• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

আজও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায়নি রাণীনগরের গণকবর

প্রকাশ:  ২৪ মার্চ ২০১৮, ১২:২০
নওগাঁ প্রতিনিধি

আত্রাই নদীর পাড়ে অবস্থিত সনাতন ধর্মের মানুষদের গ্রাম আতাইকুলা। যেখানে সুখ আর দু:খ নিয়ে বসবাস করতো সনাতন ধর্মের নিরীহ মানুষ। দেশে চলছে স্বাধীন হওয়ার জন্য মুক্তিযুদ্ধ। আর সেই যুদ্ধের সময় পাক হানাদার বাহিনী এই গ্রামে আক্রমণ করে ৫২জনকে হত্যা করে মাটিতে পুতে রাখে। শুধু স্বাধীনতার মাস এলেই আমরা এই স্থানটির কথা মনে করি। দেশের সবকিছুতেই আধুনিকতার ছোঁয়া লাগলেও এখনো মুখ থুবরে পড়ে আছে আমাদের এই অহংকারের বধ্যভ’মি। দেশের এতকিছুর পরিবর্তন হলেও আজ পর্যন্ত এই ধ্যভূমিকে নিয়ে আমাদের মাঝে কোন পরির্বতনের উদয় হলো না। তাই আজও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত হয়ে রয়েছে এই গণকবরের বধ্যভূমিটি।

নওগাঁর রাণীনগরের আতাইকুলা গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বহনকারী একমাত্র ঐতিহাসিক গণকবরটিতে স্বাধীনতার ৪দশকের বেশি সময় পরেও উন্নয়নের কোন ছোঁয়া লাগেনি। ১৯৭১ সালে পাক-হানাদার বাহিনীর নির্মম বর্বরতার স্মৃতি হয়ে পড়ে আছে অযত্নে আর অবহেলায়। কোন অজানা কারণে স্বাধীনতার ৪৬ পরও এই বধ্যভূমিকে সংরক্ষণ করা ও আধুনিক মানসম্মত স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হলো না তা কেউ বলতে পারে না। তবে স্থানীয় সরকার প্রকৌশলী অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলীর পক্ষ থেকে প্রতিটি উপজেলার বধ্যভূমি কিংবা গণকবর তালিকা ভুক্ত করা হবে এবং সংস্কার করে তা আধুনিকায়ন করে সংরক্ষণ করা হবে। এজন্য প্রতিটি উপজেলার বধ্যভূমি ও গণকবর তালিকা ভুক্তি করার জন্য উপজেলা এলজিইডি বরাবর জানানো হয়েছে বলে রাণীনগর এলজিইডি অফিস সূত্রে জানা। ১৯৭১ সালের ২৫এপ্রিল পাক-হানাদার বাহিনীরা সংখ্যালঘু পরিবারের ৫২ জনকে ধরে এনে গুলি করে গর্ত করে গণকবর দিয়ে রাখে এখানে। সেই সব শহীদদের পরিবারগুলো এখন পর্যন্ত পায়নি কোন সাহায্য ও সহযোগীতা কিংবা কোন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। প্রাণে বেঁচে যাওয়া শহীদদের স্বজনদের হাহাকারে এখনও ভারী হয়ে আছে এখানকার আকাশ-বাতাস। চোখের সামনে নিজের সন্তান আর স্বামীকে হারানো যন্ত্রনা নিয়ে বেঁচে আছেন বীরাঙ্গনারা। দেশের জন্য নিজের স্বামী, সন্তান আর সম্ভ্রম উৎসর্গ করলেও আজ তারা বঞ্চিত সব কিছু থেকে। এই সব বীরঙ্গনাদের ভাগ্যে জোটেনি কোন সম্মাননা। বর্তমানে তারা পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছে। গণকবরটি শহীদ পরিবারের সদস্যরা স্মৃতি ধরে রাখার লক্ষ্যে পারিবারিক উদ্যোগে কোন রকমে ইটের প্রাচীর দিয়ে ঘিরে রেখেছে মাত্র।

সম্পর্কিত খবর

    রাণীনগর উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে ছোট যমুনা নদীর তীরে মিরাট ইউনিয়নের নিভৃত পল্লী আতাইকুলা পালপাড়া গ্রাম। ১৯৭১ সালে ২৫ এপ্রিল ওই গ্রামের মুক্তিযোদ্ধাদের নিধন করার লক্ষ্যে গ্রামবাসিরা কোন কিছু বোঝার আগেই হানাদার খানসেনা ২’শতাধিক নরপশুর একটি দল ওই দিন সকাল অনুমান ৯টার দিকে আতাইকুলা পালপাড়া গ্রামের পূর্বদিকে কুজাইল বাজারে উপস্থিত হয়ে পাকিস্তানের পতাকা হাতে নিয়ে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ স্লোগান দেয়। অবস্থা দেখে ওই গ্রামের কিছু লোক নদীর পশ্চিম তীর থেকে পালানোর চেষ্টা করলেও হানাদার বাহিনীর সহযোগী স্থানীয় রাজাকার আলবদররা তাদেরকে বাঁধা দেয়। পাক- বাহিনীরা নদী পার হয়ে এসে পালপাড়া গ্রাম চার দিকে ঘিরে ফেলে। সারা গ্রামের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে ওই গ্রামের যগেশ্বর পালের বৈঠকখানার আঙ্গিনায় একত্রিত করে পাক-হানাদা বাহিনী। এরপর শুরু হয় পাক-সেনাদের বর্বর নির্যাতন। সারাদিন ধরে চলে ঘরে ঘরে হত্যা, লুন্ঠন, ধর্ষণ অগ্নিসংযোগসহ। বিকেল ৪টার দিকে তারা গ্রাম ত্যাগ করার আগে ওই বৈঠকখানার আঙ্গিনায় বন্দীদের ওপর চালায় মেশিনগানের ব্রাশফায়ার। গুলিতে শ্রী গবিন্দ্রনাথ চরন পাল, জগেনন্দ্রনাথ, শুরেশ্বর পাল ও তার ছেলে প্রকৌশলী প্রশান্ত কুমার পাল, শুনিল কুমার পালসহ ৫২জন শহীদ হোন। প্রাণে রক্ষাপায় শ্রী সুনীল চন্দ্র পাল, সাধন চন্দ্র পাল। স্বাধীনতার ৪৬বছর অতিবাহিত হলেও শহীদ পরিবারের খোঁজ-খবরসহ এখানকার গণকবরের উন্নয়নে কেউ ভূমিকা রাখেনি। এলাকাবাসীর দাবি শেষ সময় হলেও শহীদদের সহ তাদের পরিবারকে সরকারি স্বীকৃতি দেয়া ও গণকবরটি সংরক্ষণ করা হোক।

    আতাইকুলা বধ্যভ’মি সংরক্ষণের উদ্যোক্তা প্রদ্যুৎ কুমার পাল জানান, দেশ স্বাধীনের পর কত সরকার, মন্ত্রী ও এমপি এলো কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় এখানে যে ৫২জন সংখ্যালঘুদের নির্মম ভাবে গুলি করে হত্যা করে মাটির নিচে পুতে রাখলো তাদের স্মৃতি রক্ষার্থে কেউ কখনও এগিয়ে আসেনি। সাহয্যের বার্তা নিয়ে কেউ কখনো এগিয়ে আসেনি চোখের সামনে স্বামী- সন্তান হারা পাক-হানাদারদের হাতে নির্যাতিত বীরঙ্গনাদের কাছে। কেই কোন খোঁজ খবরও নেয়নি এই গ্রামের ৯বীরঙ্গনাদের। তিনি আরো জানান, এখানে আমার চোখের সামনে আমার বাবা-ভাইকে পাক-বাহিনীদের করা গুলিতে ধুকে ধুকে মরতে দেখেছি। কিন্তু স্বাধীনতার এত বছর পেরিয়ে গেলেও আমি এবং আমার পরিবার আজো মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের সম্মান পায়নি। এই বধ্যভ’মিকে সংস্কার করে সংরক্ষণ করার দাবী

    নিয়ে কত এমপি’র কাছে ধর্না দিয়েছি কিন্তু কিছুই পায়নি তাদের কাছ থেকে। আমরা সংখ্যালঘু বলেই কি আমাদের বঞ্চিত করা হচ্ছে সবকিছু থেকে? তাই বর্তমান সরকার যে প্রদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তা যেন অচিরেই বাস্তবায়ন করা হয় এটিই আমার জীবনের শেষ চাওয়া। এমন করে বধ্যভ’মিটি যেন সংস্কার করা যেন এই গ্রামের ৫২ শহীদদের রক্তে রাঙ্গানো এই বধ্যভ’মিটি যুগ যুগ ধরে কালের সাক্ষী হয়ে থাকে এবং আগামী প্রজন্ম যেন দেখেই বুঝতে পারে এটি শহীদদের গণকবর।

    রাণীনগর উপজেলা প্রকৌশলী সাইদুর রহমান মিঞা জানান, স্থানীয় সরকার প্রকৌশলী অধিদপ্তরের নির্দেশনা মোতাবেক মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক স্থান সমূহ বধ্যভূমি/গণকবর সংরক্ষনের নিমিতে আতাইকুলা গণকবরের সংরক্ষন ও উন্নয়নের জন্য প্রাথমিক একটি প্রস্তাবনা সংশ্লিষ্ট দপ্তরে প্রেরণ করা হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশনা পেলেই গণকবরটি উন্নয়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

    সারাদেশ

    অনুসন্ধান করুন
    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close