• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আইসিটি প্রকল্প

১ হাজার ৩৫৩ কোটি টাকার প্রকল্পের শুরুতেই বিতর্ক

প্রকাশ:  ০৬ জুন ২০১৮, ১১:০৭
পূর্বপশ্চিম ডেস্ক

নির্বাচনী বছরের শেষ সময়ে লুটপাটের বড় আয়োজন শুরু হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আইসিটি প্রকল্পে। এক হাজার ৩৫৩ কোটি টাকার ‘আইসিটির মাধ্যমে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার প্রচলন (দ্বিতীয় পর্যায়)’ প্রকল্প শুরুতেই নানা বিতর্কের মধ্যে পড়েছে। বড় আকারের কমিশন বাণিজ্য করতে ইতিমধ্যে প্রথম দরপত্রেই যুক্ত করা হয়েছে ইচ্ছামতো শর্ত। ফলে দরপত্রে অংশ নেয়নি কোনো নামিদামি প্রতিষ্ঠান। এতে প্রথম দরপত্রেই সরকারের গচ্চা যেতে বসেছে প্রায় ১৫ কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আইসিটি প্রকল্পের শুরুতেই ডিপিএম (ডিরেক্ট প্রকিউরমেন্ট মেথড) অর্থাহৃ উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান ছাড়া সরাসরি সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শিক্ষা উপকরণ কেনার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর উদ্দেশ্য, পছন্দের কিছু প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। পরে ‘ই-জিপি’তে (ইলেকট্রনিক গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্ট) যেতে বাধ্য হয়।

জানা যায়, আইসিটি প্রকল্পের মাধ্যমে তিন হাজার ৩৪০টি স্কুলের পাশাপাশি বিদ্যুহৃ সংযোগ না থাকা আরো প্রায় পাঁচ হাজার বেসরকারি স্কুলে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করা হবে। এ ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠান যদি নিজস্ব উদ্যোগে একটি মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম প্রতিষ্ঠা করে তাহলে প্রকল্পের অর্থায়নে আরেকটি মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করা হবে। প্রতিটি বিদ্যালয়ে একটি করে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর, ল্যাপটপ, সাউন্ডবক্স, মডেম ইত্যাদি শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ করে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করা হবে। এসব পরিচালনার জন্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণও দেওয়া হবে। আইসিটি প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের মোট ব্যয় হচ্ছে এক হাজার ৩৫৩ কোটি টাকা। গড়ে একটি স্কুলে মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষ স্থাপনে ব্যয় হচ্ছে এক লাখ ৬০ হাজার টাকা। প্রকল্প বাস্তবায়ন মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০১৬ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত।

তবে গত এপ্রিলে ই-জিপিতে শুধু চারটি প্যাকেজে ‘মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর’ কেনার দরপত্র আহ্বান করা হয়। এই দরপত্রের টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশনে কোয়ালিফিকেশন ক্রাইটেরিয়ায় কোনো অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করা হয়নি। যা একটি দরপত্রের অন্যতম শর্ত। গত ১৪ মে এই দরপত্র উন্মুক্ত করা হয়।

প্রথম পর্যায়ে চারটি প্যাকেজে প্রায় ১৩ হাজার মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর কেনার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর মধ্যে দুটি প্যাকেজে প্রায় তিন হাজার ৭০০টি করে সাত হাজার ৪০০টি এবং ছোট দুটি প্যাকেজে দুই হাজার ৮০০টি করে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর কেনার কথা। গত ১৪ মে দরপত্র খোলা হলে দেখা যায়, চার প্যাকেজের দুটিতে কোনো দরপত্র জমা পড়েনি। বাকি দুটি প্যাকেজের জন্য দুটি দরপত্র জমা পড়েছে, যাদের এ ধরনের পণ্য সরবরাহের পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। আর বাজারে ভালোমানের একটি মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরের দাম ৬০ হাজার টাকা। কিন্তু প্রতিযোগিতা না হওয়ায় ওই দুটি প্যাকেজে এর মূল্য দেওয়া হয়েছে প্রায় ৭৪ হাজার টাকা। এতে ১০০ কোটি টাকার এ দুই প্যাকেজে সরকারের গচ্চা যেতে বসেছে প্রায় ১৫ কোটি টাকা।

সূত্র জানায়, পিডি নিয়োগ থেকে এই প্রকল্পের বিতর্ক শুরু। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দু-একজন কর্মকর্তা এবং শিক্ষামন্ত্রীর কাছের কিছু লোক এই প্রকল্পের জন্য অনুগত একজন পিডির খোঁজ করেন। শেষ পর্যন্ত নিয়োগ পান অধ্যাপক জসীম উদ্দিন। এর পরই শুরু হয় পছন্দের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার তৎপরতা। যাতে মোটা অঙ্কের কমিশন বাণিজ্য হয়। এখনো ওই সব প্রতিষ্ঠানকেই নানাভাবে কাজ পাইয়ে দেওয়ার তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, প্রকল্পের ডিপিপিতে প্রতিটি স্কুলে একটি প্যাকেজে পাঁচটি শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ করার কথা বলা হয়েছে। এতে সব উপকরণ একসঙ্গে কেনার কথা। কারণ একটি সামগ্রী এখন সরবরাহ করে পরে অন্যগুলো সরবরাহ করা হলে আগের উপকরণগুলো নষ্ট হয়ে যাবে। এতে পুরো প্রকল্পটিই ভেস্তে যেতে পারে। কিন্তু প্রকল্প পরিচালক ডিপিপি উপেক্ষা করে ইচ্ছামতো আলাদা প্যাকেজে উপকরণ কেনার দরপত্র আহ্বান করেন।

এসব বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা) মহিউদ্দিন খান বলেন, ‘আমরা আইসিটি প্রকল্পে কোনো অনিয়ম হতে দেব না। আমরা সতর্ক আছি। চলতি অর্থবছরে যদি কেনাকাটা সম্ভব না হয় তাহলে আগামী অর্থবছরে কেনা হবে। এ ব্যাপারে তাড়াহুড়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না।’

সূত্র জানায়, এত দিন অপটোমা ও হিটাচি ব্র্যান্ডের ডিস্ট্রিবিউটর ওরিয়েন্টাল সার্ভিসেস বিডি লিমিটেড, ইউনিট বিজনেস সিস্টেম লিমিটেড, ইপসন ও বেনকিউয়ের ডিস্ট্রিবিউটর ফ্লোরা লিমিটেড, ইনফোকামের ডিস্ট্রিবিউটর আইওআই বাংলাদেশ, ভিউসনিকের ডিস্ট্রিবিউটর ওরিয়েন্টাল কম্পিউটার লিমিটেড, ভিবিটেকের ডিস্ট্রিবিউটর গ্লোবাল ব্র্যান্ড লিমিটেড, এক্সপ্রেস প্রাইভেট লিমিটেড এবং স্মার্ট টেকনোলজিস লিমিটেডের মতো প্রথম সারির দেশীয় প্রতিষ্ঠান শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আইসিটি পণ্য সরবরাহ করেছে। কিন্তু এবার এসব প্রতিষ্ঠানের কোনোটিই দরপত্রে অংশ নেয়নি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি কম্পানির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, ‘দরপত্রের শর্তে ৩০ জুনের মধ্যে সব শিক্ষা উপকরণ সরবরাহের কথা বলা হয়েছে। এটি একেবারেই অসম্ভব। কারণ এসব উপকরণ বিদেশ থেকে ক্রয় করে সরবরাহ করতে হবে। এ ধরনের অবাস্তব শর্ত জুড়ে দিয়ে সুকৌশলে আমাদের দরপত্র থেকে বিরত রাখা হয়েছে। আমরা না পারলে যেসব ছোট প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে তারা কিভাবে পণ্য সরবরাহ করবে, তা বোধগম্য নয়।’

জানা যায়, আইসিটি প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে প্রায় ২৩ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইতিমধ্যে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম দেওয়া হয়েছে। ২০১৫ সালে প্রকল্পটি শেষ হয়েছে। ৩০৫ কোটি ৬৫ লাখ ৩৪ হাজার টাকার প্রকল্পে একটি করে ল্যাপটপ, স্পিকার, ইন্টারনেট মডেম, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর ও স্ক্রিন সরবরাহ করা হয়েছে। শিক্ষক প্রশিক্ষণসহ প্রতিটি মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপনে সরকারের সে সময় ব্যয় হয়েছিল এক লাখ ৩০ হাজার টাকা।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে যেসব সামগ্রী কেনা হয়েছিল, দ্বিতীয় পর্যায়েও একই সামগ্রী কেনা হচ্ছে। দিন দিন কম্পিউটারসামগ্রীর দাম কমছে। সেই হিসাবে বর্তমানে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের উপকরণ আগের চেয়ে কম দামে কেনার কথা। কিন্তু প্রথম পর্যায় শেষ হওয়ার তিন বছর পর প্রতিটি মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম ৩০ হাজার টাকা বেশি দামে কেনা হচ্ছে। মূলত বড় আকারের কমিশন বাণিজ্য করতেই দাম বেশি ধরা হয়েছে।

আইসিটি প্রকল্প পরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন বলেন, ‘নিয়ম অনুযায়ীই দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। যেহেতু ৩০ জুনের মধ্যে অর্থবছর শেষ তাই এ বছরের বরাদ্দ করা অর্থ শেষ করতে দরপত্রে ৩০ জুনের মধ্যে প্রজেক্টর সরবরাহের শর্ত দেওয়া হয়েছে।’ দরপত্রে দামি প্রতিষ্ঠানগুলোর অংশগ্রহণ না করার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কোনো দরপত্রে কেউ অংশ না নিলে আমার তো কিছু করার নেই। যে দুটি প্যাকেজে কেউ অংশ নেয়নি সেগুলোর ব্যাপারে মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নেবে। আর বাকি দুটিতে যারা অংশ নিয়েছে তাদের মধ্য থেকেই নিয়ম অনুযায়ী কেউ কাজ পাবে।’ সূত্র: কালের কণ্ঠ

/এসএম

শিক্ষা মন্ত্রণালয়,মন্ত্রণালয়,প্রকল্প,বিতর্ক
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close