• শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
  • ||

অভ্যুত্থানে ডুবল আফ্রিকার গণতন্ত্র

প্রকাশ:  ৩০ ডিসেম্বর ২০২৩, ২৩:১৫
পূর্বপশ্চিম ডেস্ক

গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় দুঃসময় পার করল আফ্রিকা। বছরজুড়েই একের পর এক অভ্যুত্থানে দুমড়ে-মুচড়ে গেছে লোকনীতির মসনদ। ক্যালেন্ডারের পাতায় পাতায় ছিল বুট-বুলেটের গর্জন। নির্বাচিত সরকার হটিয়ে ক্ষমতার কুরসিতে বসেছেন দুর্ধর্ষ সব সেনানায়ক। স্বৈরশাসনের ঘোর অন্ধকারে ডুবে যায় আফ্রিকার গণতন্ত্রের সূর্য।

ব্যতিক্রম ঘটনাও ঘটেছে। কিছু কিছু দেশে নাগরিকরাই একচেটিয়া ক্ষমতায় থাকা সরকারদের খপ্পর থেকে অব্যাহতি চাইছে। দুর্বল রাষ্ট্রকাঠামো, জীবনযাত্রার নিম্নমান, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, তরুণ জনগোষ্ঠীর বেকারত্ব এবং সামরিক ও আধাসামরিক দ্বন্দ্বে প্রায় ১২ মাসই উত্তাল ছিল আফ্রিকা।

বছরের শুরু থেকেই ঘনীভূত হওয়া অস্থির রাজনৈতিক ঝড়ে আফ্রিকার মধ্য ও সাব-সাহারা অঞ্চলে পরপর পাঁচ দেশে অভ্যুত্থান ঘটে- নাইজার, সিয়েরা লিয়ন, গ্যাবন, বুরকিনা ফাসো ও গিনি বিসাও। ভয়াবহ রূপ নেয় সুদানের গৃহযুদ্ধও।

হত্যা, গুম, ধর্ষণসহ অসংখ্য অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের আঁতুড়ঘর হয়ে ওঠে মহাদেশের এই দারিদ্র্যপীড়িত দেশগুলো। এপি, আলজাজিরা, রয়টার্স, বিবিসি, সিএনএন, দ্য গার্ডিয়ান।

নাইজার

সাহারা এবং উপসাহারা মধ্যবর্তী সীমান্ত অঞ্চলে অবস্থিত পশ্চিম আফ্রিকার দেশ নাইজার। ২৬ জুলাই, ২০২৩ সালে নাইজারের প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ বাজুমকে উৎখাত করা হয়। ক্ষমতা হাতে তুলে নেয় দেশটির রক্ষীবাহিনী কমান্ডার জেনারেল আব্দুর রাহমান চিয়ানি। সঙ্গী নয় সেনানায়ককে সঙ্গে নিয়ে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে ঘটা করে এ ঘোষণা দেন তিনি। প্রেসিডেন্ট বাজুমকে আটকও করা হয় সে সময়। ভেঙে দেওয়া হয় দেশের সংবিধান। বৈদেশিক হস্তক্ষেপকেও নাকচ করা হয়।

সেনাবাহিনীর দাবি, সরকার থাকাকালীন নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতি, দুর্বল অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সুশাসনের কারণে এমন পদক্ষেপ নিয়েছে সেনারা। অভ্যুত্থানের পর পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোর অর্থনৈতিক জোট-ইকোয়াস থেকে নিন্দা ও হুমকি দেওয়া হয়। জোটের বিভিন্ন দেশ নাইজারের সঙ্গে সম্পর্ক স্থগিত করে। এরপর দেশটির সঙ্গে তাদের স্থল ও আকাশ সীমান্ত বন্ধ করে দেয়।

গ্যাবন

মধ্য আফ্রিকার পশ্চিম উপকূলের তেল ও খনিজসম্পদসমৃদ্ধ দেশ গ্যাবন। ৩০ আগস্ট অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে দেশটির সেনাবাহিনী। প্রেসিডেন্ট আলী বঙ্গো ওনডিম্বাকে গৃহবন্দি করা হয়। তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পরই দেখা দেয় এ বিপত্তি। বিরোধীদলীয়রা নির্বাচনটিকে জালিয়াতি বলে অভিহিত করেন। ফলাফল প্রকাশের কিছুক্ষণ পরই দেখা যায় অভ্যুত্থান। এ খবরে দেশটির সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে উদযাপন শুর করে। ওই সময় দেশটির এক নাগরিক বলেন, ‘শুরুতে ভয় পেয়েছি কারণ আমি একটি অভ্যুত্থানের মধ্যেও বেঁচে আছি। কিন্তু আমি আনন্দিত। কারণ এই শাসনের উৎখাতের জন্য আমরা এতদিন অপেক্ষায় ছিলাম।’ তবে জাতিসংঘ, আফ্রিকান ইউনিয়ন ও ফ্রান্স এই অভ্যুত্থানের তীব্র নিন্দা জানায়। বর্তমানে দেশটির অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট সামরিক নেতা ব্রাইস ওলিগুই।

বুরকিনা ফাসো ও সিয়েরা লিওন

পশ্চিম আফ্রিকার আরও একটি স্থলবেষ্টিত দেশ বুরকিনা ফাসো। ২৬ সেপ্টেম্বর অভ্যুত্থানের চেষ্টা হয়। সশস্ত্র বাহিনী ভিন্নমতাবলম্বীরা ইব্রাহীম ট্রাওরে নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন জান্তাকে উৎখাতের চেষ্টা চালিয়েছিল। তাদের এ প্রচেষ্টাটি অবশ্য ব্যর্থ হয়। আফ্রিকার পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত আরও একটি দেশ সিয়েরা লিওনেও একই ঘটনা ঘটে। ২৬ নভেম্বরে দেশটিতে অভ্যুত্থানের চেষ্টা চালানো হয়। এ সময় সামরিক ব্যারাক ও অস্ত্রাগারে ব্যাপক হামলা চালানো হয়। ওই ঘটনার পর ১৩ সামরিক কর্মকর্তা ও একজন বেসামরিক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছিল।

গিনি-বিসাউ

পশিচম আফ্রিকার আটলান্টিক উপকূলীয় দেশ গিনি-বিসাউ। ৩০ নম্ভেম্বর-১ ডিসেম্বর তারিখে দেশটির রাজধানী বিসাউতে সরকারি বাহিনী এবং ন্যাশনাল গার্ড ইউনিটের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। এ ঘটনায় ন্যাশনাল গার্ড কমান্ডার কর্নেল ভিক্টর চংগোকে গ্রেফতার করা হয়। তবে প্রেসিডেন্ট উমারো সিসোকো এমবালো ঘটনাটিকে অভ্যুত্থানের চেষ্টা বলে বর্ণনা করেছেন। এ সংঘর্ষের পর এমবালো দেশের আইনসভা ভেঙে দেওয়ার নির্দেশ দেন।

সুদান

উত্তর আফ্রিকার সোনার ভূখণ্ড সুদান। সেনাবাহিনী সুদানিজ আর্মড মিলিটারি ফোর্স (এসএএফ) এবং আধা-সেনা (আরএসএফের) মধ্যে লড়াইয়ের সূচনা। ২০২৩ সালের ১৫ এপ্রিল এ সংঘর্ষ শুরু হয়েছিল। টানা ১১ দিনের সেনা-আধাসেনা লড়াইয়ে সুদানের রাজধানী খার্তুমে চলে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ। বসতবাড়ি, দোকানপাটসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ধূলিসাৎ হয়ে যায়। ধর্ষণ ও সহিংসতা চালানো হয় নারীদের ওপর। এই সংঘাতে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত কমপক্ষে ৫৫৯ জন নিহত হয়। আহত হয় ৪,০৭২ জনেরও বেশি। দেশটিতে এখনো জ্বলছে সে গৃহযুদ্ধের আগুন।

মালি ও কঙ্গো

মধ্য আফ্রিকার দেশ কঙ্গো এবং পশ্চিমের দেশ মালি। এ বছর উভয় দেশেই জাতিসংঘের বিশাল শান্তিরক্ষা মিশনের সমাপ্তি হয়। কঙ্গো দুই দশক পর সেখানে মিশন শেষ করার জন্য জাতিসংঘের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্থান প্রক্রিয়া শুরু করে। মালিতে শান্তিরক্ষীরা এক দশক দীর্ঘ উপস্থিতির পর মিশন শেষ করে। এর কিছুক্ষণ পর বিদ্রোহীদের শক্ত ঘাঁটি শহর কিদালের নিয়ন্ত্রণ দখল করে নেয় মালিয়ার সামরিক বাহিনী। শুধু এই ৫ রাষ্ট্রেই নয়, গণতন্ত্রের মন্দাবস্থা গেছে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ফ্রিডম হাউজ জানিয়েছিল, ২০২২ সালে বিশ্বব্যাপী স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্র হ্রাস পাওয়ার বছর। যার ধারাবাহিকতা বজায় ছিল ২০২৩ সালেও। সামরিক হস্তক্ষেপের বিষয়টি সবচেয়ে বেশি দেখা দিয়েছে আফ্রিকার দেশগুলোতে।

গণতন্ত্র,আফ্রিকা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close