• সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

মোদির সংকীর্ণতা কি ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পথে বাধা হতে পারে

প্রকাশ:  ২১ জানুয়ারি ২০২৪, ১৮:৪২ | আপডেট : ২১ জানুয়ারি ২০২৪, ২০:০৯
পূর্বপশ্চিম ডেস্ক

ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ১৯৯৪ সালে এক রায়ে বলেছিল, রাজনীতি ও ধর্ম—এক করা যাবে না। তখন এই রায়কে ভারতের সংবিধানের জুতসই ব্যাখ্যা হিসেবে আখ্যা দেওয়া হতো। আগামীকাল সোমবার (২২ জানুয়ারি) ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২২ কোটি ডলারে নির্মিত রামমন্দির উদ্বোধন করবেন। টেলিভিশনের পর্দায় যাঁরা সেই দৃশ্য দেখবেন, তাঁদের সুপ্রিম কোর্টের সেই রায় স্মরণ করিয়ে দেওয়া দেওয়া যেতে পারে বলে মনে করে দ্য ইকোনমিস্ট। আর এর মধ্য দিয়ে তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার লক্ষ্যে নির্বাচনী প্রচারণার অনানুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন নরেন্দ্র মোদি।

দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের ২০ কোটি মুসলমান ও কোটি কোটি ধর্মনিরপেক্ষ মানুষের মনে এই ঘটনা ছাপ রেখে যাবে। এক দশক ধরে বিজেপির যে হিন্দু জাতীয়তাবাদী প্রকল্প ভারত শাসন করছে, রামমন্দির উদ্বোধন তার মাহেন্দ্রক্ষণ হিসেবে চিহ্নিত হবে।

তবে উত্তর ভারতের অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণ নরেন্দ্র মোদির একমাত্র লক্ষ্য নয়, তাঁর লক্ষ্যের আরেকটি দিক তুমুল গতিতে ছুটে চলেছে। সেটা হলো, ভারতের আধুনিকায়ন প্রকল্প। ভারত এখন বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল বড় অর্থনীতি এবং একই সঙ্গে তারা পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। দেশটির অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও ক্রমবর্ধমান প্রযুক্তিগত উন্নতির আকর্ষণে সারা বিশ্বের বিনিয়োগকারীরা সেখানে ছুটে আসছেন।

ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক—দুটি প্রকল্পই নরেন্দ্র মোদি একসঙ্গে পরিচালনা করছেন। জওহরলাল নেহরুর পর তিনি ভারতের সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা হতে চান। জাতীয় মহত্ত্বের যে লক্ষ্য তাঁর মনে আছে, সেখানে সম্পদ ও ধর্মের স্থান পাশাপাশি। কিন্তু বিপদ হচ্ছে তাঁর এই হিন্দু জাত্যাভিমানী প্রকল্প অর্থনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।

অযোধ্যার রামমন্দিরের এই অদ্ভুত প্রতীকী বিষয়টি বুঝতে হলে একটু পেছনে ফিরে যেতে হবে। ঘটনা ১৯৯০ সালের, তখন ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি আজকের মতো এতটা বড় জাতীয় পর্যায়ের দল নয়। সে বছর থেকেই তারা বাবরি মসজিদের জায়গায় রামমন্দির নির্মাণের প্রচারণা শুরু করে। ১৯৯২ সালে বিজেপির তৎকালীন নেতা লাল কৃষ্ণ আদভানির নেতৃত্বে রথযাত্রা শুরু হয় এবং যাত্রায় অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের একাংশ বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে।

যে বিলাসবহুল রামমন্দির নরেন্দ্র মোদি কাল উদ্বোধন করতে যাচ্ছেন, সেটি ভেঙে ফেলা বাবরি মসজিদের জায়গায় নির্মিত হয়েছে।

অনেক হিন্দুর কাছেই বিষয়টি ঐতিহাসিক ভুল শোধরানোর মতো। হিন্দু মহাকাব্য রামায়ণে ভগবান রামচন্দ্রের জন্মস্থান হিসেবে যে অযোধ্যা নগরীর উল্লেখ আছে, সরযূ নদীর তীরে সেই শহরেই শত শত বছর ধরে দাঁড়িয়ে ছিল এই ধর্মীয় স্থান। ছিল, কারণ ১৯৯২ সালে মসজিদের সেই কাঠামো ভেঙে ফেলে উন্মত্ত করসেবকেরা।

ভারতে মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবরের একজন সেনাপতি মীর বাকি ১৫২৯ সালে রামের জন্মভূমি ভেঙে সেই জায়গায় ‘বাবরি মসজিদ’ তৈরি করেন, এমনটাই প্রচলিত ধারণা। যদিও এটা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে।

বিজেপির সাবেক নেতা অটলবিহারী বাজপেয়ী দলের এই হিন্দু—প্রথম আদর্শ বা হিন্দুত্বে ততটা গুরুত্ব দেননি, বরং তিনি মূল ধারার মানুষের সমর্থন লাভের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু নরেন্দ্র মোদি এখন টানা ১০ বছর ক্ষমতায় থাকার পর এই রামমন্দির উদ্বোধন করতে যাচ্ছেন। অটল বিহারি বাজপেয়ী যে সংযম দেখিয়েছেন, তা মোদির মধ্যে নেই। ২০০২ সালে গুজরাটে ভয়াবহ মুসলিমবিরোধী দাঙ্গায় মোদির সম্পৃক্ততা নিয়ে বড় অভিযোগ আছে।

নরেন্দ্র মোদির তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়া প্রায় নিশ্চিত। এই বাস্তবতায় অনেকের মনে উদ্বেগ, এ দফায় হিন্দুত্ববাদী প্রকল্প আরও অগ্রসর হবে। বিজেপির কর্মীরা ভারতের আর অন্তত শ খানেক মসজিদের জায়গায় মন্দির নির্মাণের দাবিতে আন্দোলন করছেন। নরেন্দ্র মোদি ভারতের সংবিধানে মুসলিম পারিবারিক আইনের যে বিধান আছে, তা রহিত করতে চান। এমনকি সংসদীয় এলাকার পুনর্বিন্যাসের পরিকল্পনাও আছে বিজেপির, যার মধ্য দিয়ে হিন্দিভাষী–অধ্যুষিত উত্তরাঞ্চল শিল্পায়িত দক্ষিণাঞ্চলের চেয়ে বেশি ক্ষমতাবান হয়ে উঠতে পারে। ৭৩ বছর বয়সী নরেন্দ্র মোদি আরও এক দশক শাসন করতে পারেন বলেই মনে করা হচ্ছে।

বিজেপির নেতৃত্বে এই রাজনৈতিক পুনর্বিন্যাসের পাশাপাশি অর্থনীতিতেও তুমুল আশাবাদ সৃষ্টি হয়েছে। সবশেষ প্রান্তিকে ভারতের প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। ভারতের যোগাযোগ অবকাঠামোর দারুণ উন্নতি হয়েছে; দেশটির ইকুইটি বাজার আরও বড় ও গভীর হয়েছে; ব্যাংক খাত শক্তিশালী হয়েছে এবং মুদ্রার রিজার্ভ অনেকটা বেড়েছে। সেই সঙ্গে করব্যবস্থার জটিলতা কমেছে। সবচেয়ে বড় কথা, দুর্নীতি কমেছে।

শেষ পর্যন্ত ভারত একক বাজার হয়ে উঠছে, ফলে কোম্পানিগুলো এখন ভারতের বিশাল অর্থনীতির সুবিধা নিতে পারছে। এর মধ্য দিয়ে বিনিয়োগ বৃদ্ধির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। ভারতের উৎপাদন খাত এখনো অতটা শক্তিশালী না হলেও উৎপাদন শিল্প বৈশ্বিক সরবরাহব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছে। তারা এখন ইন্টারনেটের রাউটার থেকে শুরু করে দুই চাকার বিদ্যুৎ–চালিত গাড়ি তৈরি করছে। দেশটির প্রযুক্তি খাত মহিরুহ আকার ধারণ করেছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যে প্রসার সারা পৃথিবীতে হচ্ছে, তাতে দেশটির আইটি কোম্পানিগুলো আরও বড় হবে বলেই ধারণা করা যায়।

তবে ভারতের এই অর্থনৈতিক উত্থানের চিত্র এখনো নিখুঁত নয়। দেশটিতে প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থানের হার এখনো অনেক কম। নরেন্দ্র মোদি ডিজিটাল সমাজ কল্যাণমূলক ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছেন। ফলে ভারতের সাধারণ হিন্দুদের মনে তাঁর এমন এক ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে যে তিনি পিছিয়ে পড়া মানুষের কথা চিন্তা করেন। মানবসম্পদ উন্নয়নে ভারত এখনো পিছিয়ে এবং দেশটির শিক্ষাব্যবস্থা শোচনীয়। কিছু শক্তিশালী ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ব্যাপক প্রতিপত্তি অর্জন করেছে। যদিও দ্য ইকোনমিস্ট মনে করছে, সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য এই ভিত্তি যথেষ্ট।

প্রশ্ন হলো, উচ্চ হারের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও ধর্মীয় অ্যাজেন্ডা কি পাশাপাশি চলতে পারে? দ্য ইকোনমিস্ট মনে করছে, এর উত্তর হচ্ছে হ্যাঁ, তবে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত। বিজেপির সংসদীয় শক্তি ও নরেন্দ্র মোদির জনপ্রিয়তার কারণে দলটি এখন পর্যন্ত অনেক কঠিন সংস্কার কর্মসূচি নিয়ে এগোতে পেরেছে, যেমন জাতীয় বিক্রয় কর। সরকারের একতা ও ভাবমূর্তি বিনিয়োগকারীদের এই আত্মবিশ্বাস দিয়েছে যে ভারতে নীতির ধারাবাহিকতা আছে, যদিও নাগরিক স্বাধীনতা কিছু খর্ব হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী,ভারত,নরেন্দ্র মোদি
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close