষ্ট করুম না স্যার, পাপ তো করি নাই, বিয়া করছি। ওই ছেরা (ছেলে) গেছেগা যাক, আমি মা-তো, মরি নাই!! গ্রামের ১৯ বছরের ছোট্ট মেয়েটিকে আমার পৃথিবীর সবচেয়ে সাহসী মেয়ে বলে মনে হতে লাগলো।

    মেয়েটির পরিবার খুবই দরিদ্র। মেয়ের বাবার সাথে কথা বলতেই বললো "স্যার মেয়ের জামাই নাই, বাচ্চা কোত্থেকে আসলো এর উত্তর ক্যামনে দিব আমি? আমারে বাঁচান স্যার!" উভয় সংকট অবস্থায় বাবা চলে গেলেন, ফেলে গেলেন অনাদরে বেড়ে উঠা মেয়েটিকে। আশ্রয়দানকারী যা খাওয়ায় মেয়েটি তা-ই খাচ্ছে, যা মোটেও পর্যাপ্ত নয়। মাঝে মাঝে ভাই হয়ে যেতে ভাল লাগে; নাম বলতে না চাওয়া ওদের ভাই হতে আরও ভাল লাগে! বোন একটা ভাই ঠিকই পেল কিন্তু মানসিক প্রশান্তি সেতো এক ভিন্ন বিষয়! তা কী আর আসে?!

    সময় পেরিয়ে ফুটফুটে এক বাচ্চা পৃথিবীতে আলো'র মুখ দেখে। আহা! কী নিষ্পাপ!! শুধু বাবা নেই। মায়ের ভালবাসা আছে কিন্তু সামর্থ্য নেই! তেজোরূপ মেয়েটিকে প্রশান্ত নদীর মত ঠেকে। বাচ্চাটিকে তাঁর খুব পছন্দের এক পরিবারকে দিয়ে দিয়েছে সে। প্রশ্ন করলাম "আমাকে এটাই জানাতে এসেছো?" জবাবে বললো "আপনি আমার ভাই, তাই সালাম করতে এসেছি"

    হাতে বাচ্চার মুখ পরিস্কার করার একটা কাপড় নিয়ে এসেছে। বললাম "খারাপ লাগছে তোমার"? প্রত্যুত্তরে বললো "আমি চাই ওহ একটা ভাল ভবিষ্যত পাক, আমি কামে গেলে ওরে দেখবো কে? কামে না গেলে খাওয়াবে কে? তাই আমার পরিচিত যে আফার বাচ্চা হয়না তারে দিয়া দিলাম। বাপ-মা দুইজনের ভালবাসাই পাবে ওহ"

    একটু চুপ করে আবার বলতে লাগলো, আমি মা ওরে দুনিয়ায় আনছি, আমার অক্ষমতার জন্য, ওর ভাল ভবিষ্যতের জন্য আমার কাছ থেকে সারাজীবনের জন্য আলাদা করে দিছি আবার এই "আমি মা"।

    আবারও চুপ থেকে বলতে লাগলো আমার পরিচয় ভাই না-ই জানলো ওহ, আমি না হয় অজানা, অচেনা এক মা হয়েই থাকলাম.... বলেই চিৎকার করে কান্না জুড়ে দিল ১৯ বছরের সহজ সরল "মা"! এই কান্নার সামনে ইউনিফর্ম, পেশাগত নিরপেক্ষ গাম্ভীর্য ম্লান হয়ে দু'চোখ ভরে জল আসতে থাকে পুলিশেরও! ছলছল চোখের সে অশ্রু অফিসার কাউকে দেখাতে চায়না। পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্বল মাকে আরও দুর্বল করতে চায়না সে অফিসার.....!

    আন্তর্জাতিক নারী দিবসে আমার বিনম্র শ্রদ্ধা সকল সবল, দুর্বল, অশিক্ষিত, স্বশিক্ষিত ও সুশিক্ষিত সেই নারীদের প্রতি যারা প্রতিনিয়ত সমাজ পরিবর্তনের এক শক্ত ভিত গড়ে চলেছেন.....

    কবি নজরুল যথার্থই বলেছেন

    "এ বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর

    অর্ধেক তাঁর গড়িয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর"

    কে জানে নারীর অবদান হয়তোবা অর্ধেকেরও অনেক অনেক বেশি....!

    লেখক: ইফতেখায়রুল ইসলাম, সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার (ডেমরা জোন) (লেখকের ফেসবুক পেইজ থেকে সংগৃহীত)

    /আজাদ

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close