• শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
  • ||

স্থিতি ফেরাতে চায় রাশিয়া, পুতিনের ক্ষমতায় চিড় দেখছে পশ্চিমারা

প্রকাশ:  ২৬ জুন ২০২৩, ১৮:৪৯
নিউজ ডেস্ক
মস্কোতে বন্ধ রেড স্কয়ারের সামনে দাঁড়ানো লোকজন। ছবি রয়টার্সের

ইউক্রেইনে যুদ্ধ নিয়ে এমনিতেই ব্যতিব্যস্ত ছিল রাশিয়া, তার মধ্যে ছন্দপতন ওয়াগনারের বিদ্রোহে। সারা বিশ্বের মনোযোগ কেড়ে নেওয়া টানটান উত্তেজনার সেই বিদ্রোহ অবশ্য খুব বেশি রক্তপাত ছাড়াই, অল্প সময়ের মধ্যে শেষ হয়েছে।

কিন্তু তার রেশ তো এত সহজে কাটার কথা নয়; সেজন্যই মস্কোর চাওয়া যত দ্রুত সম্ভব স্থিতি ফেরানো।

অন্যরাও বসে নেই। ওয়াগনারের এই বিদ্রোহ ইউক্রেইন যুদ্ধে কী প্রভাব ফেলবে আর ধাক্কা সামলে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনই বা কীভাবে তার আগের কর্তৃত্ব ফিরে পাওয়ার চেষ্টা চালাবেন, তা নিয়ে পশ্চিমা মহলও ব্যাপক পর্যালোচনা চালাচ্ছে বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।

ওয়াগনার বাহিনীর ওই ক্ষণস্থায়ী বিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল শুক্রবার রাতে। এরপর তারা রস্তোভ-অন-দনে রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর দক্ষিণাঞ্চলীয় বিভাগের সদরদপ্তর দখলে নেয় এবং দ্রুতগতিতে মস্কোর দিকে অগ্রসর হতে থাকে।

পরে বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্ডার লুকাশেঙ্কোর মধ্যস্থতায় হওয়া এক সমঝোতায় নিজেদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পেয়ে শনিবার বিকালে বিদ্রোহী সেনারা তাদের মস্কো যাত্রা বাতিল করে এবং পরে রস্তোভ-অন-দন ছেড়ে নিজেদের ক্যাম্পে ফিরে যায়।

ওই সমঝোতা অনুযায়ী ওয়াগনারের প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোজিনকে এখন রাশিয়া ছেড়ে বেলারুশে চলে যেতে হবে।

বিদ্রোহ চলাকালেই সোমবার মস্কোতে জরুরি পরিষেবা বাদে বাকি সব কাজে ছুটি ঘোষণা করেছিল কর্তৃপক্ষ, বিদ্রোহ থামলেও সেই ছুটি বহাল থাকে। মূলত পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতেই এদিনের ছুটিকে কাজে লাগাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। রোববার সন্ধ্যায়ও শহরটিতে নিরাপত্তা বাড়ানোর তেমন কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি।

প্রিগোজিন যাদের বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত ছিলেন, তাদের অন্যতম প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু এর মধ্যেই ইউক্রেইনে সামরিক অভিযানে অংশ নেওয়া রাশিয়ার সেনাদের সঙ্গে দেখা করে এসেছেন বলে সোমবার রাষ্ট্র পরিচালিত বার্তা সংস্থা রিয়া জানিয়েছে; তবে তিনি কখন, কোথায় গিয়েছিলেন তা জানায়নি তারা।

সোমবার রুশ প্রধানমন্ত্রী মিখাইল মিশুস্তিন বলেছেন, রাশিয়া স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে, তবে দেশটিকে অবশ্যই প্রেসিডেন্ট পুতিনের পেছনে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।

টেলিভিশনে সম্প্রচারিত এক সরকারি বৈঠকে তাকে এ কথা বলতে শোনা গেছে।

“আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে, একটি দল হিসেবে, প্রেসিডেন্টের পাশে থেকে সব বাহিনীর একতা বজায় রাখতে হবে,” বলেছেন তিনি।

এদিন রাশিয়ার সন্ত্রাসবাদবিরোধী কমিটি বলেছে, দেশের পরিস্থিতি স্থিতিশীল। মস্কোর মেয়র সের্গেই সোবিয়ানিন রাজধানীর ওপর জারি থাকা সন্ত্রাসবিরোধী ব্যবস্থাপনা ও নির্দেশনাও প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।

তবে দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা পুতিনকে তার শাসনামলের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ কেটে যাওয়ার পর এখনও প্রকাশ্যে দেখা যায়নি।

ওয়াগনারের ওই নজিরবিহীন হাঙ্গামা চলাকালে বিশ্বের সবচেয়ে বড় পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডারের কী হতে পারে, সেই দুশ্চিন্তায় রাশিয়ার মিত্র এবাং তাদের সঙ্গে বৈরি সম্পর্ক এমন দেশগুলোর সরকারও হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল।

ঝড়ের সেই ঝাপটা কেটে গেলেও তার রেশ কাটাতে পুতিন সরকারের বেশ সময় লাগবে বলেই মনে করছেন পশ্চিমা রাজনীতিকরা।

“আমরা রাশিয়ার ভাবমূর্তিতে আরও ফাটল দেখছি,” রোববার এনবিসির ‘মিট দ্য প্রেস’ অনুষ্ঠানে এমনটাই বলেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন।

একইদিন রুশ উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রেই রুদেনকো বেইজিংয়ে চীন সরকারের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। ওয়াগনারের বিদ্রোহের কারণে তড়িঘড়ি এই সফর হয়েছে কিনা তাৎক্ষণিকভাবে তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

“২৪ জুনের ঘটনাবলীর সঙ্গে সম্পর্কিত পরিস্থিতি স্থিতিশীল করতে রাশিয়ার নেতৃত্ব যে উদ্যোগ নিয়েছে, তার প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছে চীন। রাশিয়ার সঙ্গে সংহতি জোরদার এবং রাশিয়ার আরও সমৃদ্ধিই তাদের চাওয়া,” বলেছে রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

চীনের প্রতিক্রিয়া ছিল মাপা। তারা জাতীয় স্থিতিশীলতা রক্ষায় রাশিয়ার উদ্যোগের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে, যার অর্থ ওয়াগনারকে ঘিরে হওয়া ওই উত্তেজনাকে তারা ‘অভ্যন্তরীণ ব্যাপার’ হিসেবেই দেখছে।

রাশিয়ায় ওয়াগনারের হাঙ্গামা নিয়ে ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ফোনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর সঙ্গেও কথা বলেছেন।

বাইডেন ও ট্রুডো দুজনই রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে ইউ্ক্রেইনের পাল্টা-আক্রমণের প্রতি তাদের জোর সমর্থন ব্যক্ত করেছেন বলে দেশদুটির আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে বলা হয়েছে।

“আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা আগের অবস্থায় না ফেরা পর্যন্ত রাশিয়াকে চাপে রাখা উচিত বিশ্বের,” টুইটারে লিখেঝেন জেলেনস্কি।

এদিকে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন বলেছে, পুতিন চলতি সপ্তাহে রাশিয়ার নিরাপত্তা পরিষদের একটি বৈঠকে অংশ নেবেন। এ নিয়ে আর বিস্তৃত কিছু বলেনি তারা।

বেলারুশের বেল্টা নিউজ জানিয়েছে, রোববার পুতিন ও লুকাশেঙ্কোর মধ্যে ফোনে কথা হয়েছে। আগেরদিনও তারা অন্তত দুই দফা ফোনে কথা বলেছিলেন।

শনিবার টেলিভিশনে দেওয়া এক জরুরি ভাষণে পুতিন ওয়াগনারের বিদ্রোহকে রাশিয়ার অস্তিত্বের জন্য হুমকি অভিহিত করে বিদ্রোহে জড়িতদের শাস্তি দেওয়ার অঙ্গীকার করেছিলেন। তিনি ওয়াগনারের বিদ্রোহকে ১৯১৭ সালের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সঙ্গেও তুলনা করেন, যে বিশৃঙ্খলা দরুন তৈরি হয়েছিল বলশেভিক বিপ্লবের পরিস্থিতি।

“পুতিনের রাশিয়ার ঐক্য নিয়ে যে উপাখ্যান ছিল, তা শেষ হয়ে গেছে। আপনি যখন একটি ভাড়াটে বাহিনীকে অর্থ ও সমর্থন দেবেন, তখন এমনটা অবশ্যম্ভাবীই ছিল,” ইতালির এক খবরের কাগজকে এমনটাই বলেছেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্তোনিও তাজানি।

প্রিগোজিন কোথায়?

সশস্ত্র বিদ্রোহের জন্য প্রিগোজিনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল; কিন্তু শনিবার সন্ধ্যায় হওয়া সমঝোতা অনুযায়ী তা তুলে নেওয়া হবে বলে সেদিনই জানিয়েছিলেন ক্রেমলিনের মুখপাত্র।

প্রিগোজিনকে বেলারুশে চলে যেতে হবে এবং ওয়াগনারের যে যোদ্ধারা তাকে অনুসরণ করে বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিল, ইউক্রেইন যুদ্ধে তাদের অবদানের কথা বিবেচনায় নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, সমঝোতার বিস্তারিত জানিয়ে বলেছিলেন দিমিত্রি পেসকভ।

৬২ বছর বয়সী পেসকভকে শনিবার রাতেই সর্বশেষ একটি এসইউবিতে চেপে রস্তোভ-অন-দনের সামরিক সদরদপ্তর ছাড়তে দেখা গেছে। তারপর থেকে তার অবস্থান অজানা।

পুতিনের এক সময়কার মিত্র প্রিগোজিনের বাহিনী ইউক্রেইনে ১৬ মাস ধরে চলা যুদ্ধে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। রক্তাক্ত লড়াইয়ের মাধ্যমে বাখমুতের দখল নিয়ে দিয়েছে মস্কোকে।

সেই প্রিগোজিনই শনিবার জানান, রাশিয়ার অদক্ষ আর দুর্নীতিবাজ সামরিক কমান্ডারকে সরাতেই তিনি বিদ্রোহ এবং মস্কোর দিকে অগ্রসর হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

চলতি মাসে প্রিগোজিন তার বাহিনীকে রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমান্ডে দেওয়ার নির্দেশও অবজ্ঞা করেছিলেন। শুক্রবার তিনি অভিযোগ করে বলেন, রুশ সামরিক বাহিনী হামলা চালিয়ে তার বাহিনীর অনেক সদস্যকে হত্যা করেছে।

রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

রোববার রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে পুতিনের একটি সাক্ষাৎকার প্রচারিত হয়েছে, যে সাক্ষাৎকারটি ওয়াগনারের বিদ্রোহের আগেই রেকর্ড হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।

ওই সাক্ষাৎকারে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ইউক্রেইনে বিশেষ সামরিক অভিযানই তার অগ্রাধিকার তালিকায় সবার ওপরে স্থান পাচ্ছে বলে জানান।

রাশিয়া
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close