• বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

নথি ফাঁসে উবার কেলেঙ্কারিতে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের নাম

প্রকাশ:  ১১ জুলাই ২০২২, ১৭:৪৪
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রো

শুরু থেকেই উবারের বিরুদ্ধে আইনভঙ্গ, কর ফাঁকি ও লবিস্টদের (দালাল) মাধ্যমে কার্যসিদ্ধির মতো মারাত্মক সব অভিযোগ ছিল। কিন্তু এবার সেসব পুরনো অভিযোগ আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। সম্প্রতি ফাঁস হয়েছে উবারের বেশ কিছু গোপন নথি। সেখানে দেখা গেছে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাবেক কমিশনার নিল ক্রোয়েসের মতো হোমরাচোমরা ব্যক্তিরা উবারকে তাদের অনৈতিক ব্যবসা চালিয়ে নিতে মারাত্মকভাবে মদত জুগিয়েছে।

সম্প্রতি ফাঁস হয়েছে উবারের ১ লাখ ২৪ হাজার গোপন নথি। এর মধ্যে রয়েছে ৮৩ হাজার ইমেইল ও ১ হাজার অনলাইন কথোপকথন। মূলত নথিগুলো ২০১৩ সাল থেকে ২০১৭ সালের মধ্যের সময়কার। নথিগুলো আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান, বিবিসি প্যানোরমা ও আন্তর্জাতিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা সংস্থার (আইসিআইজে) মাধ্যমে জনসম্মুখে ফাঁস করা হয়েছে। নথিগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, তৎকালীন সময়ে ইউরোপের ট্যাক্সি ব্যবসাকে ধ্বংস করে দিতে উবার কী কী অনৈতিক পদক্ষেপ নিয়েছে ও কারা উবারকে এসব কাজে গোপনে সাহায্য করেছে।

উবারকে সুবিধা দিতে সেসময়ে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ দেশের আইনে পর্যন্ত পরিবর্তন এনেছিলেন। নথিতে দেখা যায়, উবার কর্তাব্যক্তিদের কাছে পৌঁছাতে ৯০ মিলিয়ন ডলার লবিস্টদের পেছনে খরচ করেছিল। এছাড়াও ফাঁসকৃত নথিতে দেখা যায়, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাবেক কমিশনার নিল ক্রোয়েস অবসরের পরে উবারের সঙ্গে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। ধারণা করা হচ্ছে, এসব কর্তাব্যক্তিরা নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থে ও মোটা অঙ্কের টাকার লোভে দীর্ঘদিন ধরে অনৈতিকভাবে উবারকে সাহায্য করে আসছিল।

বেশ কয়েকবছর আগে প্যারিসে উবার তাদের কার্যক্রম শুরু করলে দেশটি ট্যাক্সিচালকদের বাধার মুখে পড়ে কোম্পানিটি। সেসময়ে ফ্রান্সের তরুণ অর্থমন্ত্রী ছিলেন সাবেক ব্যাংকার ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। ২০১৪ সালের অক্টোবরে উবারের নিযুক্ত লবিস্টদের সহয়তায় ম্যাক্রোঁর সঙ্গে কোম্পানিটির কর্তাব্যক্তিদের আলোচনা হয়। আলোচনা এতটাই ফলপ্রসূ ছিল যে উবারের লবিস্ট ইমেইলের মাধ্যমে যথাযথ কর্তব্যক্তিদের জানিয়েছিলেন, 'দারুণ আলোচনা হয়েছে। আমরা এতটা সুবিধা আগে কখনও পাইনি। ইচ্ছে করছে আনন্দ নাচানাচি করি!'

উবারের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাভিস কালানিকের সঙ্গে ম্যাক্রোঁর মোট চারবার দেখা হয়েছিল বলে জানা যায়। তাদের দেখা সাক্ষাতের এক পর্যায়ে ট্রাভিস ম্যাক্রোকে ইমেইল করে জানিয়েছিল, 'আপনার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। আপনি যেভাবে খোলামেলাভাবে আমাদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন, আমাদের স্বাগত জানিয়েছেন- সরকার থেকে আমরা এতটা সহয়তা পাবো না ভাবতে পারিনি।'

সেসময়ের তথ্য পর্যালোচনা করলে জানা যায়, উবারের এতটা খুশি হওয়ার কারণ। ২০১৪ সালে উবার প্রথম তাদের 'উবার-পপ' সার্ভিস চালু করে। এর আওতায় ফ্রান্সের প্যারিসে লাইসেন্স ছাড়াই চালকদের গাড়ি চালানোর সুবিধা দেয় উবার- যা ছিল স্বভাবতই আইনবিরুদ্ধ। কিন্তু সরকারের সহয়তায় আদালতের আদেশকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে উবার তাদের অনৈতিক ও আইনবিরুদ্ধ কাজ চালিয়ে যায়।

পরবর্তীতে ২০১৫ সালের ২৫ জুন উবারের সঙ্গে ট্যাক্সিচালকদের সম্পর্ক সংঘর্ষে রূপ নিলে ম্যাক্রো সরাসরি উবারকে সাহায্যের প্রস্তাব দেন। ম্যাক্রোঁ বলেন, 'সামনের সপ্তাহে আমি সবাইকে নিয়ে বসব। আইনে কী কী পরিবর্তন আনা যায়, সে বিষয়ে আলোচনা করব আমরা।'

উবারের ফাঁস হওয়া নথিতে দেখা যায়, যারা কিনা আইন প্রয়োগ করবেন, তারাই উবারের লবিস্টটে পরিণত হয়েছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের কমিশনার ক্রোয়েস সরাসরি উবারকে সহয়তা করেছেন। ২০১৫ সালে নেদারল্যান্ডসে উবার-পপ সমালোচনার সৃষ্টি করলে, ক্রোয়েস নিজ থেকে দেশটির কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা করেন। ফাঁস হওয়া ইমেইলে দেখা যায় ক্রোয়েস ডাচ সরকারকে উবারের হয়ে বেশ কয়েকবার তাবেদারি করেছেন। এমনকি উবারের বিরুদ্ধে ডাচ সরকারের কার্যক্রমকে 'হয়রানি' বলেও অ্যাখ্যা দিয়েছেন তিনি।

এদিকে উবারও ক্রোয়েসের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে নিজেদের মধ্যে ই-মেইল চালাচালি করছে। এমন একটা ই-মেইলে বলা হয়েছে, ক্রোয়েসের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অত্যন্ত গোপনীয়। এটা নিয়ে বাইরে কথা না বলাই ভালো। ক্রোয়েসের মাধ্যমেই আমরা নেদারল্যান্ডসের সরকারের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারবো। এটা নিয়ে যত কম কথা বলা যায় ততোই ভালো।' ধারণা করা হয় ক্রোয়েসের সহায়তায়ই উবারের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাভিস কালানিক তৎকালীন ডাচ প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুটের সঙ্গে দেখা করতে পেরেছিলেন।

ফাঁসকৃত নথিতে উবারের আরেক গোপন কার্যক্রম বেরিয়ে আসে, যেটকে উবার নাম দিয়েছে 'কিল সুইচ'। কখনও পুলিশ কিংবা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা উবারের অফিসে অভিযান চালালে তারা তাৎক্ষণিকভাবে কম্পিউটারে থাকা এই কিল সুইচে চাপ দিতে পারবেন। এতে করে কোম্পানির সব গোপনীয় তথ্য-উপাত্তগুলো এমনভাবে লুকানো হয়ে যাবে যে, তা অন্যকেউ খুঁজে বের করতে পারবে না। নেদারল্যান্ডসের অ্যামস্টারডামে ২০১৫ সালের ২ এপ্রিল উবারের অফিসে অভিযান চালানোর সময়ে এই কিল সুইচে চাপ দিয়ে নিজেদের পিঠ বাঁচিয়েছিল উবার- এমন তথ্যই উঠে আসে নথিপত্রে। কেবল নেদারল্যান্ডস নয়, কানাডা, বেলজিয়াম। ভারত। রোমানিয়া, ফ্রান্স ও হাঙ্গেরিতেও একই কাজ করেছে উবার।

যদিও শুরু থেকে উবার তাদের, অনৈতিক কাজগুলো অস্বীকার করে আসছিল, তবে এবারের নথিফাঁস উবার নিয়ে সমালোচনায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। যুক্তরাজ্যের সান ফ্রান্সিসকোতে যাত্রা শুরু করা সিলিকন ভ্যালির এই কোম্পানি কীভাবে বিশ্ব মোড়ল টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছে ও যাচ্ছেতাইভাবে ব্যবসা চালিয়ে নিচ্ছে- এ তথ্য এখন অনেকেরই চোখ কপালে তুলছে। বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠছে কর্পোরেট নৈতিকতা ও ক্ষমতাশীল নেতাদের কার্যক্রম নিয়ে।

সূত্র: বিবিসি, আইসিআইজে

পূর্বপশ্চিমবিডি/এআই

উবার কেলেঙ্কারি,ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট,নথি ফাঁস
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close