• বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
  • ||

যে দেশে কারো কিছু চুরি হয় না!

প্রকাশ:  ২৮ জানুয়ারি ২০২২, ০০:২১
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রতীকী ছবি

এমনও কি সম্ভব যে, একটি দেশে কোনো চুরিই হয় না! এমনকি কোনো কিছু হারিয়ে ফেলার জো নেই! হ্যাঁ এমনও দেশ আছে। দেশটি কোন দেশ তা জানার আগে ছোট্ট একটা গল্প জেনে নেওয়া যাক।

মৈথিলী জাদেজা নামে এক তরুণী পড়তে গিয়েছিলেন সেই দেশে। একদিন মোবাইল ফোনটি হারিয়ে ফেলেন। অভিযোগও করেন পুলিশের কাছে। তবে মৈথিলী জানাতে পারছিলেন না ঠিক কোথায় তাঁর ফোনটি হারিয়েছে। ফলে পুলিশের জন্যও কাজটি কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

তবে কঠিন কাজটি পুলিশ করার আগেই করে দিয়েছিলেন স্থানীয় ভদ্রলোক। পর্বতারোহী ওই ভদ্রলোক মৈথিলীর ফোনটির স্ক্রিন ভাঙা অবস্থায় পান। পরে সেটি তিনি স্থানীয় পুলিশ স্টেশনে পৌঁছে দেন। ফোন পেয়ে পুলিশ মৈথিলীর ঠিকানায় একটি চিঠি লিখে জানতে চায়, তিনি তাঁর ফোনটি ভাঙাচোরা অবস্থায় খুশি মনে গ্রহণ করবেন কি না।

এর মাত্র সাত দিন পর সুন্দর রঙিন কাগজে মোড়ানো অবস্থায় ফোনটি ফিরে পান মৈথিলী। তিনি বলেন, ‘এটি হৃদয় উষ্ণ করে দেওয়ার মতো বিষয়। কেউ একজন আপনার হারানো ফোন পেয়ে তা আপনাকে ফেরত দিতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছে!’

এই দেশে কেবল ফোন নয়, ওয়ালেট, ঘড়ি এমনকি এর সস্তা তুচ্ছ জিনিস হারিয়ে গেলেও ফেরত পাওয়া যায়। গোটা দেশেই এমন সংস্কৃতি।

এটিই হলো এশিয়ার একমাত্র উন্নত দেশের তকমা পাওয়া সূর্যোদয়ের দেশ জাপান! এ কারণে ইউনিভার্সিটি অব মিশিগান ল স্কুলের ডিন এবং ‘ল ইন এভরি ডে লাইফ ইন জাপান’ বইয়ের লেখক মার্ক ডি ওয়েস্ট জাপানকে ‘অভাগাদের স্বর্গ’ বলে আখ্যা দিয়েছেন।

২০১৬ সালে টোকিও মেট্রোপলিটন পুলিশের ‘লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড’ বিভাগ প্রায় ৩২ মিলিয়ন ডলার সমমূল্যের জাপানি মুদ্রা মালিকদের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে। গত বছরও টোকিও পুলিশ প্রায় ৩৩ লাখ হারানো জিনিসপত্র মালিকের কাছে ফেরত দিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, এ যাবৎ ৩ লাখ ৮১ হাজার ১৩৫টি হারানো ছাতা মালিকের কাছে ফেরত দিয়েছে টোকিও পুলিশ।

মার্ক ডি ওয়েস্ট বলছেন, ‘জাপানের আইনকানুন উন্নত এটিই একমাত্র কারণ নয় বরং হারিয়ে যাওয়া জিনিস পাওয়া ব্যক্তিরা জানেন তাঁরা জিনিসটি ফেরত দিলে কেবল জিনিসটির মালিকের উপকার হবে এমন নয়, সঙ্গে তাঁরাও একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ পাবেন।’ জাপানের বিভিন্ন শহর, উপশহরে প্রায় ৬ হাজার কোবান (জাপানে জনস্বার্থে স্থাপিত ছোট ছোট পুলিশ বক্সকে কোবান বলা হয়) বা বুথ আছে যেখানে হারানো জিনিস জমা দেওয়া যায় এবং ফেরতের বিনিময়ে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ পাওয়া যায়।

কেবল কি অর্থের লোভ? উত্তর হলো, না। জাপানের প্রত্যেকটি শিশুর মনে পরিবার এবং স্কুলে এই বিষয়টি খুব ভালো করে গেঁথে দেওয়া হয়। জাপান পুলিশের সাবেক কর্মকর্তা এবং কানসাই স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের শিক্ষক তোশিনারি নিশিওকা বলেন, ‘একেবারে ছোট্ট, মূল্যহীন জিনিস হলেও সেটা মালিকের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য শিশুদের উৎসাহিত করা হয়। কোনো শিশু যদি এক বা পাঁচ ইয়েনের সমান মূল্যের কিছু পেয়েও ফেরত দেয় তবে তার জন্য শিশুকে বাহবা দেওয়া হয়।’

মায়োকো মাৎসুমতো নামে এক বালক একবার ১০ হাজার ইয়েনসহ একটি মানিব্যাগ কুড়িয়ে পায়। পরে তার মা তাকে নিকটস্থ কোবানে নিয়ে গিয়ে মানিব্যাগটি জমা দেয়। মাৎসুমতো জানায়, সে কোবানে মানিব্যাগটি ফেরত দেওয়ার পর সেখানকার পুলিশ কর্তা তাকে বেশ কিছু ক্যান্ডি দেন। এটি তো স্রেফ পুলিশের তরফ থেকে বাচ্চাদের উৎসাহিত করতে দেওয়া উপহার। আসল ঘটনা হলো, কোনো ব্যক্তি যদি হারিয়ে যাওয়া কোনো জিনিস দাবি করে তবে তাঁকে উপযুক্ত প্রমাণ এবং জিনিসটির মূল্যের ৫ থেকে ২০ শতাংশ মূল্য যে ব্যক্তি পেয়েছেন তাঁকে দিতে হয়।

এখানেই শেষ নয়। কোনো ব্যক্তি যদি তিন মাসের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া জিনিস দাবি না করেন তবে তা স্থানীয় দোকানিদের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয় নামমাত্র মূল্যে। সেখান থেকেও অনেক সময় মালিক তাঁর হারানো জিনিস ফেরত পান। জীবিকার উৎস হয় অনেক জাপানির জন্য। ওসাকায় এমনই একটি দোকান পরিচালনা করেন কেনজি তাকাহাসি। তিনি বলেন, ‘দোকানে থেকে পুরোনো ঘড়ি, সানগ্লাস, বেল্ট, ছাতা ইত্যাদি বিক্রি করি। বছরে তো প্রায় ১০ হাজার ছাতাই বিক্রি হয় আমার দোকান থেকে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি মনে করি আমাদের মতো দোকানগুলো হারিয়ে যাওয়া জিনিসগুলোর সদ্ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত একটি জায়গা।’

এভাবেই জাপানজুড়ে জালের মতো ছড়িয়ে থাকা কোবান, পুলিশের সহায়তা ও মানুষের নৈতিকতা সার্বিকভাবে জাপানি সংস্কৃতির কল্যাণেই হারিয়ে যাওয়া কোনো জিনিস কখনোই হারাতে পারে না! কোনো না কোনোভাবে তা মালিকের কাছে পৌঁছাবেই, যদি মালিক সেটির ব্যাপারে পুলিশকে জানান। অর্থাৎ, জাপান কেবল সূর্যোদয়ের দেশ নয়, না হারানোর দেশও।

পিপি/জেআর

চুরি
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close