• শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
  • ||

‘ল্যাংড়া হাসান’ এক পা নিয়েই দুর্ধর্ষ ডাকাত

প্রকাশ:  ২৮ ডিসেম্বর ২০২২, ১২:০৮
নিজস্ব প্রতিবেদক

হাসান জমাদ্দার ওরফে ল্যাংড়া হাসান। বয়স চল্লিশের কোঠা এখনও পার হয়নি। গ্রামের বাড়ি বরিশালের বাকেরগঞ্জের রূপারজোর এলাকায়। পেশায় ছিল রাজমিস্ত্রি। মমতাজ ও একাব্বর নামে দুর্ধর্ষ দুই ডাকাতের হাত ধরে ২০০৮ সালে ডাকাত চক্রে নাম লেখায় হাসান। ধীরে ধীরে তাদের বিশ্বস্ত শিষ্য হয়ে ওঠে। ‘বন্দুকযুদ্ধে’ দুই ওস্তাদ নিহত হওয়ার পর ডাকাত চক্রটির হাল ধরে হাসান।

বিভিন্ন জেলায় ঘুরে স্বর্ণের দোকানে ডাকাতি করাই এ দলের কাজ। সর্বশেষ ৩০ অক্টোবর ফেনীর সোনাগাজীতে অর্জন চন্দ্র ভাদুরীর স্বর্ণের দোকানে ফিল্মি কায়দায় ডাকাতি হয়। দোকান মালিককে কুপিয়ে ও হাতবোমা বিস্ম্ফোরণ ঘটিয়ে মুখোশপরা ডাকাত দলের সদস্যরা ২৮ লাখ টাকার স্বর্ণালংকার লুট করে। এর আগে ১৭ আগস্ট প্রায় একই কায়দায় কেরানীগঞ্জের নাসির উদ্দিন সুপার মার্কেটের নিউ আল আমিন জুয়েলার্স মার্কেট থেকে ১ কোটি ২৫ লাখ ২৯ হাজার টাকার স্বর্ণালংকার লুট হয়।

ওই দুই ঘটনায় দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ ও সোনাগাজী থানায় অজ্ঞাতপরিচয় ডাকাত চক্রের সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। চাঞ্চল্যকর ঘটনা বিবেচনায় নিয়ে ডাকাতদের শনাক্ত করতে ছায়াতদন্ত করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।

তদন্তে উঠে এসেছে দুর্ধর্ষ ডাকাত ল্যাংড়া হাসানের নাম। এক পা নিয়ে সে দীর্ঘদিন ধরে নেতৃত্ব দিচ্ছে আন্তঃজেলা ডাকাত দলটির। কেরানীগঞ্জ ও সোনাগাজীর ঘটনায় সে সরাসরি উপস্থিত ছিল। মিশন সফল করে ভারতে পালিয়ে যায়। তবে স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে মাঝে মাঝে অবৈধভাবে দেশে আসে। গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত তাকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।

কেরানীগঞ্জে ডাকাতি মামলার বাদী বিপ্লব মণ্ডল বলেন, ডাকাতির তিন মাস পার হলেও পুলিশ কাউকে ধরতে পারেনি। সোয়া কোটি টাকার বেশি মূল্যের স্বর্ণালংকার লুট হলো। আমার ভাইকে ডাকাতরা গুলি করে পঙ্গু করে দিল। স্বর্ণালংকার পাবো কিনা, তাও জানি না।

সম্প্রতি রাজধানীর খিলগাঁও এলাকায় ডাকাতির ঘটনা তদন্ত করেন গোয়েন্দারা। বেশ কয়েকজনকে শনাক্ত করা হয়। তদন্তে উঠে আসে একই ডাকাত চক্র। তারা সোনাগাজী, কেরানীগঞ্জ ও ভালুকার ডাকাতিতেও জড়িত।

তদন্ত সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রামে ডাকাতি করতে গিয়ে ২০১৪ সালে পুলিশের সঙ্গে গোলাগুলি হয়। এ ঘটনায় পায়ে গুলিবিদ্ধ হয় হাসান। এরপর কাটা পড়ে তার ডান পা। এখন কৃত্রিম পা লাগিয়েছে। এর পর থেকেই সে 'ল্যাংড়া হাসান' নামে পরিচিত।

২০১২ সালে ডাকাতির ঘটনায় গোয়েন্দা পুলিশের হাতে হাসান গ্রেপ্তার হয়েছিল। মগবাজারের দিলু রোডের একটি দোকান থেকে ৪২ লাখ টাকার স্বর্ণালংকার লুট হয়েছিল।

পুলিশের উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা জানান, হাসানের ডাকাতির কৌশল হলো প্রত্যেক ঘটনায় অস্ত্র ও হাতবোমা ব্যবহার করা। বছর পাঁচেক আগে মানিকগঞ্জের নাগ জুয়েলার্সে ডাকাতির সময় লোকজন তাকে ঘেরাও করেছিল। গুলি ও হাতবোমা নিক্ষেপ করে পালিয়ে যায়। পুলিশকেও একই কৌশলে ব্যর্থ করে দেয়। তবে এ ঘটনায় তার প্রধান সহযোগী মনির মোল্লাকে পাবনা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। ল্যাংড়া হাসান তখনও অধরা থেকে যায়।

গত ১৭ আগস্ট দিনদুপুরে ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের আল আমিন জুয়েলার্সের ডাকাতির ঘটনা সিসিটিভির ফুটেজে ধরা পড়ে। এতে দেখা যায়, দুটি মোটরসাইকেলে এসে মাত্র তিন মিনিটে ডাকাতি করে পালিয়ে যায় ডাকাতরা।

ভিডিওতে দেখা যায়, গায়ে সাদা রঙের পাঞ্জাবি আর মাথায় কালো টুপি পরা এক লোক হাতে ব্যাগ নিয়ে পা খুঁড়িয়ে স্বর্ণের দোকানে ঢুকল। ইশারা করতেই দোকানে প্রবেশ করল আরও চারজন। ব্যাগ থেকে সাদা রঙের একটি পিস্তল বের করল। প্রথমে তারা এক দোকানির মাথায় অস্ত্র ঠেকাল। অন্য সদস্যরা দোকানের তাক ভেঙে দ্রুত স্বর্ণালংকার লুট করে ব্যাগে ভরতে থাকে। এক দোকানি বাধা দিলে পিস্তল দিয়ে তার ডান পায়ে গুলি করা হয়। মিশন শেষে পরপর কয়েকটি হাতবোমার বিস্ম্ফোরণ ঘটিয়ে তারা পালায়।

এর এক মাস আগে ময়মনসিংহের ভালুকায় একই কায়দায় ডাকাতি হয় প্রদীপ জুয়েলারিতে। দোকান মালিক কৃষ্ণ কর্মকার মামলা করলেও কেউ গ্রেপ্তার হয়নি।

জানা গেছে, ডাকাতি করেই কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালায় ল্যাংড়া হাসান। সেখানে তার আধার কার্ড রয়েছে। তবে পরিচয় গোপন করে এনআইডি কার্ড তৈরি করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়। ভারত থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অন্য সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে।

ডাকাতি করার আগে এক থেকে দেড় মাস রেকি করে হাসানের ডাকাত দলের সদস্যরা। প্রতিটি ঘটনায় অংশ নেয় ৬-৮ জন। ডাকাতির স্বর্ণ নির্দিষ্ট কিছু দোকানে বিক্রি করে টাকা ভাগাভাগি করে।

ডিবির প্রধান ডিআইজি হারুন অর রশিদ বলেন, বেশ কয়েকটি ডাকাতির ঘটনায় ল্যাংড়া হাসানের নাম এসেছে। ঢাকা, মানিকগঞ্জ, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম, ঝলকাঠিসহ বিভিন্ন জেলায় করা ১৪ মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে। ফেনীতে ডাকাতি করতে গিয়ে একজনকে হত্যাও করেছে ল্যাংড়া হাসান। তাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

ডিবির অতিরিক্ত উপকমিশনার শাহিদুর রহমান বলেন, ল্যাংড়াকে ধরার চেষ্টা করে এখনও সফল হইনি। এখন পর্যন্ত তার দু'জন স্ত্রীর খোঁজ পাওয়া গেছে। এক স্ত্রীকে গাজীপুরে তিনতলা বাড়ি করে দিয়েছে। সেখানে তার দুই সন্তান রয়েছে।

গ্রেপ্তার
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close